আওয়ামী লীগ আমাদেরকে একটা জিনিস খুব ভালো শিখিয়ে গিয়েছিল। কিভাবে শিষ্টের দমন আর দুষ্টের পালন করতে হয়। কল্পনাও করিনি গণ-আন্দোলনে পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার দেখানো পথটাকে নিজেদের দিশা হিসেবে গ্রহণ করবে!
বাঙালির একটা বিশ্রী স্বভাব আছে। নিজেদেরকে বিতর্কিত না করলে এদের পেটের ভাত হজম হয় না। পত্রিকায় দেখেছেন নিশ্চয়ই কোনো এক পতিত পাবন মন খারাপ হলেই অন্যের সম্পত্তি দখলে নিতেন। তা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের মনটা খারাপ কীসে হয়েছে যে, জেড আই খান পান্নার মতো অশীতিপর আইনজীবীর সম্মান লুটপাট করতে হবে?
জুলাই আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রবীণ এই আইনজীবি ছাত্রদের সাথেই ছিলেন। এখন মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে সরকারি অবস্থানের সমালোচনা করায় তাঁকে কিনা করা হয়েছে হত্যা মামলার আসামি। তবে মিস্টার পান্না কিছুটা মনক্ষুন্ন হয়েছেন এজন্য যে, মামলায় তাঁকে ৯৪ নম্বর আসামি করা হয়েছে। তাঁর দাবি, ‘দেবেন যখন এক নম্বর আসামী দেন। ৯৪ নম্বর আসামী হওয়া আমার জন্য কিছুটা অসম্মানজনক বটে।’
জুলাই আন্দোলনের সময় গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুন অর রশিদের তথাকথিত ভাতের হোটেলে যখন ছয় সমন্বয়ককে আটকে রাখা হয়েছিলো তখন রিট করেছিলেন জেড আই খান পান্না।
২৯ জুলাই বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘দূরবস্থা’ উল্লেখ করে উচ্চ আদালতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সবার জীবনের নিরাপত্তার জন্য রিট করা হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন সিনিয়র আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী জেড আই খান পান্না। সেসময় তিনি বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম দিয়ে যে কার্যকলাপ হচ্ছে তা মেনে নেওয়া যায় না। আমি যদি দেখতাম ছাত্ররা নিরাপদে ঘুরতে পারতেছে, স্কুল–কলেজে যেতে পারতেছে, তাহলে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। আপত্তি হলো রাতে যখন ব্লক রেইড দেয় একেকটা এলাকায়, ৭১ সালে যেমন হয়েছিল।
সর্বোতভাবে জুলাই আন্দোলনে মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলা মানুষটির বিরুদ্ধে কিনা দেয়া হলো হত্যাচেষ্টা মামলা। মিথ্যাচারেরও তো একটা লিমিট থাকে। ড. আসিফ নজরুলের আইন মন্ত্রণালয় কিংবা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সভ্যতা ও ভব্যতার সমস্ত লিমিট ক্রস করে ফেলেছে।
জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে ভিন্নমত থাকলে এইদেশে কেউ কখনোই নিরাপদ না। যে মানুষটি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পক্ষে নিজের সর্বস্ব পেশাদারিত্ব ঢেলে দিয়েছিলেন, সরকারি দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে মানবাধিকার রক্ষার সরব ছিলেন, উল্টো তাঁর দিকেই কিনা তীর ছুড়ে দেয়া হলো।
মিস্টার পান্না সাবেক সরকারের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ সমস্ত কালো আইন ও অপশাসনের বিরোধিতা করেছেন। এমন এক মানুষকেই কিনা শেখ হাসিনা সরকারে কোর্টে ঠেলে স্রেফ ফাঁসানোর মানসিকতা থেকে মামলায় জড়ানো হলো। খুব স্বাভাবিকভাবেই জেড আই খান পান্নার বিরুদ্ধে এ মামলাকে 'অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত ও নিন্দনীয় বলেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে ৬ সমন্বয়কের পক্ষে দাঁড়িয়ে রিট করেছিলেন মিস্টার পান্না তাদের তরফে কোনো আওয়াজ শব্দ পাওয়া গেল না। সমাজ সংসার থেকে কৃতজ্ঞতা বোধ কোথায় হারিয়ে গেল? কেন এই পরগণায় শুভবোধ ফেরে না?
লেখক: সাংবাদিক
২০ অক্টোবর ২০২৪