রাত তিনটে! বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। শাঁ শাঁ করে বাতাস বাতাস বইছে সাথে। মাঝে মাঝে পশ্চিম আকাশ বরাবর হঠাৎ হঠাৎ শুভ্র বক্ররেখা টানছে বজ্র। বাতায়ন খুলে জানালার পাশে দাঁড়ালেন তহুরা বেগম, হাতে তসবিহ্। রাত্রির মৃদু আবছায়া আজ তার মন কেড়েছে। আকাশে বজ্রের বক্ররেখা যেন কারো ছবি আঁকছে আবার মুছে দিচ্ছে পরক্ষণই। মনে পড়ছে একরাশ অতীত আর ক্ষণজন্মা প্রিয় আবছায়াটুকু।
বছর চারেক হলো গৃহকর্তার মৃত্যু হয়েছে। জলজ্যান্ত লোকটি এমন হঠাৎ পরাপরে পাড়ি জমাবে অসমাপ্ত একটা জিবন রেখে, তা কখনো ঠাহর হয় নি। বড় মেয়েটা সবেমাত্র স্নাতকোত্তর শেষ করেছিলো, চাকরীটা হয়ে উঠে নি তখনো। চারিদিক থেকে বিবাহের আলাপ আসছিলো; কর্তা একবাক্যে না করে দিয়েছিলেন; মেয়েটা এতোটা পড়াশোনা করেছে এবার ভালো একটা চাকরি ধরুক, তারপর এসবে যাওয়া যাবে। মেঝো মেয়েটা মেডিকেলে পড়ছে মাত্র ২য় বর্ষে আর ছোটটা আদরের সবেধন নীলমনি। মেয়েদের নিয়ে তাঁর দেদার স্বপ্ন! বড় মেয়েটা একদিন সরকারি কর্তা হবে, মেঝোটা নামকরা ডাক্তার হবে আর ছোটটাও বড় নাম করবে জিবনে। রাত্রিতে মেয়েরা পড়তে বসলেি তিনি পাশে এসে বসতেন, বলতেন "মা রে, পড়। তোদের নিয়েই আমার যতো স্বপ্ন!"
পৃথিবী'র ছায়াপথ উপবৃত্তাকার। আবর্তনের পথে পৃথিবী মাঝে মাঝে কিছুটা বক্র পথেও চলে, তাই চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহন ঘটে। মানুষের জিবন-নিয়তিও তাই। তবে জিবনে কখনো প্রবল ঝড়ের ঝাপটা আসে, আসে পর্বতসম সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। তহুরা বেগমের পরিবারে একদিন একন ক্ষণ আসলো। গৃহকর্তা জনাব তাসরীব সাহেব স্থানীয় একটি কলেজে সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। সেদিন ছিলো শনিবার; দুপুরের ওয়াক্ত! তসরীব সাহেব হঠাৎ তীব্র মাথা-ব্যাথা অনুভব করে ঠায় পড়ে গেলেন। পরক্ষণেই ডাক্তারের কাছে নেয়া হলো। ডাক্তার সিটি স্ক্যান-এমআরআই করার পরামর্শ দিলেন। নীরিক্ষায় ব্রেন-টিউমার ধরা পড়লো। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! ঠিক তখন দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলো। পুত্রসন্তানহীন পরিবারের কণ্যা তিনটি তখন নিদারুণ জলে পড়লো। বাবাকে নিয়ে যে হাসপাতালে যে হাসপাতালেই যাচ্ছে, সেখান থেকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। হাসপাতালগুলো করোনার দরুন একে একে লোকশূন্য হয়ে পড়ছে অথবা করেনার জন্য ডেডিকেটেড করে দেয়া হচ্ছে। স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যকর ভেঙ্গে পড়েছে; সময়মতো না মিলছে ডাক্তার, না মিলছে পথ্য; মিলছে রক্তের জোগান!! প্রসস্থ পৃথিবী সংকীর্ণ হয়ে এলো। ঢাকা পিজি হাসপাতাল করোনার জন্য ডেডিকেটেড ঘোষিত হলো, ভিন্ন রোগীদের জন্য ঠাই মিললো না। ডাক্তারের পরামর্শ মতো উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত নেয়ার প্রচেষ্টা হলো, কিন্তু করোনার দরুণ যথাসময়ে পাসপোর্টজনিত প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হলো না। তাসরূব সাহেবও তখন ম্যলিগনেন্ট টিউমারের শেষ পর্যায়ে। সহসা আয়ু ফুরিয়ে এলো দ্রুতই।
অনেকক্ষণ ধরেই স্বামীর পূর্ণ্যার্থে নানা দোয়া পড়ছিলেন তহুরা বেগম। মাঝে মাঝে বাতায়ন দুয়ারে এঁকে উঁকি দিচ্ছেন ভোরের কালিমা দেখা যায় কিনা সেই আশে! পাশের রুমে মেয়েরা ঘুমাচ্ছে অঘোরে। নাহ! এই আঁধার কাটছে না। এই প্রহর যেন দীর্ঘতর হচ্ছে, প্রলম্বিত হচ্ছে যুগ থেকে যুগান্তরে! মনে পড়লো তাসরীব সাহেবের মৃত্যুর পর নিদারুণ দূর্দশাময় দিনগুলোর কথা। সমস্ত পৃথিবী তখন সংকীর্ণ হয়ে এসেছিলো। এতোকাল গৃহকর্তা থাকায় যেসব দায়িত্ব নেন নি, আজ তা একসাথে এসে হাজির হলো দুয়ারে। একদিকে করোনা, অন্যদিকে সকল আলোর দুয়ার বন্ধ! প্রতুষ্যের ছায়া মিলছিলো না কোথাও। কর্তার মৃত্যু পরবর্তীতে উত্তোরোধিকার নিয়ে নানা দ্বন্দ্ব শুরু হলো। স্বামীর অবর্তমানে যারা এগিয়ে আসার কথা, তারাই দুরে সরে গেলো নানা অজুহাতে। মেয়েগুলো নিদারুণ ভেঙ্গে পড়লো, বাবা নামের অশ্বথ গাছের ছায়া মাড়িয়ে বাহিরে যায় নি তারা কখনো। আজ অশ্বত্থ গাছটির অনুপস্থিতিতে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মিমালা যেন একেবারে ওজোন লেয়ার ভেদ করে সমস্ত শক্তিতে তীব্রভাবে বিধঁতে লাগলো গায়ে, এ যেন জাহান্নমে হাবীয়ার নরকযন্ত্রণা!! গোছানো স্বপ্নরা একে একে অগোছালো হয়ে যাচ্ছিলো, চেনা পথ যেন বুনো হয়ে উঠছে আর অচেনা হয়ে উঠছে।
জিবন নদী একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে! রাত যতই দীর্ঘহোক না কেন, ভোরের উত্থান অবশ্যম্ভাবী। বছর দুয়েক পেরুবার পরে ঘরের বড় মেয়েটি চাকরীতে প্রবেশ। বাবার মতো শিক্ষকতার মহান পেশাকেই পাথেয় হিসেবে চিনে নিলো সে। গড়ানো বেলায় তাকে খুঁজে নেয় অনাদিকাল অপেক্ষারত এক আত্মা। বিয়ের পিঁড়িতে বসে সে। শিক্ষকতা আর পরিবার মিলিয়ে জিবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে সে।
হাপ্তাখানেক গেলো মেজো মেয়েটারও বিয়ে হয়ে গেলো। বকুলঝরা সন্ধ্যা নেমে এলো সেদিন। লাল-নীল আলোকের সম্মীলনে কন্যাদান হলো। চিকিৎসক পাত্রীর সাথে উপযুক্ত চিকিৎসক পেশার পাত্র মেলায় তহুরা বেগম কণ্যাদান করতে কুন্ঠাবোধ করলেন না। কন্যা বিদায়ের বেলা তহুরা বেগম বুঝতে পারলেন তার এতোকালের নাড়িছেঁড়া ধন আজ চিরতরে অন্য গৃহে চলে যাচ্ছে। কান্নার রোল উঠলো ঘরে, এতোকাল যে নানা আবদার করে ঘরকে মাতিয়ে রাখতে সে আজ এই ঘরের প্রদীপ নিভিয়ে চলে যাচ্ছে স্বামীর গৃহে প্রদীপ জ্বালাতে। এ বিদায় নির্মম, অথচ ধরাধামে এই তো বিধির খেলা।
দুই কণ্যার পাত্রদান হলো, অথচ কর্তা নেই। যিনি হাজারো স্বপ্নের বুনন করতেন তার প্রিয় কন্যাদের নিয়ে তিনিই কণ্যাদের বিদায়বেলায় অনুপস্থিত! অথচ কতো স্বপ্ন দেখতেন একদিন তাঁর তনয়ারা বড় কিছু হবে, মহা ধুমধামে তাদের পাত্রস্থ করা হবে! তহুরা বেগম আঁচলে চোখ মুঁছতে গিয়ে পাশে ফিরে তাকান, দেয়ালো ঝোলানো আছে কর্তার স্মৃতিমাখা জায়নামাজটি, যেখানে কেঁদেকেটে খোদার কাছে তয়নাদের কল্যাণ চাইতেন। সান্ধ্য গোধূলিতে তহুরা বেগমের মনে পড়ে যায় একপ্রস্থ জিবনের অধ্যায়; কোন এক শুভ লগ্নে এই গৃহে বধু হয়ে আসা, জিবনের নানা চড়াই-উতরাই এবং কন্টকাকীর্ণ পথগুলোর পদচারণ। জিবন এক অসমাপ্ত কাব্য! আজ কোলে আছে ছোট আদুরে মেয়েটি। সারাক্ষণ মায়ের আঁচল ঘেষে থাকে সে। পৃথিবীতে বাবার পরে মা-ই তাঁর একমাত্র বন্ধু, আর তার বোনেরা।
ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা চলেছে! এখন সুবহে সাদিক। বৃষ্টির গতি মন্থর হয়ে এসেছে। মিনার হতে আজান ভেসে আসছে। বৃষ্টির বর্তুলাকার ফোঁটা ভেদ করে। পূব আকাশে আলছা আলোকছটা দেখা দিচ্ছে ভোরের আগমনী বার্তা দিতে। মুয়াজ্জিনের কন্ঠে "আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম" বার্তা ঘোষিত হতেই তাহুরা বেগম পুনরায় জায়নামাজে দাঁড়ালেন নতুন ভোর যেন শুভ হয়। বারান্দায় খাঁচায় রাখা পোষা হলদে পাখিগুলোও কিরিচ-মিচির করে ডাকতে শুরু করেছে। তাঁরাই এই অসমাপ্ত জিবন কাব্যের একমাত্র নির্বাক পাঠক এবং চাক্ষুষ সাক্ষী!!
#অসমাপ্ত_জিবন_কাব্য।
#তারিখ: ২৬-১০.২০২৪