মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ। আমরা আশা করেছিলাম অন্তত এই একটা জায়গায় দেশের মানুষ একতাবদ্ধ থাকবে। কোনো দ্বিমত পোষণ করবে না। কিন্তু গেল তিপ্পান্ন বছরেও তা হলো না। যখন যে সরকার ক্ষমতায় যায় ঠিক তাদের মতো করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বয়ান তৈরি করে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে মেজর জিয়াউর রহমান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ শুরু হয়। আর আওয়ামী লীগের তো কথাই নেই। তাদের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বেসর্বা। সেখানে মাওলানা ভাসানী, শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ, বীরোত্তম জিয়াউর রহমান, কর্ণেল এমএজি ওসমানী কিংবা সাত বীরশ্রেষ্ঠ'র নামনিশানাও থাকে না। এই যে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিখণ্ডিত বয়ান কার্যত এটিই তরুণপ্রজন্মকে একাত্তর বিষয়ে ভিন্নতর ও বিকৃত ভাবনার সুযোগ করে দিয়েছে। অন্যত্র বহুত্ববাদী চিন্তাকে স্বাগত জানানো যায়, সেটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি; কিন্তু দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও দেশপ্রেমের প্রশ্নে দ্বিখণ্ডিত চিন্তার এতটুকু সুযোগ নেই।
শেষ ১৫ বছরের অধিককাল আওয়ামী লীগ দেশ শাসন করেছে। ওয়ান ইলেভেনের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ এর জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা খুব কম। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে ক্ষমতাসীন হয়। তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা, সুশাসন নিশ্চিত করা এবং সবার সুন্দর সহাবস্থানের সংস্কৃতি তৈরি করা। কিন্তু তারা ক্ষমতা পেয়ে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করল, অন্যরা তাদের নির্বাচন কমিশনকে আর আস্থায় নিল না। খুব মজা পেয়ে গেল আওয়ামী লীগ। গত তিন নির্বাচনে কখনো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কখনো রাত, কখনো বা ডামি; এইসব বিচিত্র পদ্ধতির নির্বাচন দিয়ে নিজেরা নিজেরাই ফাঁকা মাঠে গোল দিতে থাকল। এই সুযোগে আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে দলীয় ন্যারেটিভে গিলে নিয়ে দুনিয়ার আর সবার অবদান ভুলে গেল। তাদের বয়ানে তারাই যেহেতু একা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তাই দেশটা তাদের পিতৃপুরুষের তাল্লুক হয়ে উঠল। যেই দেশের অর্থ পাচার করে রিজার্ভ খালি করে দেয়া যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের নামে দস্যু প্রবৃত্তি, লুটপাট, লোকঠকানো, ভিন্নমতের দমন-পীড়নকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করে ফেলা যায়।
অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধে যার যার ভূমিকাকে যদি সমান মর্যাদা দেয়া যেতো বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা এই অমোঘ সত্যটি কেউ অস্বীকার করত না। আওয়ামী লীগের বেশি কিছু লাগত না, তারা যদি মেজর জিয়াকে আইএসআই'র চর সাব্যস্ত না করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষক মেনে নিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐকতান অন্যরকম হতে পারত। ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। আপনি যখন 'জেড' ফোর্সের অধিনায়ক বীরোত্তম জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বী ঘোষণা করবেন, একচ্ছত্রভাবে বঙ্গবন্ধুকে মহিমান্বিত করবার ন্যারেটিভ কোনোদিনই মেনে নেয়ার দায় বিএনপির আর থাকে না। অথচ দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত। আমরা মনে করি ৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ যেহেতু ঐতিহ্যবাহী ও স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বে দেয়া দল, কাজেই তাদের দায়ভার বিএনপির চেয়ে বহুগুণ বেশি। কিন্তু অনুদার আওয়ামী লীগ একা নিজেরে গৌরব দান করতে গিয়ে নিজেকেই আজ অপমানের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। তারা কখনোই রবিঠাকুরের গীতাঞ্জলিতে চোখ রাখেনি, 'নিজেরে করিতে গৌরব দান/ নিজেরে কেবলি করি অপমান,/ আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে।
বাংলাদেশে একটা নির্দিষ্ট দলের প্রতি এতটা যূথবদ্ধ ঘৃণা এর আগে দেখা যায়নি। সব রাজনৈতিক দল একজোট হয়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে এখন।
বস্তুত বাংলাদেশের দলদাস লেখকদের বই কিংবা যখন যে সরকার ক্ষমতাসীন তাদের মনমতো পাঠ্যপুস্তক দিয়ে স্বাধীনতার ইতিহাস পাঠ আর চলবে না। বৈশ্বিক নির্মোহ ইতিহাসবিদ, লেখক, সাংবাদিক ও পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির রাষ্ট্রগুলোর মহাফেজ খানায় সংরক্ষিত একাত্তরের দলিলদস্তাবেজের সাক্ষ্য মানতে হবে।
এতগুলো কথার অবতারণা করতে হলো বিশেষ একটি পয়েন্টে আলোকপাত করতে।
প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, 'স্বামীর কবরে শায়িত মতিয়া চৌধুরী, পেলেন না মুক্তিযোদ্ধার অন্তিম সম্মান'!
অপরদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বাধার কারণে টাঙ্গাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একুশে পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান খান ফারুককে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেওয়া হয়নি। ফলে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ছাড়াই তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
কারা মুক্তিযোদ্ধা? এটা নিয়ে আওয়ামী বয়ানে বিস্তর ধোঁয়াশা আছে। এমনকি তাদের সরকারের আমলে একাত্তরের পরে জন্ম নেয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্ধানও মিলেছিল। কিন্তু মতিয়া চৌধুরী ও ফজলুর রহমান খান আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও তারা মুক্তিযোদ্ধা নন এমন প্রমাণ কেউ দেয়নি। তারপরও রাষ্ট্রীয় আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও কেন এই দুই মুক্তিযোদ্ধা মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেলেন না? এটার একমাত্র কারণ হিসেবে ধরতে পারি গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষিতে যেই সরকার এখন দেশ শাসন করছে তারা আসলে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ নতুন করে তৈরি করতে চায়। সেখানে আওয়ামী লীগের অধীনস্থ থাকা মুক্তিযোদ্ধারা হয়ত ইউনূস সরকারের তালিকার বাইরে থাকবেন। আরেকটি কারণ হতে পারে গেল ১৫ বছরের অধিককাল আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তায়নের প্রত্যক্ষ সহযোগী তথা কোলাবোরেটর ছিলেন এই দুই মুক্তিযোদ্ধাও।
অপরদিকে রিসেট বাটন টেপা বাংলাদেশের নতুন হার্ডওয়্যারে মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুর নাম কাটা পড়ে অনেকগুলো ফাউন্ডিং ফাদারসে স্থিতি লাভ করেছে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর নামে মু্ক্তিযুদ্ধ করা বীরদের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তও ঘুরেফিরে ওই বঙ্গবন্ধুর প্রতি ট্রিটমেন্টের বাইরে হবে না হয়ত।
তাছাড়া এইসময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়াণকে নতুন সরকার দ্বারা মহিমান্বিত করবার বিষয়টি ওই মুক্তিযোদ্ধারা অন্তিম সম্মান 'আদৌ নিতে চাইতেন কিনা' জাতীয় নিক্তি দিয়ে মাপতে হবে। তাহলে সমালোচনার পক্ষে একটি মানানসই গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে দেয়া যাবে।
এই প্রসঙ্গে ভিন্ন একটি আলাপও এখন জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের প্রধান ছাত্রনেতা হিসেবে স্বীকৃত প্রবাদপুরুষ আবদুল মতিন ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ভাষা মতিনকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়নি। কী বিস্ময়কর বিভাজনের রাজনীতি করেছে আওয়ামী লীগ? তাদের দলের অঙ্গীভূত না থাকলে তারা যেন মানুষ পদবাচ্যে বিবেচিত হওয়ারই যোগ্য হতেন না!
১৯৪৮ সালের প্রথম ভাষা আন্দোলনের সময়েই ২৪ মার্চের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের কনভোকেশনের ভাষণে পাকিস্তানের বড় লাট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হবে, কথাটা উচ্চারণের পর পর মতিনের কণ্ঠ থেকেই প্রথম উচ্চকণ্ঠের প্রতিবাদ ‘নো নো’ ধ্বনিত হয়েছিল।
প্রথম আলো জানাচ্ছে, ভাষা–মতিন হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সত্ত্বেও মতিন এ দেশের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের একজন অগ্রনায়ক ছিলেন, সে জন্য তাঁর রাজনৈতিক সাথিদের কাছে তিনি ছিলেন কমরেড আবদুল মতিন। ভাষা আন্দোলনের পরের বছর মতিন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে কৃষকদের সংগঠিত করার সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ষাটের দশকের শেষের দিকের ‘লালটুপি’ কৃষক আন্দোলনেরও প্রাণপুরুষ ছিলেন মতিন।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম প্রথম আলোতে 'ভাষা-মতিন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেলেন না, রাষ্ট্রটি কার?' শীর্ষক আর্টিকেলে লিখেছেন, ভারতের নকশালবাড়ী আন্দোলনের চরমপন্থী কৌশল দ্বারা প্রভাবিত মতিন-আলাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী গ্রুপের তৎপরতা স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারের জন্যও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে ১৯৭২ সালেই মতিন গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন প্রায় চার বছর, ১৯৭৬ সালে তিনি মুক্তি পান। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ভাঙা-গড়ার আত্মঘাতী ধারাবাহিকতায় গুরুত্ব হারালেও সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার থেকে কখনোই বিচ্যুত হননি মতিন।
কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিরোধের কারণটাকেই শেখ হাসিনা সরকার বিয়াল্লিশ বছর ধরে নিজেদের মগজে ঝুলিয়ে রেখেছিল। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম অবিসংবাদিত নেতা ২০১৪ সালে প্রয়াতে হলে শেখ হাসিনা সরকার এই মহান মানুষটির নাম নিতে ভুলে যান। ২১ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে ভাষা মতিনের স্মরণসভায় আরেক ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক বলেছিলেন, 'ভাষা মতিনকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয়নি, তাতে তার কিছুই যায় আসে না। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হবে, এই আন্দোলন না হলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না। আর মুক্তিযুদ্ধ না হলে বাঙালি জাতি দাসে পরিণত হতো।'
আবদুল মতিন জাতির সঙ্গে কিংবা মেহনতি জনগণের সঙ্গে কখনোই প্রতারণা বা বেইমানি করেননি। অপরাপর আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির সুযোগ নিয়ে দুর্বৃত্তায়নের পথে হাঁটেননি। এই জাতিকে সারা জীবন শুধু দিয়েই গেছেন, কিছুই নেননি। লোভের কাছে কখনোই পরাস্ত হননি। এমনকি ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুর পরও নিজের দেহ ও চোখ দুটোকে পর্যন্ত দান করে দিয়ে গেছেন মানবকল্যাণে।
এমন এক মহান মানুষকে অন্তিম সম্মান জানাননি শেখ হাসিনা। এখন তাঁর দলের লোক হয়ে ভিন্নমতাদর্শী সরকারের কাছ থেকে মারা যাওয়ার পর আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করা কি আর আদৌ সাজবে?
বরগুনা-২ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী সগীর হোসেন লিয়নকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার। এটা নিয়ে আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে প্রতিবাদী পোস্ট দিয়ে বলা হয়েছে, তাদের তথাকথিত নতুন বাংলাদেশ কি আসলেই সাম্যের কথা বলে?
এর নিচে একজন ফলোয়ার লিখেছেন, 'তাদেরকে অভিনন্দিত করুন। তারা তো আপনাদের দেখানো পথই অনুসরণ করছে।'
লেখক: সাংবাদিক
২০ অক্টোবর ২০২৪