১৯৪৮ সালে প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধের প্রায় ৫০ বছর আগে থেকে প্যালেস্টাইনের ভূমি দখল ও ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীল নকশা করা হয়েছিল। মূলত ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে প্যালেস্টাইনের ভূমি দখলের সমস্ত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের রুপকার যে ইহুদীরা তাদেরকে জায়োনিস্ট বলে। জায়োনিজম শব্দটা এসেছে জায়োন থেকে। জায়োন বা সিওন হলো জেরুজালেমের একটি টিলা, বাইতুল মুকাদ্দাস যে টেম্পল মাউন্টে অবস্থিত তারই দক্ষিণ অংশ। এ জায়গাটা জেরুজালেমের পবিত্রতম জায়গা বিধায় জায়ন শব্দ দিয়েই জেরুজালেম বা সিটি অফ ডেভিড(দাউদ নবী) বোঝানো হয়। এক্ষেত্রে জায়োনিজম আন্দোলন হলো ‘জায়ন’ বা ইহুদীদের ‘জেরুজালেম’ পুনরুদ্ধার আন্দোলন, বৃহত্তর অর্থে পুরো পবিত্র ভূমি অধিকার করে নেয়া। উনিশ শতকের শেষ দিকে শুরু হওয়া এ জায়োনিজমের বাস্তবিক প্রয়োগ আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি কথিত ইসরাইল রাষ্ট্রের বিতর্কিত কাজকর্মের মধ্য দিয়ে।
পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন
ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশের একটি ভূখণ্ড, যা ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝে অবস্থিত। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের জন্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অবস্থানে রয়েছে ফিলিস্তিন। এটি ইহুদি ধর্ম ও খ্রিস্ট ধর্মের জন্মস্থান। ফিলিস্তিন অঞ্চলটি পৃথিবীর প্রাচীন অঞ্চলগুলোর একটি যেখানে মানুষের বসবাস, কৃষিনির্ভর জনসমষ্টি এবং সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। ব্রোঞ্জ যুগের প্রথম ও মধ্যভাগে স্বাধীন কেনানীয় নগর-রাষ্ট্রগুলো গড়ে উঠেছিল এবং প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমিয়া, ফোয়েনেশিয়া, মাইনোয়ান ক্রিট, এবং সিরিয়ায় গড়ে ওঠা সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। প্রায় ৬ হাজার বছর পূর্বে কেন’আনীদের ইয়াবুসী গোত্রের লোকেরা সেখানে বসবাস করেছিল। তারা কুদস তথা জেরুজালেমে বসতি গড়ে তৎকালীন সময় যা ইয়াবুস নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে বহু কেন’আনী গোত্র ফিলিস্তিনের উত্তরাঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। ফলে ইতিহাসে এই দেশ কেন’আন দেশ নামে পরিচিতি লাভ করে। আর ধারনা করা হয় ফিলিস্তিন নামটি এসেছে বিলিস্তা গোত্রের নামানুসারে যারা সমুদ্রপথে এই অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং স্থানীয়দের সাথে মিশে যায়। ভৌগলিক অবস্থান ও দুটি প্রধান ধর্মের সূতিকাগার হওয়ায় স্বভাবতই ফিলিস্তিন নামক ভূখণ্ডটির রয়েছে ধর্ম, সংস্কৃতি, বাণিজ্য ও রাজনীতির এক দীর্ঘ ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইতিহাস। আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের সম্পূর্ণ ভূ-খণ্ড বা এর কোন কোন অংশ বিভিন্ন রকমের মানুষদের দ্বারা পরিচালিত ও শাসিত হয়েছে। এদের মধ্যে আছে- কেনানীয়, আমরীয়, প্রাচীন মিশরীয়, ইসরায়েল বংশের ইহুদি, ব্যাবিলনীয়, পারস্য, প্রাচীন গ্রিক, রোমান, বাইজেন্টাইনীয়, খ্রিস্টান Crusader বা ধর্মযোদ্ধাগণ, এবং ৬৩৬ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত এগারশ বছর মুসলিম খিলাফাত (যেমনঃ আইয়ুবি, মামলুক, উসমানীয় সাম্রাজ্য প্রভৃতি) দ্বারা শাসিত হয়েছে। সর্বশেষ ব্রিটিশ, জর্ডানি (পশিম তীরের অংশটুকু), মিশরীয় (গাজা অঞ্চল), এবং হাল আমলের ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি সহ এরকম বহু জাতি ও অঞ্চলের শাসকবর্গ এই ভুখন্ডটি শাসন করেছেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময় পর্যন্ত প্যালেস্টাইন এলাকা ছিল তুরস্কের উসমানিয় বা অটোমান সুলতানদের শাসনাধীন। যুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আরবদের একটা ফাদে ফেলে। তারা প্রতিজ্ঞা করেছিল তুরস্কের সুলতানের বিরুদ্ধে আরবরা বিদ্রোহ করলে প্যালেস্টাইনসহ যে সমস্ত আরব এলাকা তুর্কি শাসনাধীন ছিল সেগুলো স্বাধীনতা লাভ করবে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের পর আরবেরা তুর্কি শাসনের কবল থেকে বেরিয়ে এলেও ১৯২০ সালের লীগ অব নেশনসের ম্যান্ডেট অনুযায়ী এই এলাকা ব্রিটিশ শাসনাধীনই রয়ে যায়।
কিতাবপ্রাপ্ত তিন ধর্মের অনুসারীদের তীর্থ জেরুজালেম
প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন অঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক পবিত্র শহর জেরুজালেম। এই নগরীর নিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে আছে নানা বিতর্ক; আছে দফায় দফায় দখল, পুনর্দখল, ধ্বংস আর পুনর্নির্মাণের রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। এই শহরকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় দেওয়া হয়েছে 'ওল্ড সিটি'র খেতাব। ৬ই ডিসেম্বর, ২০১৭ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পূর্ণ জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ৷ তিনটি Abrahamic Religion এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ শহর এই জেরুজালেম। ইব্রাহিমীয় ধর্ম বা আব্রাহামিক ধর্ম (Abrahamic Religion) বলতে একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোকে বোঝানো হয়।
মুসলিম: আল-আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস ইসলামের ৩য় গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনার যায়গা। মুসলিমদের প্রথম কিবলা আল-আকসা। লাইলাতুল মেরাজের রাতে এখান থেকেই মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) আল্লাহর দিদারে যাত্রা করেছিলেন।
ইহুদি: ইহুদিদের পবিত্র ভূমিখ্যাত ‘টেম্পল মাউন্ট’ বা ‘ঈশ্বরের ঘর’, যা মুসলিমদের কাছে পবিত্র কুব্বাত আস-সাখরা’। টেম্পল মাউন্টকে ঘিরে থাকা ‘ওয়েস্টার্ন ওয়াল’ বা পশ্চিমের দেয়াল ইহুদিদের কাছে ‘পৃথিবীর ভিত্তিপ্রস্তর’ হিসেবে স্বীকৃত। এখানে লাখো ইহুদি নিয়মিত প্রার্থনায় অংশ নেন।
খ্রিস্টান: যিশু খ্রিস্টের স্মৃতিবিজড়িত গির্জার কারণে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছেও পবিত্রতার দিক থেকে সমান গুরুত্বপূর্ণ জেরুজালেম। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, এখানেই ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল যিশুকে।