পোস্টস

চিন্তা

নেতার অহমিকা কর্মীর দুর্বিপাক

২৮ অক্টোবর ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসে হতে চলল, দেশজুড়ে মব ভায়োলেন্স এখনো চলছে। 
গণ আক্রোশ স্তিমিত হয়নি। এর বেশিরভাগ শিকার হচ্ছে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ সদস্যরা। আজও রাজশাহী সরকারি কলেজের এক নারী শিক্ষার্থীকে চুলের মুঠি ধরে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেয়া হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা শামীম মোল্লার মতো এই ছাত্রীর প্রাণ বিপন্ন হয়নি। জুলাই আন্দোলনে বিতর্কিত ভূমিকায় দুষ্ট ছাত্রলীগের প্রতি খুব সঙ্গত কারণেই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বাধীন ইন্টেরিম গভমেন্ট দায় ও দরদ দেখাবে না। এমনকি আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীরাও ক্ষমতাসীনদের চক্ষুশূল থাকবে। বিজয়ীরা চরমভাবে পরাজিতের প্রতি কোনো অনুকম্পা দেখায় না। প্রাচীন রোমানদের গ্লাডিয়েটর যুগেও এটা সত্যি ছিল। এমনটা নয় যে, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ মিছিল মিটিং করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হচ্ছে। ছাত্রলীগ এখন রুটিন ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নেয়া দূরে থাক নিজের ক্যাম্পাস প্রেমিজেই ফিরতে পারছে না। হয় তারা গ্রেফতার হচ্ছেন, নাহয় মব ভায়োলেন্সের শিকার হতে হচ্ছে।

আল জাজিরার খবর থেকে জানা যাচ্ছে, প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থীর জীবন মারাত্মক অনিশ্চয়তায় পড়েছে। ভবঘুরে হয়ে ফেরারি জীবনযাপন করছেন অনেকেই। যদিও ফৌজদারি অপরাধে জড়িত একজন ব্যক্তিরও লেখাপড়ার মতো মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করবার কথা দেশের প্রচলিত আইনেই বলা আছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী?

প্রথমত আওয়ামী লীগকে বাস্তবতা মেনে নিতে হবে যে তারা আর ক্ষমতায় নাই। তাদেরকে বুঝতে হবে অক্ষমের বাগাড়ম্বরপূর্ণ আস্ফালন চলে না। ভুল করলে ভুল স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করতে হয়। নমনীয় হতে হয়। কিন্তু পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনার লেশ মাত্র দেখা যায়নি। দম্ভ ও অহমিকায় এখনো তারা সোশ্যাল মিডিয়া ভরিয়ে রাখছে। কার্যত এই অ্যাটিচ্যুডেরই বিরূপ ফল ভোগ করতে হচ্ছে প্রান্তিক আওয়ামী লীগ কর্মীদের।

ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে কামিয়ে লাখো টাকা খরচায় রাতারাতি ভেগে গেছে আওয়ামী লীগ নেতারা। তারা এখন বিদেশ বিভূঁইয়ে পার্কে ঘুরছেন, আয়েশ করে কফিশপে গলা ভেজাচ্ছেন, মাজারে গিয়ে দয়াল বাবার কৃপা প্রার্থনা করছেন।

তারা মানতেই পারছেন না যে, তারা এখন আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নেই। তাদের বুঝেই আসছে না যে, অক্ষমের এমন বিপজ্জনক আস্ফালন চলে না।

অথচ জুলাই আন্দোলনে হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এবং তারও অধিক জখম হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করা বিপন্ন মানুষকে পরিবারগুলো বয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের জন্য আওয়ামী নেতৃত্ব যদি সামান্যতম শোকগ্রস্তও হতো, ভুল স্বীকার করে বিপন্ন পরিবারগুলো ও দেশবাসীর কাছে দুঃখপ্রকাশ করত, আন্দোলনে বিজয়ী পক্ষের আক্রোশ খানিকটা হলেও প্রশমিত হতো। ভয়ঙ্কর পাষাণের মনেও কোমল এক হৃদয় বাস করে। ১৫ বছরের অধিককাল নিপীড়নের শিকার হয়েও জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান প্রকাশ্য ঘোষণায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দিয়েছিল। কিন্তু দাম্ভিকতা ও আত্মম্ভরিতায় ভোগা আওয়ামী লীগ সেসব গ্রহণ করে নিজেদের অতীত ভুলকে বিশুদ্ধতায় পরিবর্তিত করতে চায়নি।

আওয়ামী লীগ বুঝল না, টাকার গরম দেখিয়ে তাদের কর্তাব্যক্তিরা ভেগে যেতে পেরেছেন। দেশে রয়ে গেছেন নিরীহ সাধারণ সদস্য। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেয়া যুবরাজেরা যত মাল কামিয়েছেন, একজন প্রান্তিক কর্মীর কপালে ডে লেবারের মজুরি ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। আর এখন পয়সাওয়ালারা সীমান্ত পার হয়ে মাস্তি করছেন। ধরা খেয়ে মার খাচ্ছেন দিনমজুর প্রান্তিক আওয়ামী লীগাররা।

অথচ আপনাদের বড়দের মধ্যে যদি ন্যূনতম অনুশোচনা থাকত, পরিবেশ ভিন্নতরও হতে পারত। বাঙালি ক্ষমাশীল না একথা তার শত্রুরাও বলবে না। একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে আমরা শুধু ক্ষমাই করিনি কোলে করে আদর করতেও এখন অর দ্বিধা করি না। এরশাদের নিপীড়নও আমরা মনে রাখিনি। এমন এক বাস্তবতায় আওয়ামী যদি নিজেকে না বদলায়, জুলাই আন্দোলনের দায় না নেয়; তাদের বিপন্নতায় কারো সহানুভূতিই তারা পাবে না।

মানুষ ভুল করে। ১৫ বছরের অধিককাল ক্ষমতার গরমে বহু ভুল আওয়ামী লীগও করে গেছে। ক্রমাগত ডিনায়াল, দম্ভ ও অহমিকাই আওয়ামী লীগের তরি ডুবিয়ে দিয়েছে।

মানুষের অসাধ্য কিছুই নেই। 
মানুষ ভুল শোধরাতে পারে না এমন নয়। 
আজকে যারা আওয়ামী ফ্যা'সিজম ও বিচিত্র দুর্নীতির কড়া সমালোচক, বিচার-সালিশ-রায় শেষে সেই তারাই আওয়ামী লীগের সাথে গোলটেবিল বৈঠক করবে না এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না। রাজনীতিতে শেষ কথা বলেও কিছু নেই। Time is great healer and revealer.

যদিও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে থাকা কোনো কোনো নেতা বিপ্লব বেগবান করতে পুলিশ হ'ত্যা ও জ্বালাও পোড়াওয়ের ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ত থাকবার কথা স্বীকার করেছে, তবু ব্যর্থতার পুরোভার ওই আওয়ামী লীগ সরকারেরই। এখন পর্যন্ত দলের শীর্ষ নেতার যে ছিটেফোঁটা কথাবার্তা বের হয়েছে সেটি যদি সত্যি হয়ে থাকে, সেখানে আমরা দেখলাম বিষোদগার আর দেখে নেয়ার হুমকি।

নিরাপদ অবস্থানে থেকে কেবল নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলার নাম রাজনীতি না। অনুসারীদের বিপদে ফেলে যারা নিরুদ্দেশ হয়ে যায় তাদের কোনো অধিকার বা যোগ্যতা নেই নেতৃত্ব দেয়ার। দেশের কথা বাদই দিলাম। আওয়ামী লীগ যদি তার নিষ্ঠ কর্মীদের কাছে আবার হাত পাততে চায়, দুয়ারে পদচারণা করতে চায়; তারা তাদের জুলাই কর্মকাণ্ডের জন্য যেন অনুশোচনা অনুভব করে এবং সশ্রদ্ধচিত্তে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এতে তাদের কর্মীরাও বাঁচবে, ঈশ্বর চাইলে সমাজে তারাও মুখ দেখাতে পারবে। অন্যথায় পতনের ঘূর্ণাবর্ত থেকে তারা ফিরে আসবার ফুরসত পাবে না।

লেখক: সাংবাদিক
২৭ অক্টোবর ২০২৪