পোস্টস

গল্প

বাঁশি ওয়ালা

২২ অক্টোবর ২০২৪

Rouf An Nur

গভীর রাতে যখন পুরো শহর ঘুমিয়ে, তখনই বাজে বাশির সুর। কেউ জানে না কে বাজায়, কোথা থেকে আসে এই সুর, কিন্তু প্রতিদিন রাত ঠিক বারোটার সময় বাশির মিষ্টি ধ্বনি বাতাসে ভেসে আসে। সেই সুর যেন কারও না বলা ব্যথা, কারও ফেলে আসা অতীতের কথা বলে।

শহরের মানুষ তাকে বলে "বাশি অয়ালা"। কেউ তাকে দেখেনি, কেউ জানে না তার পরিচয়। শুধু সুর শুনেই মানুষ তার কল্পনা আঁকে। কেউ বলে, সে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক, কেউ বলে, সে কোনো প্রাচীন রাজ্যের যোদ্ধা, যার সঙ্গী সবাই মরে গেছে। আর তাই সে বাশি বাজিয়ে তার শূন্যতা প্রকাশ করে।

ছোট্ট ছেলে রাহুল ছিল খুব কৌতূহলী। সে প্রতিদিন রাতে বারোটার সময় জানালার পাশে বসে বাশি অয়ালার সুর শুনত। এক রাতে সে সিদ্ধান্ত নিল, আজ সে বাশি অয়ালাকে খুঁজে বের করবে। সে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল, বাতাসে বাশির সুর আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। সুর তাকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে টানছিল।

রাহুল হাঁটতে হাঁটতে শহরের প্রান্তে এসে পৌঁছল, যেখানে পুরোনো একটা বটগাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছের নিচে একটা ছায়ামূর্তি বসে বাশি বাজাচ্ছে। রাহুল চোখ কচলিয়ে ভালো করে দেখল। মূর্তিটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল—একজন বৃদ্ধ, তার চোখে গভীর বিষাদ। তিনি বাশি বাজানো বন্ধ করলেন এবং রাহুলের দিকে তাকালেন।

"তুমি কেন এসেছো, বাচ্চা?" বৃদ্ধের কণ্ঠ ছিল বিষণ্ণ, কিন্তু কোমল।

রাহুল জবাব দিল, "আমি প্রতিদিন আপনার বাশি শুনি, কিন্তু আপনাকে কখনো দেখি না। আপনি কে? কেন আপনি প্রতিদিন বাশি বাজান?"

বৃদ্ধ একটুখানি হাসলেন। "আমি বাশি অয়ালা। অনেক দিন আগে, এই শহর ছিল আমার। আমি ছিলাম একজন সঙ্গীত শিক্ষক। আমার স্ত্রীও সঙ্গীতের মানুষ ছিল। কিন্তু একদিন সে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। তারপর থেকে আমি এই শহরে তার জন্য বাশি বাজাই, যেন তার আত্মা আমার সুর শুনে শান্তি পায়।"

রাহুল অবাক হয়ে শুনছিল। "আপনার স্ত্রী কি আপনার সুর শুনতে পান?"

বৃদ্ধের চোখ ভিজে উঠল। "হয়তো পায়, হয়তো পায় না। কিন্তু আমি বাজিয়ে যাই। এটা আমার প্রার্থনা, আমার ভালোবাসা।"

রাহুল ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, বাশি অয়ালার সুর কেবল সঙ্গীত নয়, তা ছিল ভালোবাসার এক অনন্ত স্মৃতিচিহ্ন। সে সেদিন রাতে বুঝল, কিছু সুরের কোনও শেষ নেই, তারা চিরকাল হৃদয়ে থেকে যায়।

রাত গভীর হলো, রাহুল ধীরে ধীরে ফিরে গেল তার ঘরে, আর বৃদ্ধ আবার বাশি তুলল ঠোঁটে। সেই রাতের পর রাহুল জানত, যখনই বাশির সুর ভেসে আসবে, সেটা শুধু সুর নয়, বরং বাশি অয়ালার হারানো ভালোবাসার কথা।