পোস্টস

প্রবন্ধ

ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ইতিহাস(পর্ব-৩)

২৫ অক্টোবর ২০২৪

Yousuf Haque Chowdhury

দাউদ নবী(King David) প্রতি শনিবার আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যাব্বুর কিতাব পাঠ করতেন। ওই সময় সমুদ্রের মাছও তার তেলাওয়াত শুনতে সাগর কিনারে চলে আসতো। ইহুদিরা ওই সময় মাছগুলো ধরে নিত। 

 

তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে শনিবার মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু আল্লাহর বিধানেও তারা নিজেদের স্বভাবজাত কূটবুদ্ধি প্রয়োগ করে। তারা শনিবার জাল দিয়ে মাছগুলো ঘেরাও দিয়ে রেখে রবিবার ধরে নিতো। আল্লাহ এর শাস্তিস্বরূপ তাদের ওই দলটিকে বানরে পরিণত করেন। তিন দিনের মাথায় ওই বানরের দলটির সবাই মারা যায় (সুরা বাকারা, আয়াত ৪৯-৭৩)। 

 

হযরত দাউদ (আ.)-এর মৃত্যুর পর তার পুত্র সুলাইমান (King Solomon) বনী ইসরাইলের নবী হন। সুলাইমান (আ.)-এর রাজত্বকালে ইহুদীরা উন্নতির শিখরে ছিলো। কিন্তু সুলাইমান নবীর মৃত্যুর পর ইহুদীরা আবার ধর্মদ্রোহিতার পথ অনুসরণ করে। 

 

বনী ইসরাইলের কাছে প্রেরিত পরবর্তী সকল নবী ইহুদীদের এ ধরনের নিন্দনীয় কার্যকলাপের শোচনীয় পরিণাম সম্পর্কে সতর্কবাণী শোনালেও ইহুদীরা তাদের কথা না মেনে উল্টো নবীদের বিরোধিতা করে। তখন তাদের উপর আল্লাহর গজব নেমে আসে। মিসরের সম্রাট বনী ইসরাইলের ওপর চড়াও হয়ে ব্যাপক হত্যা ও লুন্ঠন চালায়। এরপর কিছুদিন তারা আল্লাহর নির্দেশিত পথে জীবন যাপন করে। কিন্তু তাদের জাতিগত কুপ্রবৃত্তি তাদের ভালো থাকতে দেয়নি। তারা পূর্বের ন্যায় আবার মূর্তিপূজা আরম্ভ করে। হজরত ইলিয়াস (আ) তাদের এই পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করেন। এতে ইহুদি জাতির রোষানলে পড়ে তিনি শুধু নির্যাতনেরই স্বিকার হননি, তাকে হত্যার জন্যও ইহুদীরা উদ্যোগী হয়। ফলে আবার তারা আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হয়। 

 

৫৯৭ থেকে ৫৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যে বসবাসকারী ইহুদিরা বড় আকারে নির্যাতিত এবং নির্বাসনের স্বিকার হয়। ব্যাবিলনীয় সম্রাট বাখতুন নাসর জেরুজালেম নগরী প্রথমে অবরোধ ও পরে জয় করেন। তিনি রাজ প্রাসাদ লুট করা সহ ইহুদী সুলতান ইয়াহুভা ইয়াকিনকে বন্দী করেন। হত্যাযজ্ঞ ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে শহরটি নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। এরপর বাখতুন নাসর বন্দী ইহুদীদের জেরুজালেম থেকে বিতারণ করে খাবুর নদীর কাছে নাইবুর নামক এলাকায় নির্বাসিত করেন। সেখানে ইহুদীরা চরম অবহেলা আর দুর্গতির মধ্যে ৭০ বছর পার করে। সম্রাট বায়তুল মুকাদ্দাসে আক্রমণ চালিয়ে আল-আকসা মসজিদ ধ্বংস করে দেয়। 

 

খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে পারস্য সম্রাট সাইরাস দ্যা গ্রেট বাবেল নগরী ও রাজ্য দখল করেন। তিনি শাম ও ফিলিস্তিন আক্রমণ করে সেই অঞ্চলও নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। তিনি বাখতুন নাসর কর্তৃক বন্দী সব ইহুদীকে জেরুজালেম ফিরে যাওয়ার এবং বায়তুল মুকাদ্দাস পুনঃনির্মাণের অনুমতি দেন। এসময় ইহুদীরা আবার আল আকসা মসজিদ নির্মাণ করে। খ্রিস্টপূর্ব ৫১৫ সালে এই নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। কিন্তু তারা আবার স্বভাব্জাত পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং আল্লাহ প্রদত্ত শাস্তির সম্মুখীন হয়। আন্তাকিয়ার সম্রাট খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৬৩ সাল পর্যন্ত পর্যন্ত আল কুদসে সেনা অভিযান পরিচালনা করেন। গ্রীক সম্রাট তাদের ওপর চড়াও হয় এবং ইতিহাস অনুযায়ী ৪০ হাজার ইহুদিকে হত্যা এবং ৪০ হাজারেকে বন্দি করে। একই সাথে বায়তুল মুকাদ্দাসের যাবতীয় মূল্যবান জিনিস লুণ্ঠন করে। মাত্র দুই বছরের ব্যাবধানে দুইবার বায়তুল মুকাদ্দাসের ওপর বিরাট আঘাত হানা হয়। পুরো নগরীর বাড়িঘর ও প্রাচীরসমূহ ধ্বংস করা হয়। সম্রাট গ্রিক দেবতা জিউসের প্রতিমা স্থাপন করে ইহুদীদেরকে উক্ত প্রতিমার উপাসনা করার আহবান জানান। তাদের অনেকেই এই আহবানে সাড়া দেয় আবার অনেকেই গোপন স্থান ও পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। 

 

খ্রিস্টপূর্ব ৬৪ সালে সম্পূর্ণ ফিলিস্তিন অঞ্চল রোমানদের দখলে চলে যায়। এসময় ইহুদীরা ভালোই ছিল। কিন্তু তারা আবার বিশৃংখলা সৃষ্টি করলে রোমান সম্রাট কাসবেসীয়ান জেরুজালেম আক্রমণ করে সেখানকার ইহুদীদের অবরুদ্ধ করেন। তিনি শহরে প্রবেশ করে হাজার হাজার ইহুদীকে হত্যা করেন এবং তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দেন। তাদের উপাসনালয় গুঁড়িয়ে ফেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। উপাসনালয়টি এমনভাবে ধ্বংস করা হয় যে, এর অস্তিত্বই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। শহরের যেসব ইহুদীরা প্রাণে বেচে গিয়েছিল তাদেরকে রোমে দাস হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়। 

 

এভাবে বনী ইসরায়েলের অবস্থা ববারবার শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছলেও এদের চরিত্র পাল্টায়নি। হজরত ইয়াহইয়া (আ.) ইহুদিদের অশ্লীল কার্যকলাপের বিরোধিতা করলে ইহুদীরা তাকে দ্বিখণ্ডিত করে হত্যা করে। হযরত যাকারিয়া (আ.) ইহুদীদের কাছে সংশোধনের দাওয়াত নিয়ে গেলে ইহুদীরা প্রথমে তার বিরুদ্ধচারণ করে এবং পরবর্তীতে তাকে করাত দিয়ে চিরে দুই টুকরা করে হত্যা করে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, বনি ইসরাইল জাতি তাদের নিকট প্রেরিত ৩০০ নবীকে হত্যা করেছে (তাফসিরে ইবনে আবি হাতেম:১/১২৬)। 

 

হযরত ঈসা (আ.) ও বনী ইসরাইল

হজরত ঈসা (আ.) বনী ইসরাইলের সর্বশেষ রাসুল। আসলে তিনিই ছিলেন ইহুদীদের বহুল কাঙ্ক্ষিত সেই মাসিহ যিনি বনী ইসরাইলকে আবার মর্যাদার আসনে নিয়ে যেতেন। কিন্তু অভাগা ইহুদীরা তাকে চিনতে ভুল করলো। নিজেদের স্বভাবজাত কুপ্রবৃত্তির কারনে তারা ঈসা নবীর দাওাতেরও বিরোধিতা শুরু করে। রোমান শাসকদের সাথে হাত মিলিয়ে ইহুদীরা ঈসা নবীকেও হত্যার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। সেজন্য রোমান সম্রাটকে তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে শুরু করে। তারা অনবরত সম্রাটের কান ভারি করতে থাকে এই মর্মে যে, লোকটি জাদুকর। সে তাওরাত পরিবর্তন করে সবাইকে বিধর্মী করতে সচেষ্ট। এসব অভিযোগ শুনে সম্রাট অবশেষে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। তখন ইহুদীদের এসব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য আল্লাহ স্বীয় কৌশল প্রেরণ করেন। ষড়যন্ত্রকারী দলের প্রধানকে ঈসা নবীর অনুরুপ চেহারা দান করেন এবং ঈসা (আ.)-কে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন। ঈসা নবীর স্থলে সেই ষড়যন্ত্রকারী গ্রেফতার ও ক্রুশবিদ্ধ হন। তবে খৃষ্টানরা বিশ্বাস করে সেদিন ঈসা নবীই নিহত হয়েছিলেন এবং তিনি ভক্তদের মাঝে পুনরায় ফিরে এসেছিলেন।   

 

হযরত উমর(রাঃ)-এর জেরুজালেম বিজয়  

জেরুজালেম নগরীর আধুনিক ইতিহাস শুরু হয় মুসলমানদের কর্তৃত্বে আসার পর। এর আগে ফিলিস্তিন অঞ্চল পূর্ব রোমান সম্রাজ্য অর্থাৎ বাইজেন্টাইন সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। মুসলিম বিজয়ের ২৩ বছর পূর্বে ৬১৪ সালের মাঝামাঝি বাইজেন্টাইনদের সাথে সাসানীয়দের শেষ যুদ্ধের সময় সাসানীয় বাহিনী এখানে আক্রমণ করে। পারসিকরা জেরুজালেম শহরে হত্যা ও লুটপাট চালায়। বলা হয় শহরে এসময় তারা প্রায় এক লাখ খ্রিষ্টান অধিবাসীকে হত্যা করে। সেই সাথে চার্চ অব দ্য হলি সেপালাচার ধ্বংস করা হয়। চার্চের ক্রুশ খুলে তিসফুনে নিয়ে যাওয়া হয়। কথিত আছে ইহুদিরা নাকি এই ধ্বংসযজ্ঞে পারসিকদের সাহায্য করেছিল। পারসিকদের কাছ থেকে জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের পর সম্রাট হেরাক্লিয়াস ৬৩২ সালে এটির প্রতিরক্ষা মজবুত করেন। 

 

হযরত মুহাম্মদ (সা) এর মৃত্যুর পর আবু বকর খলিফা হন। জাজিরাতুল আরবের উপর আবু বকর (রাঃ)-এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি পূর্ব দিকে ইরাক আক্রমণ করেন। ৬৩২ থেকে ৬৩৪ সাল পর্যন্ত খলিফা আবু বকর (রাঃ) এর সময় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে কোন বড় ধরনের অভিযান পরিচালিত হয়নি। আবু বকর (রা) ৬৩৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর হযরত উমর (রাঃ) মুসলিম জাহানের খলিফা হন। তিনি এসময় উত্তর দিকে বাইজেন্টাইন অঞ্চলে খিলাফত সম্প্রসারণ শুরু করে। খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং আমর ইবন আলআস (রাঃ) সহ বেশ কয়েকজন বিচক্ষণ মুসলিম সেনাপতিকে তিনি বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রেরণ করেন। 

 

৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবরের প্রথম দিকে সিরিয়ার মুসলিম বাহিনীর প্রধান কমান্ডার আবু উবাইদাহ যুদ্ধের ভবিষ্যত পরিকল্পনা বিষয়ে একটি সভার আহ্বান করেন। আবু উবাইদাহ দুটি শহরের গুরুত্ব অনুধাবন করছিলেন। তাই সেই সভায় উপকূলীয় শহর কায়সারিয়া ও জেরুজালেম জয়ের বিষয়ে কৌশলগত বিভিন্ন রকম মত উঠে আসে। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পেরে তিনি খলিফা উমরের কাছে নির্দেশনা চেয়ে চিঠি লিখে পাঠান। উত্তরে খলিফা উমর দ্বিতীয় শহরকে জয় করার নির্দেশ দেন। 

 

এরপর আবু উবাইদাহ জাবিয়া থেকে জেরুজালেমের দিকে অগ্রসর হন। তার সাথে খালিদ বিন ওয়ালিদ ও তার অধীনস্থ বাহিনীও ছিল। নভেম্বরের প্রথমদিকে মুসলিম বাহিনী জেরুজালেম নগরীতে পৌছে। বাইজেন্টাইন বাহিনী তখন নগর প্রাচীরের ভেতর অবস্থান নেয়। তখন জেরুজালেম নগরীর দায়িত্বে ছিলেন বাইজেন্টাইন সরকারের প্রতিনিধি ও স্থানীয় খ্রিস্টান গীর্জার প্রধান যাজক সফ্রোনিয়াস। 

 

মুসলিম বাহিনী শহরের সকল প্রবেশ পথের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে নেয়ার পর জেরুজালেম নগরী একরকম অবরোধের মুখে পড়ে যায়। ফলে পবিত্র শহরটি সিরিয়ার বাকি অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মুসলিম বাহিনী আরও এগিয়ে জেরিকো পৌছালে সফ্রোনিয়াস সকল পবিত্র চিহ্ন সংগ্রহ করেন এবং সেগুলো রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে পাঠানোর জন্য উপকূলে পাঠিয়ে দেন। 

 

মুসলিম বাহিনী শহরের উপর ক্রমাগত আক্রমণের পরিবর্তে বাইজেন্টাইনদের রসদ কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন যাতে রক্তপাতহীন আত্মসমর্পণ সম্ভব হয়। শাসক বাইজেন্টাইনদের সাথে ধর্মীয় মতপার্থক্য থাকায় স্থানীয় ইহুদি এবং খ্রিস্টান উভয় ধর্মের মানুষ মুসলিম বাহিনীকে স্বাগত জানায়। এভাবে দীর্ঘ চার মাস শহর অবরোধ করে রাখা হয়। রক্তপাতহীন অবরোধের পর সফ্রোনিয়াস আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হন। তবে সফ্রোনিয়াস নগরীর চাবি হস্তান্তরে শর্ত জুড়ে দেন যে খলিফা উমরকে নিজে এসে চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। 

 

অভিযানের অন্যতম মুসলিম সেনাপতি শুরাহবিল ইবনে হাসানা প্রস্তাব করেন যে মদীনা থেকে খলিফা আসার অপেক্ষা না করে খালিদ বিন ওয়ালিদকে খলিফা বানিয়ে পাঠানো হোক। কারণ খালিদ বিন ওয়ালিদ দেখতে অনেকটা খলিফা উমরের মত ছিলেন। কিন্তু এই কৌশল কাজে দেয়নি। কারন সফ্রোনিয়াস ছিলেন প্রখর মেধাবী একজন মানুষ। তিনি খালিদের ছদ্মবেশ ধরে ফেলেন। ফলে সফ্রোনিয়াস আলোচনায় অসম্মতি জানান। বাধ্য হয়ে আবু উবাইদাহ খলিফা উমরের কাছে চিঠি লিখে পরিস্থিতি অবহিত করেন এবং নগরীর চাবি হস্তান্তর অনুষ্ঠানের জন্য খলিফাকে জেরুজালেম আসার আমন্ত্রণ জানান।