ইহুদীরা ফিলিস্তিন ভূমিকে তাদের Promised Land বলে থাকে। তারা বিশ্বাস করে স্বয়ং ঈশ্বর তাদেরকে ফিলিস্তিন ভূমি দান করেছেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে ইহুদীদের স্থায়ী কোন বসতভিটা ছিল না, তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত কিতাবেও এই কথার সত্যতা মিলে। আর ইহুদীরা অন্যদের সাথেও মিলে মিশে বসবাস করতে পারেনি। ফিলিস্তিন ভূমির সাথে ইহুদীদের সম্পর্ক বুঝতে হলে আমাদেরকে ইতিহাসের অনেক পেছন থেকে জানতে হবে। তা নাহলে আমরা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের মূল কারণ অনুধাবন করতে পারবোনা। এমনিতেই বাংলাদেশের মানুষ ইহুদীদের সম্পর্কে খুব কমই জানে। আমাদের বেশিরভাগ মানুষের মনে তাই এরকম প্রশ্ন জাগে-------
ইহুদি কারা?
ইহুদী কি ধর্ম না কোন জাতি?
পৃথিবীতে যে ধর্মগুলো এখন আছে সেগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ঐশ্বরিক বা আসমানি ধর্ম এবং লৌকিক ধর্ম। ঐশ্বরিক বা আসমানি ধর্মগুলো মূলত একেশ্বরবাদী ও আসমানি কিতাব ভিত্তিক ধর্ম। আসমানি কিতাব হল ঈশ্বর প্রেরিত ধর্মগ্রন্থ। আর লৌকিক ধর্মগুলো হল বহু ঈশ্বরবাদ কিংবা প্রকৃতিবাদ ধর্ম। ইব্রাহিমীয় বা আব্রাহামিক ধর্ম (Abrahamic Religion) বলতে একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোকেই বোঝানো হয়।এই ধর্মগুলো হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর বংশ থেকে আগত রাসুলগণ প্রচার করেছেন যেগুলোর মধ্যে আব্রাহাম বা ইব্রাহিম নবীর ধর্মীয় মতবাদের ধারাবাহিকতা ছিলো। ইহুদীরা হযরত ইব্রাহিম (আ.) থেকে তাদের বংশ পরম্পরা হিসেব করে থাকে। হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর দুই পুত্র ছিলো। তারা হলেন----
=> হযরত ইসমাঈল (আ.) ইবরাহিম (আ.)-এর ২য় স্ত্রী বিবি হাজেরা-এর গর্ভে ইসমাঈল (আ.)-এর জন্ম হয়। তিনি পবিত্র কাবাঘর নির্মাণে পিতাকে সাহায্য করেন। ইসমাঈল (আ.)-কে আরবদের জাতির পিতা বলা হয়। তাঁর বংশধররা আরবসভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বংশধর ছিলেন।
=> হযরত ইসহাক (আ.) ইবরাহিম (আ.)-এর ১ম স্ত্রী বিবি সারাহ-এর গর্ভে ইসহাক (আ.)-এর জন্ম হয়। তাঁর বংশধরদের মধ্য থেকেই অধিকাংশ নবী ও রাসুলের আগমন ঘটে। তাদের বেশিরভাগই বনি ইসরাঈলের জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হন। তাদের ধারাক্রম এমন--ইয়াকুব (আ.), ইউসুফ (আ.), আইয়ুব (আ.), জুলকিফল (আ.), ইউনুস (আ.), মুসা (আ.), হারুন (আ.), খিজির (আ.), ইউশা ইবনে নুন (আ.), ইলিয়াস (আ.), দাউদ (আ.), সোলাইমান (আ.), জাকারিয়া (আ.), ইয়াহইয়া (আ.) ও ঈসা (আ.)।
হযরত ইসহাক (আ.) এর পুত্র হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর আরেক নাম ইসরাইল। ইসরাইল একটি সুরিয়ানি ভাষার শব্দ যার অর্থ আল্লাহর দাস। তার বংশধররাই ইতিহাসে বনি ইসরাইল নামে পরিচিত। অর্থাৎ বনী ইসরাইল হল ইব্রাহিম (আ.)-এর বংশধরদের একটি শাখা। এই বনী ইসরাইল থেকেই বেশিরভাগ নবীর আগমন ঘটেছে। হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর নবম পুত্র হযরত ইউসুফ (আ.) নিজেও নবী ছিলেন। আর দশম মানে সর্বকনিষ্ঠ পুত্রের নাম বেন ইয়ামিন। ইয়াকুব নবীর চতুর্থ পুত্রের নাম ছিল ইয়াহুদা। ইতিহাসবিদদের মতে এই চতুর্থ পুত্রের নামের অংশবিশেষ থেকেই ‘ইহুদি’ নামকরণ করা হয় (তাফসিরে মাওয়ারদি : ১/১৩১)। তবে বনি ইসরাইলকেই প্রচলিতভাবে ইহুদী বলা হয়।ইউসুফ নবী মিশরের বাদশাহর প্রধান উপদেষ্টা থাকাকালীন সময়ে বনী ইসরাইলকে ফিলিস্তিন থেকে মিশরে নিয়ে আসেন।
প্রকৃতপক্ষে ‘ইহুদী’ যতটা না ধর্ম পরিচয় তার চেয়ে বেশি বংশ কিংবা জাতিগত(Ethnicity) পরিচয়। অর্থাৎ ইহুদী মূলত একটি সম্প্রদায়ের নাম। একারণে একজন ইহুদী নাস্তিক হলেও যেহেতু তিনি ইসরাইলের বংশধর, সেহেতু তিনি জাতিগতভাবে ইহুদী নামেই পরিচিত হবেন। প্রচারকাল বিবেচনায় ঐশ্বরিক বা আসমানি ধর্ম গুলোর মধ্যে প্রাচীনতম হলো ইহুদী ধর্ম। হযরত মূসা (আ.) ছিলেন বনি ইসরাইলদের নিকট প্রথম প্রেরিত রাসুল। তার উপর আল্লাহ্ তাওরাত বা Torah কিতাব নাযিল করেন। ইহুদীরা এই তাওরাত কিতাবই অনুসরণ করে থাকে। এরপর আসে খৃষ্ট ধর্ম যা প্রচার করেন হযরত ঈসা (আ.)। খৃষ্টানরা তাকে যীশু বা জেসাস বলে থাকে। ঈসা নবীর উপর আল্লাহ্ ইঞ্জিল(Bible) কিতাব নাযিল করেন। এবং সবশেষে আসে ইসলাম ধর্ম যা প্রচার করেন শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। তাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য রাসুল হিসেবে প্রেরণ করা হয়। হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর উপর আল্লাহ্ পবিত্র কুরআন নাযিল করেন।
সবচেয়ে পুরনো আব্রাহামিক ধর্ম হলেও ইহুদীদের সংখ্যা খুবই কম। তবে যুক্তরাষ্ট্রে, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মত বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী দেশগুলোতে তাদের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ব্যাবসা-বাণিজ্য, সাহিত্য, চিকিৎসা সব ক্ষেত্রেই ইহুদীরা শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। ইতিহাসে দেখা যায় যুদ্ধ বিগ্রহ, জোড়পূর্বক বাস্তুচ্যূত, দাস হিসেবে বিক্রিসহ নানা কারণে ইহুদীরা ফিলিস্তিন থেকে ধীরে ধীরে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
ইসরাইল ন্যাশনাল নিউজ ডট কমেরসূত্র অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বে ইহুদী জনসংখ্যা ১ কোটি ৫২ লক্ষ। অর্থাৎ বিশ্ব জনসংখ্যার মাত্র ০.২ শতাংশ! এর মধ্যে প্রায় ৬৫ লক্ষ ইহুদী ইসরাইলে বাস করে যা দেশটির মোট জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ। আর বাকিরা ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকায় বসবাস করে। ভারতেও সামান্যসংখ্যক ইহুদির নিবাস রয়েছে।
ইহুদি জাতির যত সমালোচিত কর্মকান্ড
ইহুদী জাতির কুখ্যাত কর্মকান্ডের প্রসঙ্গ আসলেই ধর্মগ্রন্থের রেফারেন্স চলে আসে। কারন তাওরাত, বাইবেল আর পবিত্র কুরআনেই এসবের অধিকাংশ বর্ণিত আছে। আগেই বলা হয়েছিলো জন্মগতভাবে এই জাতি খুব চতুর প্রকৃতির হওয়ায় Conspiracy দক্ষতার মাধ্যমে তারা অন্যের ওপর দিয়ে যুগে যুগে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এসব চতুরতার কারণে তারা বিভিন্ন সময়ে বহু শাসকদের দ্বারা নির্যাতিত ও অপমানিত হয়েছে। এই কথার সত্যতা সামনের আলোচনা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। বাইবেল আর কোরআন শরিফের বহু জায়গায় এর বিশদ বর্ণনা এসেছে। পবিত্র কোরআন শরীফে তাদের অভিশপ্ত ও লাঞ্ছিত জাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-“তাদের ওপর আরোপ করা হলো লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা। তারা আল্লাহর রোষানলে পতিত হয়ে ঘুরতে থাকল। এ জন্য যে তারা আল্লাহর বিধানের সঙ্গে কুফরি করত এবং নবীদের অন্যায়ভাবে হত্যা করত। কারণ তারা ছিল নাফরমান ও সীমা লঙ্ঘনকারী।
(সুরা : বাকারা, আয়াত : ৬১)।
ইহুদি জাতিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি দুখ-কষ্ট ভোগ করেছেন হজরত মুসা (আ.)। তিনি বনী ইসরাইলের নিকট প্রেরিত গুরুত্বপূর্ণ নবীদের একজন। পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার শুরুর দিকে ইহুদি জাতির ওপর আল্লাহর রহমত এবং ১২টি কুকর্ম ও আল্লাহর পক্ষ থেকে এর শাস্তির বিবরণ রয়েছে। বনী ইসররাইলকে আল্লাহ মিসরের ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা করার পর মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে গমন করে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত আনার জন্য। সেখানে তিনি ৪০ দিন অবস্থন করেন। এই সময়ের মধ্যেই বনী ইসরাইল তারা গরুর বাছুরের মূর্তি পূজা আরম্ভ করে। তখন রাগান্বিত হয়ে মূসা নবী বাছুরের মূর্তিটি ধ্বংস করে সাগরে ভাসিয়ে দেন। ইহুদীরা মূসার কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি আল্লাহর কাছে বনী ইসরায়েলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু এরপর ইহুদীরা আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখার জন্য মুসা নবীর কাছে বায়না ধরে বসে। এ জন্য ফেরেশতার মাধ্যমে তাদের তুর পাহাড় উঠিয়ে শাস্তির ভয় দেখানো হয়।
সিরিয়া যাওয়ার পথে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় জর্জরিত বনী ইসরায়েলের জন্য মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। আল্লাহ তাদের জন্য মান্না ও সালওয়া নামক জান্নাতি খাবার প্রেরণ করেন। তখন মুসা নবী বনী ইসরায়েল সম্প্রদায়কে বলেন---তোমরা প্রত্যেকে মান্না ও সালওয়া সংগ্রহ করে যেদিনেরটা সেদিনই খাবে, আগামীকালের জন্য জমা করে রাখবে না। এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর তারা লোভের বশবর্তী হয়ে নিত্যদিনের প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার জমানো শুরু করলো। ফলে আল্লাহতায়ালা আসমান থেকে এসব খাদ্যবস্তু পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। এতে করে বনি ইসরাইলের পূর্বের মতো খাদ্য-সংকট দেখা দিলো। মুসা নবী তাঁর নির্দেশ অমান্য করায় বনী ইসরায়েলকে তিরস্কার করেন। তারা তখন বলতে লাগলো, হে মুসা (আঃ), তুমি আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য মরিচ, পেঁয়াজসহ মসলাযুক্ত খাবারের ব্যবস্থা করে দাও। কারণ প্রতিদিন একইরকম খাবার গ্রহণের ফলে ওতে আমাদের অরুচি এসে গেছে! অতঃপর মুসা (আঃ) পুনরায় তাদের অনুরূপ খাদ্যের জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে ফরিয়াদ করলেন। আল্লাহর কাছ থেকে জবাব আসে--হে মুসা, তোমার সম্প্রদায় যদি তাদের মনমতো খাবার চায় তবে যেন তাদের নিকটবর্তী অন্য কোনো শহরে চলে যায়।এভাবে হজরত মুসা নবী আজীবন তাদের নিয়ে কষ্ট করেছেন।