পোস্টস

চিন্তা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তা লালন করবে

২৭ অক্টোবর ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

আজ প্রথম আলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খানের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, মুক্তচিন্তার সঙ্গে উচ্চশিক্ষার সম্পর্ক মৌলিক এবং অলঙ্ঘনীয়। যেকোনো রকম মুক্তচিন্তাকে আমরা লালন করব।

অধ্যাপক খানকে অনেকেই জামায়াত ঘরাণার শিক্ষক বলে দাবি করছেন। তিনিই কিনা মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ৭৩ এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের কথা বলছেন। অথচ আওয়ামী লীগের নিয়োগকৃত উপাচার্যরা হেফাজতের ডরে মুক্তিচিন্তা শব্দটি মুখে উচ্চারণ করতে তিনবার ভাবত। এই বুঝি মৌলভিরা শাপলা চত্বর ঘেরাও করে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য তাঁর শিক্ষাগত ও পেশাগত জীবনের যেকোনো পর্যায়ে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ কিংবা দলের সাথে প্রত্যক্ত সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন। ছাত্র রাজনীতিকে ডাকসুকেন্দ্রিক এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের রাজনীতিও ক্যাম্পাসভিত্তিক রাখবার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির বিরোধী তিনি।

প্রথম আলোর প্রশ্ন ছিল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররাজনীতিমুক্ত থাকবে—সিন্ডিকেটের এমন একটি সিদ্ধান্তের কথা গণমাধ্যমে এসেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি এখন ছাত্ররাজনীতিমুক্ত?

নিয়াজ খান উত্তর দিয়েছেন: সাধারণ ছাত্রদের দাবি হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি যেন ফেরত না আসে। লেজুড়বৃত্তির ফলে যে নিপীড়ন হয় এবং অপরাজনীতির ধারা গড়ে ওঠে, সেটা যেন আর না হয়। আমাদের প্রাথমিক চিন্তা ছাত্ররাজনীতি হবে ডাকসুকেন্দ্রিক। ডাকসুকে আমরা পুনরুজ্জীবিত করতে চাই, সংস্কার প্রয়োজন হলে সেটা করতে চাই।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ ও সংবিধিবদ্ধ কাঠামোর মধ্যে ছাত্র ও শিক্ষকের অধিকারভিত্তিক রাজনীতি রাখতে চাই। এটা নেতৃত্বের চর্চা ও গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য প্রয়োজন।

অন্তর্বর্তী সরকারের সভাসদরা যেখানে রীতিমতো রিসেট বাটন টিপে বাহাত্তরের‌ সংবিধান বাতিলের খাতায় রেখে দিচ্ছেন, সেই সরকারের নিয়োগকৃত উপাচার্য ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ সুরক্ষিত রাখবার কথা বলছেন। দেখা যাক ভিসি মহোদয় কতটা কী করতে পারেন। কেন্দ্রের সাথে বিরোধ তৈরি করা তাঁর অভিপ্রায় নেই নিশ্চয়ই।

জন আকাঙ্ক্ষার কথা মাথায় রেখে উপাচার্যকে কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্নও করেছে।

প্রথম আলো: আপনার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে দু-একটি প্রশ্ন করি। ব্যক্তিজীবনে আপনি ধার্মিক। আপনার কোনো রাজনৈতিক অবস্থান আছে কি?

নিয়াজ খান: আমি আমার সারা জীবনে বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। কিছু কথা বলা হচ্ছে, যা নির্জলা মিথ্যা কথা—এটা আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি। আমি এ বিষয়ে সবাইকে জবাব দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করি না। আপনি জিজ্ঞেস করলেন, তাই বললাম।

প্রথম আলো: আপনি পিংক ফ্লয়েডের গান শোনেন। আপনি কি ধর্মচর্চা ও গান শোনার মধ্যে বিপরীতমুখী কোনো অবস্থান খুঁজে পান?

নিয়াজ খান: পিংক ফ্লয়েড, বব ডিলানদের প্রভাব আমাদের তারুণ্যে ছিল। তাঁরা মানুষের অধিকার রক্ষা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, ব্যক্তির চেয়ে সমাজজীবনের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাঁরা বলেছেন, মানুষের সেবা করাই স্রষ্টার সেবা করা। ধর্ম তো এর বিপরীত কিছু বলে না। তাই আমি বৈপরীত্যও দেখি না।

প্রথম আলো: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে নামাজ পড়ার ছবি নিয়ে আপনি আমার সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভজন আয়োজন করা হলে আপনি সেখানেও যাবেন। বিষয়টি নিয়ে পাঠকের উদ্দেশে কিছু বলবেন কি?

নিয়াজ খান: এবার শারদীয় দুর্গাপূজা উৎসবে আমরা প্রশাসনের তরফ থেকে সার্বক্ষণিক তাঁদের সঙ্গে ছিলাম। আমি ব্যক্তিজীবনে ধার্মিক। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য ধর্মাবলম্বী যত শিক্ষক-শিক্ষার্থী রয়েছেন, তাঁদের পুরোপুরি সুরক্ষা দেওয়া, তাঁদের সহায়তা করা, সহায়তা পেতে তাঁদের কাছে যাওয়ার জন্যই তো আমরা এখানে এসেছি। শিক্ষকের ধর্ম ও ব্যক্তিগত মত থাকতে পারে, কিন্তু সেটা তাঁর শিক্ষকতা পেশাকে প্রভাবিত করতে পারে না। তাহলে তিনি শিক্ষক থাকেন না।

প্রথম আলো: আপনার ফেসবুক পেজে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে তোলা ছবি আছে। সেটা দেখে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। ২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নিয়ে আপনি কী বলবেন?

নিয়াজ খান: বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় তৈরি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযুদ্ধ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বড় বড় আন্দোলনের ধারাবাহিকতার মাধ্যমে হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ আমাদের একটি মৌলিক ‘টার্নিং পয়েন্ট’। পরবর্তী সময়ে যখনই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের শক্তি একত্র হয়েছে, সেটা নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন বলি, ’২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বলি, সেগুলো আমাদের জাতীয় জীবনে মাইলফলক। ঘটনাগুলো মনে করিয়ে দেয়, নানা ধরনের বিভেদ থাকার পরও জাতি হিসেবে আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে একত্র হতে পারি। আমি এসব মাইলফলকের মধ্যে কোনো কনফ্লিক্ট (দ্বন্দ্ব) দেখি না।

প্রথম আলো: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়; এটি মুক্তচিন্তা, বাক্‌স্বাধীনতা, প্রগতিশীলতা ও সংস্কৃতির একটি কেন্দ্র। আগামী দিনগুলোতে সেখানে কি কোনো ছেদ পড়বে বলে আপনি মনে করেন?

নিয়াজ খান: ছেদ করার আমি কে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বজনতার বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্তচিন্তার সঙ্গে উচ্চশিক্ষার সম্পর্ক মৌলিক এবং অলঙ্ঘনীয়। যে উচ্চশিক্ষা মুক্তচিন্তার সুযোগ করে দেয় না, সেটাকে উচ্চশিক্ষা বলা যাবে না। আমি আন্তরিকতার সঙ্গে বলছি, যেকোনো রকম মুক্তচিন্তাকে আমরা লালন করব।

নিয়াজ আহমদ খান চমৎকার বলেছেন, শিক্ষকের ধর্ম ও ব্যক্তিগত মত থাকতে পারে, কিন্তু সেটা তাঁর শিক্ষকতা পেশাকে প্রভাবিত করতে পারে না। তাহলে তিনি শিক্ষক থাকেন না। তিনি আরো বলছেন, বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয় তৈরি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। এবং ফাইনালি তিনি বললেন, যে উচ্চশিক্ষা মুক্তচিন্তার সুযোগ করে দেয় না, সেটাকে উচ্চশিক্ষা বলা যাবে না।

শুধু কথার কথা বিবেচনা না করে 
এই সুবচনগুলো যদি বাস্তবিকভাবেই মান্যতা দেন উপাচার্য তাহলে আমাদের গণের আকাঙ্ক্ষার অনুবর্তীই তিনি থাকবেন। এই বিবেচনায় উপাচার্য যদি অন্তর্গতভাবে জামায়াত ঘরাণার হয়ে থাকেন তাতে কার কী? একমাত্র খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বাদে আওয়ামী লীগের বহু উপাচার্য দেখেছি যারা নেপোটিজম ও করাপশনে আকন্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন। 
চক্ষুলজ্জা, নীতি-নৈতিকতা, বিবেক-বোধ ও কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের মাথা খেয়ে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে অযোগ্যতা সত্ত্বেও স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, ভাগ্নে, জামাতা; এমনকি বাসার গৃহ সহায়ককেও চাকরি দিয়েছিলেন। সবই করেছেন দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছদ্মাবরণে।

তেমনটা না হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান যদি গণ আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁর দেয়া কথায় অটল ও অনড় থাকতে পারেন, শিক্ষা ও গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বৈশ্বিক মানে উন্নীত করতে পারেন এবং সেখানকার ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদেরকে সভ্যতা শেখাতে পারেন; আমরা স্যারের ইতিবাচক সকল কর্মকাণ্ডকে সাধুবাদ জানাবো।

লেখক: সাংবাদিক 
২৭ অক্টোবর ২০২৪