হীরালাল সেন ছিলেন বাঙালি সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যিনি কেবলমাত্র একজন চিত্রগ্রাহকই নন, তিনি ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর সৃষ্টিশীলতার ভেতর দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের সূচনা হয়েছিল। এটি পরবর্তী সময় বিশাল এক শিল্পে রূপান্তরিত হয়েছে।
শৈশব ও শিক্ষা
হীরালাল সেন ২ আগস্ট ১৮৬৬ সালে মানিকগঞ্জের বগজুরি গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব কেটেছিল কলকাতায়।যেখানে তিনি পরিবারের আইনজীবী পিতার ছায়ায় বড় হন। শিক্ষাজীবন শুরু হয় মানিকগঞ্জ মাইনর স্কুলে, পরে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে ও শেষ পর্যন্ত কলকাতায়। এই সময়েই তাঁর মনে চলচ্চিত্রের প্রতি আকর্ষণ জন্মায়।
চলচ্চিত্র নির্মাণের সূচনা
১৮৯৮ সালে প্যারিসের ‘পাথে ফ্রেরেস স্টুডিও’ থেকে ধার করা ক্যামেরা দিয়ে তিনি নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম ছবি ‘A Dancing Scene From the Opera, The Flower of Persia’। এটি ছিল বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। পরে ভাই মতিলাল সেনের সহায়তায় তিনি ১৯০১ সালে রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
সৃষ্টিশীলতার চিরন্তন ছাপ
হীরালাল সেনের কর্মজীবন ছিল এক অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার প্রতীক। তিনি চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো ছিল মূলত থিয়েটার ভিত্তিক, সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন। বিশেষ করে ১৯০৫ সালে নির্মিত ‘Anti-Partition Demonstration and Swadeshi movement’ ছবিটি ভারতের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
হীরালাল সেনের চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের জন্যই ছিল না, এটি একটি রাজনৈতিক বার্তার সেতু হিসাবে কাজ করেছিল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তাঁর চলচ্চিত্রগুলো সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবনা ছড়াতে সাহায্য করেছিল। ‘বন্দে মাতরম’ গানটি তাঁর চলচ্চিত্রের শেষে গাওয়ার মাধ্যমে জাতীয় আবেগকে উজ্জীবিত করেছিলেন।
দুঃসময়ের মুখোমুখি
ব্যক্তিগত জীবনে হীরালাল সেনের সঙ্গে হেমাঙ্গিনী দেবীর বিয়ে হয়। তাদের তিন সন্তান কথা জানা যায়। ১৯১৩ সালের পর তিনি বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হন। এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ কোম্পানি সাফল্যের শিখরে পৌঁছালেও, হীরালালের জীবনে সমস্যার ছায়া ক্রমবর্ধমান হয়। এর মধ্যে তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ১৯১৭ সালের ২৬ অক্টোবর মারা যান। তার মৃত্যুর কিছুদিন এক অগ্নিকাণ্ডে তাঁর সমস্ত চলচ্চিত্র নষ্ট হয়ে যায়। ওই দুর্ঘটনা শুধুমাত্র তাঁর সৃষ্টিশীলতা নয়, বরং বাংলা চলচ্চিত্রের একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটে।
হীরালাল সেনের জীবন ও কাজ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, শিল্প ও সংস্কৃতি কীভাবে সমাজের আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁর অবদান শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের জাতীয় চেতনা ও সাংস্কৃতিক গৌরবের এক অমূল্য সঙ্গীত। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম চিরকাল অম্লান থাকবে। কারণ তিনি ছিলেন ওই প্রভাতের সূর্য, যার আলোতে সিনেমার জগতে এক নতুন ভোরের সূচনা হয়েছিল।