Posts

ফিকশন

অনন্ত ডিটাচমেন্ট

October 25, 2024

Amir Hamza

7
View

আমি হাসলাম। সুমনকে বললাম, এখন আর এইগুলা ভাবি না।’’ সুমন কিছুটা নড়ে চড়ে বসে বললো, ‘‘কেনো ভাবিস না?’’ আমি সামনের নদীর আছড়ে পড়া ঢেউ এর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমরা দুইজন নদীর ধারে চেয়ার নিয়ে বসে আছি। কিছুক্ষণ যাবৎ আলাপ করে চলেছি। জীবনের সব অসংগতি যেগুলা নিয়ে আমরা নিজেদের সঙ্গেও অল্প স্বল্প সংলাপে বসি, বেশি গভীরে যাই না। নিজেরাই ভয় পাই, হয়তো এমন কিছু বেরিয়ে আসবে যার মানে আমরা বুঝে যাবো। মানে একবার বুঝে গেলে সেই গুলা নিয়ে আর ভাবতে পারবো না। চিন্তা জীবন্ত হয়ে যাবে। সেই সব ব্যাপার নিয়ে দুইজন আলাপ করছিলাম। আমি ওর কথার উত্তর দিচ্ছি না দেখে আমাকে বলল, ‘‘কিরে, বল? কেনো ভাবিস না?’’


 

পানি এসে আমার পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে শীতল বাতাস শরীরের রন্ধ শুদ্ধা কাপিয়ে দিচ্ছে। ছোটবেলায় এমন বাতাসে দাঁতে দাঁত  লেগে যেত। আমি শীতে কম্পিত কণ্ঠে বললাম, “ভাবিনা এমনি কোনো কারণ নেই।’’ সুমন হাল ছেড়ে দিয়ে বলল ‘‘আচ্ছা।’’ আমি ওকে হতাশ করেছি। হঠাৎ নিজের মধ্যে থেকেই কথা বেরিয়ে এলো, ‘‘সুমন ঐযে দূরে দেখতে পাচ্ছিস?’’ “হুঁ, পাচ্ছি আমি তো কানা না!’’ আমি মৃদু হাসলাম, হাসি ধরে রেখেই বললাম, ‘‘আমি জানি তুই কানা না। আমি বলছি অন্য কারণে, এইভাবে বোধয় কথার জোড়  বাড়ে।’’


 

সুমন বললো ‘‘আচ্ছা বল’’ আমি দুই হাত দুই আমার পার্শ্বদেশে জড়িয়ে ধরে শীত থেকে রেহাই পেতে চেষ্টা করলাম, মিছে চেষ্টা। তবে এইভাবে মনের মধ্যে শীত কম অনুভূত হয়। বললাম, “ঐযে যেখানে মনে হচ্ছে নদী আর আকাশ একত্রিত হয়েছে। একে অপরের সঙ্গে লেগে লেগে আছে। এখান থেকে দেখলে তাই মনে হয়। মনে হয় নদী আর আকাশ একই জিনিষ, একজন উপরে একজন নিচে। হঠাৎ হঠাৎ আমাদের নাগালের বাহিরে ওরা মিলিত হয়। ওরা কথা বলে আমাদের লুকিয়ে। ওরা এক হয় যেখানে আমরা যেতে পারিনা। অথচ ওরা এক না আলাদা আলাদা। ওরা মিলেও যায়নি কোথাও। আমাদের ভ্রম ওরা মিলে গেছে। আমাদের চোখ এর বাহিরে আর দেখতে পায়না, দেখতে চায়না জন্যে ওদের মিলিয়ে দিয়ে দৃষ্টি গোচর করে দিয়েছে পরের অংশ।’’ 


 

সুমন বললো, ‘‘কি বললি কিচ্ছু বুঝিনি। তবে শুনতে ভালো লাগলো, এর সঙ্গে ভাবনার কি সম্পর্ক?’’ আমি সুমনের দিকে তাকালাম, দেখলাম ওর মুখে হতভম্ভ ভাব স্পষ্ট, আমি আবার সামনে তাকিয়ে পুরানা ভঙ্গিতে হাসলাম। এইবার দুহাত দিয়ে আমার ঘাড় চেপে ধরে বললাম, ‘‘ মানুষও তাই, আমিও তাই তুইও। আমরা সবাই। আমরা কখনও এই নদীর পানি আর আকাশের নীলের মতন মিলত হতে পারিনা। আমাদের অভ্যাস আমাদের দেয়না। হয়তো হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়তো পেয়ে গেলাম, অনেক প্রতীক্ষার বস্তু বুঝি হাতের মুঠোয়। আসলেই  আমাদের হাতের মুঠোয়, কিন্তু তখনো মুঠো করে অপেক্ষা করতে হয়। অপেক্ষা করতে হয়, বালির মতন কখন সেগুলা মুঠো গলিয়ে গড়িয়ে পড়বে। আমরা শুধুই গলিয়ে পড়া দেখবো। ঐযে আকাশ আর পানিকে এখান থেকে একে ওপরের আষ্টেপৃষ্টে লেগে আছে মনে হচ্ছে, আমাদেরও তাই। দূর থেকেই আমরা অ্যাটাচ। কাছাকাছি গেলে দেখতে পাবো এই পানি আর আকাশের মতন আমরা আলাদা, আমাদের মধ্যে দূরত্ব অসীম।’’



 

লম্বা বক্তব্য দিয়ে থামলাম, এখনো শেষ হয়নি। আমি আরো কিছু বলব। সুমন দেখলাম চুপচাপ, কিছু বলছে না। পানির উপরে পা নাড়াচ্ছে। সন্ধ্যা হবে হবে করছে, কিছুক্ষণের মধ্যে মাগরিবের আযান হবে। আমি সন্ধ্যার সূর্য ডোবার গাঢ় বিষন্ন লালচে ধূসর আভা দেখতে দেখতে নামাজে যাবো। আমি দূরে সূর্যের ঢলে পড়া দেখতে দেখতে বললাম, ‘‘মায়ের উদোর থেকেই আমরা অনন্ত, ডিটাচমেন্ট নিয়ে আসি।  আমাদের লোকজনের সঙ্গে মিশা শিখাতে হয়। নাহলে তুই দেখবি, একটা বাচ্চা যাকে কখনো মেলামেশা শেখানো হয়নি; ও কখনো লোকজনের সঙ্গে মিশতে পারেনা। আটাচমেন্ট এই দুনিয়াতে বড়ো হতে হতে আমরা শিখি। অনেক সময় দেখবি অনেকে বড়ো হওয়ার পরেও ডিটাচ থাকে। সারাটা জীবন ওরা সবার অংশ, আবার ওরা সবার থেকে দূরে। ঠিক ওই পানি আর আকাশের মতন। মেঘ আর সূর্যের দুরুত্বের মতন। তোর আর স্নেহার দুরত্বের মতন। আমার জন্মের আগে থেকেই ঐগুলা নিয়ে আসি। কেমন ভাবে দূরে দূরে থাকা যায়। আমরা…..’’


 

আমর কথা শেষই হয়নি, এমন সময় আজান দিল। আমি বললাম চল উঠি, নামাজে যেতে হবে। স্যান্ডেল কোথায় রাখছিস? সুমন নদীর পাড়ের একটা গাছের গোড়া দেখিয়ে দিল। সেখানে দেখলাম স্যান্ডেল নেই, গাছ সোজা দুরে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের স্যান্ডেল জোড়া পানিতে ভাসছে। আমি ওর দিকে হতাশাপূর্ণ  দৃষ্টিতে তাকালাম, এর মানে ও এখন মার খাবে নাহলে নদীতে নেমে স্যান্ডেল উঠিয়ে আনতে হবে। স্যান্ডেল উঠিয়ে আনা সম্ভব না, আমি ওর ধরে কিছুক্ষণ আচ্ছামতো উত্তম মাধ্যম দিলাম। এর পরও দেখি হাসছে। আমি বললাম “তুই স্যান্ডেল কিনে দিবি, হ্লা কালকে মসজিদ থেকে এক জোড়া গেছে আজকে আবার তুই জলাঞ্জলি দিলি। এখন আমাকে কাধে উঠিয়ে নিয়ে চল।” সুমন তাও হাসছে। এইবার আমিও হেঁসে ফেললাম। আমার নতুন স্যান্ডেল জোড়া ভাসতে ভাসতে চলেছে, যেখানে নদীর ধূসর ঘোলাটে পানি আর আকাশের মিহি রঙের নীল মিলিত হয়েছে।

Comments

    Please login to post comment. Login