বহুদিনের পুরানো কিন্তু এখনো তুমুল প্রাসঙ্গিক
বাংলা প্রবচন রয়েছে, 'যে যায় লঙ্কায় সে-ই হয় রাবণ! ওদিকে আমাদের বালকবেলা মাতিয়ে রাখা হরলাল রায়ের 'ব্যাকরণ ও রচনা' বইয়ের বিবিধ প্রবন্ধে ছোট ছোট কবিতা থাকতো, যেমন —
"দুষ্টের শিরোমণি লঙ্কার রাজা
চুপি চুপি খাও তুমি চানাচুর ভাজা"
বাতাসে নাক পেতে দেখুন তো সেই চানাচুরের ঘ্রাণ পান কিনা? মনে হচ্ছে যেন সর্ষের তেলে মূল্যবান পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা ও ধনেপাতা কুচি মিশিয়ে কারা যেন মাখো মাখো করে খেতে বসেছে। বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাবের দেশে ক্ষমতার মসনদে একবার কেউ গেলে গরীবের কথা আর তাদের মনে থাকে না। ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি এসে রাজাদেরকে প্রশান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন করে রাখে। তার বদলে দেশটারে তরমুজের মতো ফালি ফালি করে কেটে ওই ঘুমদেবীকে উপঢৌকন দিতে রাজাদের বুক কাঁপে না, হৃদয়ও আন্দোলিত হয় না। রাজার হৃদয় পাষাণে গড়া। কারো জন্য তার মায়া ও মমতা থাকতে নেই যেন। রাজেশ্বরের উঠোনে কখনোই ভোরের কোমল রৌদ্র উঠে না। শ্রাবণের বারি বর্ষে না। সেখানে চির বসন্তের জয়জয়কার। আপন আনন্দের সুরলহরী।
আমাদের এই সময়ের রাজরাজড়াদের কী খবর? এতক্ষণ যা বললাম এটাই তো সেই রাজকাহন। রাজা আপনারে ছাড়া কাউকে চেনেন না। কারণ এইদেশে একদিনের জন্যও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার সহসা নির্বাচন দিয়ে জনমতের ভিত্তিতে কাউকে সিংহাসনে বসিয়ে নিরাপদে প্রস্থান করবে এমন নজির কোথাও কেউ দেখেনি। বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠটায় আওয়ামী লীগের অবর্তমানে এখনো বিএনপির পূর্ণ অধিকার। ভবিষ্যতে পারবে না এমনটা বলি না, তবে এখন পর্যন্ত তৃতীয় কোনো পক্ষ দুই দলকে একত্রে হটিয়ে দিয়ে মাঠের বাইরে রাখবার পারফরম্যান্স দেখাতে পারেনি।
ছাত্র-জনতার কঠোর চাপে আওয়ামী লীগ ভেগে গেছে। রইল বাকি বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকার কি বিএনপিকে চাপে রাখতে চাইছে? হতেই পারে। বেরায় কান পাতলে বিরাজনীতিকরণের কথা ঢের শোনা যায়। বাংলাদেশের রাজনীতি তো এমনই। এখানে ভালো কাজে ভোটারের মন জয় করতে কারো কোনো প্রতীতি নাই। সবাই চায় আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজের গদিটার ভিত মজবুত করতে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীদের সক্রিয় অংশীদারিত্ব আছে। আবার সরকারের বাইরে থেকে ওই আন্দোলনকারীরাই জাতীয় পার্টির মতো গৃহপালিত বিরোধীদলের ক্যারেক্টারটাও ধরে রেখেছে। মানে হলো সরকারেও তারা। বাইরেও ওই তারাই। সব যেন তারা তারাই। বিএনপি-জামায়াতকে যে ছিটেফোঁটা পদপদবী ও ধান্ধার সুযোগ দেয়া হচ্ছে এটা হলো আই ওয়াশ।
জামায়াত আমিরের কথাবার্তা খুব ভালো। কিন্তু তাদের অন্তর্গত মতিগতি বুঝা দায়। তবে সরকারের এই আইওয়াশের ভাবভঙ্গিমাটা সম্ভবত ধরে ফেলেছে বিএনপি। এবং বিএনপি তাই সরকারকে খানিকটা চাপে রাখতে পেরেছে। বিএনপি বুকে বল নিয়ে বলতে পারছে রাষ্ট্রপতির অপসারণে সাংবিধানিক শূন্যতা তারা চায়না। পাশাপাশি এটাও বিএনপি বলতে পারছে, সংবিধান পরিবর্তন বা পরিমার্জনও গণতান্ত্রিক সরকারের করণীয় বলে তাদের অভিমত।
সময়ের যথার্থ দাবিতে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। একজন সেনা অফিসারের আহ্বান মুক্তিকামী জনতাকে বারুদের মতো উজ্জীবিত করেছিল। যুদ্ধ শেষে এই বিষয়টি জানার পর বঙ্গবন্ধু ও মেজর জিয়া দারুণ এক দ্বৈরথ হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। কারণ খোদ শেখ মুজিবও তাঁর কন্যার মতো স্তাবকের তোয়াজ পছন্দ করতেন। তিনি নেতা মেনেছিলেন খন্দকার মোশতাককে। হৃদয় থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন মুজিবের অবর্তমানে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া তাজউদ্দীন আহমদকে। বঙ্গবন্ধুর দুয়ারে তাজউদ্দীন নাই, মেজর জিয়া ছিলেন না। কর্ণেল ওসমানী গোস্যা করেছিলেন। মজলুম জননেতা ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মুরুব্বি মওলানা ভাসানীর উপদেশকেও বঙ্গবন্ধু উপেক্ষা ও অগ্রাহ্য করে চলেছেন। ফলাফল ৭২-৭৪ এর শাসনতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলা। শেষে আগস্ট ট্রাজেডি।
অনেকেই বলেন, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট এবং ২০০৪ এর ২১ আগস্ট ঘটে যাওয়ার পর জাতীয়তাবাদী ও মুজিববাদীদের সম্মিলনী অসম্ভব। যারা এমনটা ভেবে এসেছেন তাদের জন্যই বাংলাদেশের রাজনীতির ভাগ্যবিধাতা ২০০৪ এর জুলাই বিপ্লব হাজির করেছে। প্রমাণ করে দিয়েছে বাংলাদেশে আওয়ামী ও বিএনপিমনারা যদি পরস্পরের প্রতি সহনশীল সহানুভূতিশীল ও সহমর্মিতা দেখাতেন আজকের বাংলাদেশে এতটা বিভাজিত সমাজ কায়েম হতো না।
এই বিভাজনের সবচেয়ে বেশি দায় আওয়ামী লীগের। তারাই একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। দেশের সরকারে ও ক্ষমতায় তারাই বেশিকাল অতিবাহিত করেছে। এবং এটা করে বদনাম ছাড়া আর তেমন কিছুই তাদের অর্জন নেই। আওয়ামী লীগের শাসনকাল মানেই বিরোধীমতের প্রতি দমন-পীড়ন এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থার জোরজবরদস্তি। এতে লাভটা কার হয়? হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে নিয়েছে আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর স্তাবক, চাটুকার ও লুটেরার দল। বাকি সাধারণ আওয়ামী লীগারদের জীবন তাদের কারণে দুর্বিষহ হয়ে গেছে। অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে নেতারা পালিয়ে বেঁচেছে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তারা আরাম আয়েশে কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু একজন প্রান্তিক মানুষ যিনি বংশ পরম্পরায় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগ করে গেছেন কিছু পাওয়ার আশা না করেও, তাদের অবস্থাটা কোথায় নামিয়ে রেখে গেছেন শেখ হাসিনা তা কি একবারও তাদের ভাবনায় আসছে?
জনগণ দ্বারা বিতাড়িত হওয়ার পরও আওয়ামী হেডম্যানদের দম্ভ ও অহমিকা এতটুকু কমেনি। তাদের শাসনতান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এতগুলো প্রাণ অকালে ঝরে গেল -এমন বিয়োগান্তক ঘটনা নিয়ে কোনো অনুশোচনা তাদের মধ্যে দেখিনি। এখনো তাদের উদ্ধত রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে ড. ইউনূসকে এই করবেন, বিএনপিকে সেই করবেন, সেনাবাহিনীকে দেখিয়ে দেবেন এইসব তথাকথিত উল্লম্ফনকে ঘিরে।
কিন্তু বাস্তবতা বড়ই বেরহম। আওয়ামী লীগ গেল ১৫ বছরে ভিন্নমতের প্রতি এমন কোনো ফিলাথ্রোপিক এটিচ্যুড দেখায়নি যে, কোনো ফেরেশতারা ভালোবেসে তাদেরকে বাংলার মসনদে চট করে বসিয়ে দেবে।
ঠিক এইখানটাতেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক দূরদর্শিতার বিরাট ফারাক। আওয়ামী লীগের এত নির্যাতন সয়েও বিএনপি তবু পরিস্থিতি অ্যানালাইসিস করে বুদ্ধিমত্তার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা ধরে রেখেছে। অপরদিকে অতি লোভে আওয়ামী লীগের সমস্ত বুদ্ধি লোপ পেয়েছে।
গেল ১৫ বছরের অধিককাল আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির ওপর হেন জুলুম নাই যেটা করেনি। গুম, খুন ও ক্রসফায়ারের বড় শিকার বিএনপি নেতাকর্মীরাই। গেল তিনটি জাতীয় নির্বাচনে কলাকৌশলে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করেছে আওয়ামী লীগ। যদিও লুটেরা আওয়ামী লীগের তুলনায় জনপ্রিয়তায় বঞ্চিত বিএনপিই এগিয়ে ছিল। বাংলাদেশের মানুষ ৫ বছরের বেশি একদলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। কেউ রাবণ দোষ মুক্ত না।
এইসময় কোথাও কোথাও আধিপত্যকেন্দ্রিক পূর্ব শত্রুতার জেরে বিএনপির লোকজনের হাতে আওয়ামী লীগ কর্মীরা নিগৃহীত হচ্ছে। কিন্তু সেটা সরকার কর্তৃক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের বানানো ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার তুল্যমূল্যে বড় কিছু না। তারপরও ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগ ওই বিএনপিকে তাদের শত্রু বানিয়ে রেখেছে। পক্ষান্তরে বিএনপি কী করছে? আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণে আপত্তি জানিয়েছে। সংবিধান সমুন্নত রাখবার কথা বলছে।
দ্য ডেইলি স্টার জানিয়েছে, বিএনপি উদার রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক দল উল্লেখ করে দলটির যুগ্ম মহাসচিব ও নরসিংদী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক খায়রুল কবির খোকন গতকাল শুক্রবার বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি আছে কিন্তু আমরা নিষিদ্ধ চাই না। আমরা নিষিদ্ধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। বিএনপি চায় সব প্রতিপক্ষ নির্বাচনে আসুক। জনগণ আমাদের পক্ষে আছে, আমরা ভয় পাই না।'
শুক্রবার সন্ধ্যায় সদর উপজেলার করিমপুর খেলার মাঠে আয়োজিত কর্মী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
খায়রুল কবির বলেন, 'আমরা মানবাধিকারে বিশ্বাস করি, মানুষের মৌলিক অধিকারে বিশ্বাস করি, আমরা সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে চাই। বিএনপি সব সময় জনগণের ম্যানডেট নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে। আমরা ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চাই না। আগামী দিনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে, ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে,' যোগ করেন তিনি।
নিরুদ্দেশ আওয়ামী লীগ তোমাদের এবার অন্তত লজ্জিত হওয়া উচিত। হাজার মানুষের রক্তের ঋণ চুকিয়ে রাজনীতিতে ফিরতে চাইলে ২১ আগস্ট পেছনে ফেলে তারেক জিয়া আর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছ থেকে রাজনৈতিক পাঠ নাও। মানবাধিকার নিয়ে কিভাবে কথা বলতে হয় শেখো। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে দুই নেত্রীর সমন্বিত আন্দোলনের স্মৃতি রোমন্থন করো। একাল কিংবা সেকাল -জীবনে তো বদনাম ছাড়া আর কিছুই কুড়াতে পারলে না। মেঘনাদকে হারিয়ে লঙ্কার রাজা রাবণেরও খুব অনুশোচনা হয়েছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্তের 'মেঘনাদবধ কাব্য' তোমরা পড়ো না আওয়ামী লীগ?
-ফারদিন ফেরদৌস
২৬ অক্টোবর ২০২৪