পোস্টস

প্রবন্ধ

বিভেদের কারণ ভাষা নাকি ধর্ম ?

১৯ অক্টোবর ২০২৪

Yousuf Haque Chowdhury

ভাষা মানুষকে যেমন কাছে টানে তেমনি আবার ঠেলে দেয় বহু দুরে। যেমন দেখবেন বাংলাদেশে। সিলেট, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী কিংবা বরিশালের মানুষজন শুধুমাত্র ভাষাগত মিল থাকার কারণে পরকেও আপন করে নেয়। এই উদাহরণটা মজার ছলেই দেয়া। কিন্তু এর গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক নমুনাও আছে। তার আগে চলুন ভাষা নিয়ে কিছু অপরিচিত আলোচনা করা যাক। জোসেফ স্টালিন পানি, বিদ্যুৎ, জ্বালানির মতো ভাষাকেও উত্পাদনের আবশ্যকীয় উপাদান বলে মনে করতেন। তিনি আরও মনে করতেন ভাষা অর্থনীতি বা উত্পাদন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। অন্যদিকে ক্ষমতাবানদের নিকট ভাষা হচ্ছে এমন একটি মাধ্যম যাকে ব্যবহার করে তাদের শাসন ও শোষণ চালিয়ে যান। জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ নামক উপন্যাসে দেখা যায় শাসক শ্রেণী জনগণের বাক-স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তাদের ভাষা থেকে কিছু প্রচলিত শব্দ বাতিল করে দেন। আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ‘স্বাধীনতা’ বা ‘বাংলাদেশ’ নামক শব্দগুলো উচ্চারণ করতে দেওয়া হতো না। তাই কবি শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় তার ‘বন্দী শিবির থেকে’ নামক কবিতায় লিখেছিলেন- অথচ এ দেশে আমি আজ দমবন্ধ /এ বন্দীশিবিরে/ মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ/ মনের মতন শব্দ কোনা।

 

একটা বিষয় খেয়াল করলে দেখা যায় বিভক্তির প্রশ্নে মানুষ অকারণে ধর্মকে দোষারোপ করে। কিন্তু বিভক্তির চূড়ান্ত প্রভাবক হলো ভাষা। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্য হওয়া নিয়ে রাশিয়ার উদ্বেগ একটা অজুহাত মাত্র, অনেকটা সাদ্দাম হোসেনের কাছে রাসায়নিক অস্ত্র থাকার মার্কিন গুজবের মতো। তাছাড়া রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অনেক দেশই আগে থেকেই ন্যাটো সদস্য। এই যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশ ভাষায় কথা বলা মানুষের উপর ইউক্রেনীয় মিলিশিয়া গ্রুপ অ্যাজভ ব্যাটালিয়নের দমন পীরন চলছিলো। রুশ ভাষীরা তাই বহু আগে থেকে পুতিনের হস্তক্ষেপ চাইছিলো। এই ঘটনা অনেকটাই ৪৭ পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির সাথে মিলে যায়। 

 

১৯৪৮ সালে যখন ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন তার মধ্যে ক্ষমতা দখলের কোনো রাজনীতি ছিল না। এমনকি দাবিটা তখন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করারও ছিল না। ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি। উর্দুকে পাকিস্তানের Lingua franca করার ব্যাপারেও বাংলা ভাষার আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজের কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু শাসক মুসলিম লীগের নেতারা এই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল। তারা এটাকে ‘যুক্ত বাংলা গঠনের ষড়যন্ত্র’, ‘হিন্দুদের চক্রান্ত’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার এক বছর পর ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ জন্ম নেয়। মুসলিম লীগের শাসন উচ্ছেদের জন্য ভাষা আন্দোলন কোনো বড় রকমের সহায়ক শক্তি হবে এটা হয়তো তারা প্রথম দিকে বুঝতে পারেননি। পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারি সরকারও বাংলা ভাষীদের ওপর একই দমন পীড়ন চালিয়েছিলো যার পরিনাম ৭১-এ পাকিস্তানের বিভক্তি। ধর্মের মিল কিন্তু এই বিভক্তিকে আটকাতে পারেনি। 

 

ভারতেও কিন্তু একই ঘটনা আছে। ভারতের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দেশটির স্বাধীনতারও আগের। ১৯৩৭ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির স্হানীয় কংগ্রেস সরকার স্কুলে হিন্দি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলে ভাষা নিয়ে প্রথম আন্দোলন শুরু হয়। ভাষাকে কেন্দ্র করে ভারতে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ হয় ১৯৬৫ সালে যখন হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা করা হয়। তখন এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়, মানুষ রাস্তায় নেমে আসে দলে দলে। শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালে হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকেও ব্যাবহারিক সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ৪৭ পরবর্তী ভারতে অনেকগুলো নতুন রাজ্য সৃষ্টি হয়েছে ভাষাগত কারণে। যেমন দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজ রাজ্য ভাষার কারণে চার ভাগ হয়েছে। তেলেগুভাষী অন্ধ্র প্রদেশ, তামিল ভাষী তামিলনাড়ু, মালায়ালাম ভাষী কেরালা, কান্নাড়ি ভাষী কার্নাটাক। উত্তর-পূর্ব ভারতের এক আসাম প্রদেশ ভেঙে ৭টা রাজ্য সৃষ্টি হয়েছে যার মধ্যে ভাষার ভিত্তিতে নাগা ভাষী নাগাল্যান্ড, মিজো ভাষী মিজোরাম হয়েছে। এখন মনিপুরের কুকি ভাষীরা, আসামের বাংলা ভাষীরাও আলাদা রাজ্য চায়। তবে ভারত নিজেই একটা পরাশক্তি হওয়ার কারণে এসব বিভক্তির সুযোগে অন্যরা ফায়দা উঠাতে পারেনি, ভারতও ভাঙেনি।

 

দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল স্কুল পর্যায়ের ছাত্ররা। তখন দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গদের সাম্রাজ্যবাদী সরকার। দক্ষিণ আফ্রিকার গাউটাং এর জোহানসবার্গ শহরের সোয়েটোতে সংঘটিত এই আন্দোলনটি হয়েছিল ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন। গাউটাং কর্তৃপক্ষ স্কুলে আফ্রিকান্স ভাষায় শিক্ষাদান বাধ্যতামূলক করলে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসে। কারণ তারা তাদের মাতৃভাষা জুলু এবং ব্যবহারিক Lingua franca ইংরেজিতে শিক্ষা নিতে বেশি আগ্রহী ছিল। তত্কালীন বর্ণবাদী সরকার প্রতিবাদ সভায় যোগ দিতে যাওয়া ছাত্রদের মিছিলে গুলি করে। শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক নেটিভ আমেরিকান ভাষা ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসকদের হাতে মৃত্যুবরণ করে। গত শতকের ষাট-সত্তরের দশকে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময় এই নেটিভ আমেরিকান ভাষা রক্ষার দাবিও সামনে চলে আসে। কানাডার পূর্ব অংশের অঙ্গরাজ্য কুইবেকের রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল ভাষা। কানাডা ইংরেজিভাষী দেশ হলেও কুইবেকের অফিসিয়াল ভাষা কিন্তু ইংরেজি নয়, ফ্রেঞ্চ।

 

ইউরোপের হারিয়ে যাওয়া পরাশক্তি সাবেক যুগোস্লাভিয়ার ভাঙন ঠেকাতে পারেনি অভিন্ন খ্রিষ্টধর্ম। আরব অঞ্চলে মুসলিম কুর্দিভাষীদের কুর্দিস্তান আন্দোলন চলছে বহুকাল ধরে। ইসলামিক পাকিস্তানের পশতুনরা আফগানিস্তানের সাথে যুক্ত হতে চায় ভাষাগত কারণে। স্বাধীনতার দাবিতে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে স্পেনের কাতালোনিয়া অঞ্চলে অনুষ্ঠিত গণভোটকে স্পেনের আদালত সাংবিধানিকভাবে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করেছে। কাতালানদের স্বাধীনতার দাবির পেছনেও রয়েছে ভাষার প্রভাব। ভাষাগত মিলটা সাধারণত আসে জাতিগত কারনে, ধর্ম থেকে নয়। ধর্ম বিশ্বাসে পার্থক্যের কারণেও কিছু দেশে বিভক্তি হয়েছে। তবে সেই বিভক্তি গুলোর প্রত্যেকটা ছিলো পরাশক্তিগুলোর চাপিয়ে দেয়া। জনগণের মধ্য থেকে তা আসেনি। এর সর্বশেষ উদাহরণ দক্ষিণ সুদান রাষ্ট্রের আবির্ভাব। সুতরাং ভাষা শুধু কাছেই টানেনা, দুরেও সরিয়ে দেয়।