পরদিন সকালে।
চা খেতে খেতে ডায়রি পড়ছেন জামশেদ হক।
পৃষ্ঠার এক কোণে তারিখ, বার ও সময় লেখা। বিশেষ দিক হচ্ছে প্রতি বারেই সে শুধু ইংরেজি না বাংলা আরবি তিনটা তারিখই লিখেছেন । সুতরাং তিনি যে দিন তারিখের বিষয়ে সচেতন ছিলেন তা নিশ্চিত।
নিত্য দিনের অভিজ্ঞতা নিয়েই ডায়েরিটা লেখা। কোন দিন শিক্ষনীয় অভিজ্ঞতা। কখনো বা দিনটি কেমন ছিলো তার কথা। কোনো দিন আবার শুধুই কোনো বিখ্যাত উক্তি বা উদ্ধৃতি। কিছু স্বরচিত কবিতাও পাওয়া গেলো। আবার কোথাও বা কোনোদিন হঠাৎ ঘটে যাওয়া ছোট ছোট ঘটনা উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। যা সাধারণ দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক মনে হলেও তেমন জটিল কিছুনা।তিনি আবার সেসবের ব্যাখা দাড় করানোর চেষ্টা করেছেন।গোয়েন্দা গল্প পড়ার কারণেই যে ওনার মাঝে এমন একটা শার্লক হোলমস জন্ম নেয় এটা বলা ভুল হবেনা।
চিঠিতে ও তেমন কিছু পাওয়া গেলোনা।
চিঠি
স্নেহাশীষ শান্তি রাম,
আশা করি সুস্থ আছো।
অনেক কষ্ট করে তোমার ঠিকানা জোগাড় করলাম । তোমার সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। আমার পক্ষে তোমার কাছে যাওয়া কষ্টসাধ্য।তাই তুমি এলে আমার পক্ষে ভালো হয়। এছাড়াও আমি চাই তুমি ফিরে আসো। কমল বড় হয়েছে এবং সে দেখতে পুরো তার মায়ের মতো। তোমারও বয়স হয়েছে। এখন নিজের সন্তানকে নিয়ে বাকি জীবন টা সুখে কাটানোর চেষ্টা করো।আমি কমলকে বুঝিয়ে বললে সে নিশ্চয়ই তোমাকে মেনে নেবে। কমল আমার কথা ফেলবে না।
ইতি
রণপ্রসাদ দত্ত
চিঠি বিশ্লেষণ করে বোঝা যাচ্ছে শান্তি রামকে উনি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজেই ডেকে পাঠিয়েছেন। এমন কোনো কথা ছিলো তার সাথে যা বলার জন্য শান্তি রাম না আসলেও তিনি নিজে চলে যেতেন তার কাছে। "তুমি এলে আমার পক্ষে ভালো হয়" বাক্যটা পড়লেই তা স্পষ্ট হয়।
ব্যাক্তিত্ত্বসম্পন্ন এ লোকটা মারা গিয়েও কোথায় যেন বেঁচে আছেন। আস্তে আস্তে গল্প বলার মতো করে একের পর এক রহস্য ছুড়ে দিচ্ছেন নিজেকে ঘিরে।
ডায়রিটা টেবিলে রাখতে গিয়ে তার চোখ পড়ল কলমের দিকে। হত্যার অস্ত্র।
আচ্ছা, খুনি প্রসাদ বাবুকে কলম দিয়েই কেন হত্যা করল?
দুটো কারণ হতে পারে।
এক. যদি খুনটা পরিকল্পিত হয় তবে খুনি অনেক ভেবে চিন্তেই অস্ত্র সিলেক্ট করেছে। যাতে কেউ ধারনাও করতে না পারে হাতিয়ার হলো একটি কলম। এজন্য তাকে অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার ও প্রয়োজন নেই কারণ রণ বাবুর প্রায় প্রতিটি রুমেই কলম আছে।
দুই. খুনি খুন করার উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি। কথার এক পর্যায়ে সে রাগান্বিত হয়ে কলমটি তার গলায় ঢুকিয়ে দেয়।
জামশেদ হক দত্ত বাড়িতে এসেছেন।তবে এবার তিনি গেলেন মুকেশ বাবুর বাসায়।
আজ সোমবার, কমলের বর্ণনা অনুযায়ী এসময় শুধু মুকেশ বাবুর স্ত্রী, পুত্রবধূ আর নাতি থাকবে বাড়িতে। উনি দরজার কড়া নাড়লেন,
২২-২৩ বছরের এক তরুণী দরজা খুলে দিলো। মুকেশ বাবুর পুত্র বধূ।চেহারায় খুকি খুকি একটা ভাব আছে। থ্রিপিস/ফ্রক পড়ে বের হলে কেউ ধরতেই পারবে না এর একটা ফুটফুটে বাচ্চাও আছে। খুব সুন্দর চেহারা। চোখে মুখে কোথাও একটা স্নিগ্ধ ভাব লেগে আছে।
জামশেদ সাহেবকে পরিচয় দিতে হয়নি।মেয়েটা তার আগেই বলল,
স্যার,আপনি ভিতরে আসুন।
জামশেদ সাহেব বসার ঘরে ঢুকলেন। বেশ গোছানো ও পরিপাটি বসার রুম।
—বসুন। বাবা বাসায় নেই।মা আর আমি আছি। আপনি কি আমাদের সাথে কথা বলার জন্য এসেছেন?
—হ্যাঁ।
—আপনি তাহলে বসুন আমি চা নিয়ে আসি।
জামশেদ সাহেব চা লাগবেনা বলতে গিয়েও কিছু বললেন না।
মেয়েটি চা আনতে চলে গেলো। জামশেদ সাহেব কতক্ষণ বসে থেকে রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। রুমের এক মাথায় গোল করে বসানো সোফা। অপর মাথায় একটা লম্বা টেবিল ৪/৫ টা চেয়ার ঘিরে রেখেছে।পাশেই বইয়ের সেলফ। সেটিং দেখে মনে হচ্ছে এখানে হয়ত বাচ্চাদের পড়াতেন মুকেশ বাবু। জামশেদ সাহেব ড্রইং রুমটা ঘুরে দেখতে লাগলেন। টেবিলের উপর একটা ছোট নোটবুক রাখা আছে। নোটবুকটা দিয়ে মূলত একটা ফাইল চাপা দেয়া আছে। কৌতুহলবসত নোটবুক হাতে নিলেন তিনি। সাদা রঙের ফাইলের ভিতর একটা ছবি দেখা যাচ্ছে।বেশ সাদা কাল ছবি। চেহারার গড়ণ দেখে মনে হচ্ছে এটা মুকেশ বাবু। নোটবুকে তেমন কিছু নেই। মাসিক খরচের হিসেব। কোথাও টেলিফোন নাম্বর নোট করা।ইত্যাদি দৈনিন্দন কাজের নোটবুক।
জামশেদ সাহেব বইয়ের শেলফ এর দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রায় সব রকম বই একটা দুটো করে আছে।কবিতা,ছোটগল্প,থ্রিলার,ভূগোল,আইন,জ্যোতিষবিদ্যা,গোয়েন্দাগল্প
—স্যার, চা নিন।
জামশেদ সাহেব চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলেন
—তোমার নাম কি?
—মৌমিতা। বাসায় সবাই মৌ বলে ডাকে।
—তোমার একটা ছেলে আছে তাইনা?
—জ্বি।
—কোথায় ও?
—ঘুমোচ্ছে।
টেবিলের উপর রাখা কাগজ গুলো কার?
মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলল।
বাবার কাগজ ওগুলো।সকালে তড়িঘড়ি করে গোছালেন কিন্তু এখন নিতে ভুলে গেছেন।
ফাইলের ভেতরের ছবিটা কার? মুকেশ বাবুর?
জ্বি। ।
মৌমিতা ওরফ মৌ টুকটাক এটা সেটা কথা বলে যাচ্ছে।
মেয়েটি কথা বলতে বেশ পছন্দ করে বলে মনে হচ্ছে।।এমন মেয়ে কেন শাশুড়ীর মতো ঘরকুনো হয়ে থাকবে?সে বিকালে বের হবে। প্রতিবেশীর সাথে আড্ডা দিবে , গল্প করবে।
—আপনার শাশুড়ী কে দেখছিনা। উনি কি বের হন না?
—তেমন একটা না। মায়ের পায়ে ব্যাথা। হাঁটতে কষ্ট হয় । আজ সকাল থেকেই বাবু বায়না ধরেছে ছাদে যাবে। আমি নিয়ে যেতে চাইলেও সে আমার সাথে যাবেনা। সে যাবে তার দিদার সাথে। ওর দিদা যতই বলছে আমি সিড়ি ভাঙতে পারিনা ও ততই বলছে না তুমি পারো। সকাল থেকে এ নিয়ে প্রচুর বিরক্ত করেছে। পরে এক ধমক দেয়ায় কান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
—আমি কি মা কে ডেকে দিব? আপনি কথা বলবেন?
—না। আমি আজ উঠি।
জামশেদ হক থানায় ফিরে এলেন। তিনি এখানে এসেছেন অল্প কিছুদিন।এ থানায় কি কি কেস এসেছিলো সে ব্যাপারে একটা নূন্যতম আইডিয়া থাকাটা জরুরি। এ এলাকার সব কিছু একটু বেশিই সহজ সরল। কোথাও কোনো অসুবিধা নেই। এটাই বড় অসুবিধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন।
জামশেদ সাহেব একটানা দুপুর ১টা অব্দি প্রায় ৮০-৯০ টার মতো কেস ফাইল দেখে ফেললেন । কোনোটাই তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হলোনা। তিনি এক কাপ চা দিতে বললেন কন্সটেবল রশিদকে।
একটা ক্লু খুবই জরুরি।
একটু পরেই রশিদ চা নিয়ে হাজির। জামশেদ সাহেব রশিদ কে জিজ্ঞেস করলেন,
—রশিদ, তুমি কত বছর চাকরি করছো এখানে?
—৭ বছর স্যার।
—হুম। এ সাত বছরে এমন কোনো কেসের কথা কি তোমার মনে পড়ে যার সাথে রণবাবুর নূন্যতম যোগসূত্র থাকতে পারে ?
—না স্যার তেমন তো কোনো কেস নেই।রণবাবু চুপচাপ ধরনের মানুষ। আর উনি ওকালতি ছেড়েছেন ও বহু বছর হলো।
—একটু ভেবে বলো রশিদ। আমাদের খুব দ্রুত একটা ক্লু খুঁজে বের করতে হবে।
—স্যার আমার আগে আমার বাবা এই পোস্টে জব করেছেন। তিনি একটা কেসের তদন্তের সময় দূর্ঘটনায় মারা যান। তার পোস্টে চাকরিটা আমি পেয়ে যাই। আব্বা একটা কেসের কথা বলতেন যেটা কোর্ট অব্দি গড়ায়। আর সেই কেস লড়েছিলেন রণবাবু স্বয়ং ।খুনের কেস। আসামীর তাতে ফাঁসি হয়েছিলো।
—কোন কেস কত সালের কোনো আইডিয়া আছে তোমার?
—অনেক আগের কেস স্যার তা প্রায় ২৫-৩০ বছর আগের। পুরনো কেস। ফাইল খুঁজে বের করতে সময় লাগবে।
—দ্রুত। খুব দ্রুত কাজ করতে হবে রশিদ।তুমি এখনই ফাইলটা নিয়ে আসো।
জামশেদ সাহেব এই কেসের ব্যাপারে জানতে কল দিলেন প্রীতম বাবু কাছে। ক্ষীণ আশা আছে তিনি হয়তো জানবেন এ ব্যাপারে কিছু।
প্রীতম দত্ত কল ধরলের। কথা বলে যা জানা গেল তার সারমর্ম এই যে,
তিনি ছোট থাকতেই তার বাবা পেশাদারী ওকালতি ছেড়ে দেন। মায়ের কাছ থেকে যা শুনেছেন তাতে ঐ কেসের পরেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিজে কেসটির ব্যাপারে কিছু না জানলেও লাইব্রেরি রুমে রণবাবুর কেস সংক্রান্ত কিছু ফাইল আছে। সেগুলোতে হয়তো কিছু পাওয়া যাবে।
জামশেদ হক ফাইল গুলো পাঠাতে বললেন