অ্যান্ডি ওয়ারহল যখন ১৫ মিনিটের খ্যাতির কথা বলেছিলেন, তখন তিনি হয়তো ভাবতেও পারেননি যে, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এই খ্যাতি এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। সে সময়তো সোশ্যাল মিডিয়া ছিলই না। ইনস্টাগ্রাম, টিকটক বা ইউটিউবের যুগে, যে কেউ একটি ভিডিও বা পোস্ট দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে। একদিনের জন্য ভাইরাল হয়ে ওঠা একটি ভিডিও বা মিমের মাধ্যমে যেকেউই যখন তখন বিখ্যাত হতে পারতেছে, কিন্তু তারপর? এই খ্যাতি খুবই ক্ষণস্থায়ী। এটি এক ধরনের গণমাধ্যমের মজা নেয়ার মত ব্যাপার, যেখানে এই মুহূর্তে আপনি সবার আলোচনার কেন্দ্রে, তো আরেক মুহূর্তে আপনি হারিয়ে যান।
পপ আর্ট এবং এ্যান্ডি ওয়ারহল
ওয়ারহল মূলত পপ আর্টের সবচাইতে গুরুত্বপুর্ন চরিত্রের একজন। পপ আর্ট হইতেছে ৫০-এর দশকের একটা আর্ট মুভমেন্ট। পপ আর্টের মূল ধারাটি গড়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, যখন শিল্প ও সংস্কৃতিতে একধরনের সামাজিক পরিবর্তন দেখা দিতে থাকে। শিল্পীরা অনুভব করলেন যে, ঐতিহ্যবাহী ফাইন আর্ট বা 'উচ্চমানের' শিল্পকর্ম দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সঠিকভাবে যুক্ত নয়। ফলে, তারা জনপ্রিয় সংস্কৃতি, টেলিভিশন, সিনেমা, বিজ্ঞাপন, কমিক বই, এবং বাজারজাত পণ্যের মতো উপকরণ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তাদের শিল্পকর্ম তৈরি শুরু করেন অ্যান্ডি ওয়ারহল এবং রয় লিচেনস্টাইনের মতো ব্যক্তিত্বরা। এই লোকগুলো এ্যাডভার্টাইজিংয়ের সাথে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত থাকায় তারা প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন আইটেম, পপুলার কালচার, সেলিব্রিটি, এবং বাণিজ্যিক পণ্যগুলোকে শিল্পের অংশ হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে পপ আর্টকে একটা মুভমেন্টে পরিণত করেন। যেটার একটা অদ্ভুত কম্বিনেশন হয় এ্যাডভারটাইজিং, কমার্শিয়াল আর্ট/গ্রাফিক ডিজাইন এবং পপুলার আর্টের একটা কম্বিনেশন হওয়ার মাধ্যমে।
পপ আর্ট মুভমেন্টের মূল উদ্দেশ্যটা ছিল সাধারণ বস্তুকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করা! এক্সাক্টলি যে কাজটা গ্রাফিক ডিজাইন ইন্ডাস্ট্রিতে করে থাকে। যেকারনে একটা সময় যাওয়ার পর পপ আর্টের প্রভাব গ্রাফিক ডিজাইন ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যাপকভাবে পড়ে। যেমনঃ
বোল্ড কালার প্যালেট: পপ আর্টের রঙ ব্যবহারের ধরন—যেমন উজ্জ্বল এবং গাঢ় কালার—গ্রাফিক ডিজাইনেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি ডিজাইনকে দ্রুত নজরে আনতে সাহায্য করে।
রিপিটিশন এবং প্যাটার্ন: পপ আর্টে রিপিটিশন এবং মিস-এলিমেন্টের মাধ্যমে ভিজ্যুয়াল প্রভাব তৈরি করা হয়, যা বিজ্ঞাপনের ক্যাম্পেইন বা পোস্টারের ক্ষেত্রে গ্রাফিক ডিজাইনাররা প্রায়ই ব্যবহার করে।
টাইপোগ্রাফির এপিক ব্যবহার : পপ আর্ট যেমন বিভিন্ন ফন্ট ও টাইপোগ্রাফি নিয়ে কাজ করেছিল, গ্রাফিক ডিজাইনেও টাইপোগ্রাফি একটি বিশাল ভূমিকা পালন করে।
বাণিজ্যিক পণ্য: পপ আর্ট বাণিজ্যিক পণ্যকে যেমন একটি আইকনিক আর্টফর্মে রূপান্তর করেছে, তেমনিভাবে গ্রাফিক ডিজাইনও বিজ্ঞাপন এবং পণ্যের প্যাকেজিংকে একটি শিল্পমাধ্যমে রূপান্তরিত করে।
পপ আর্টিস্টদের কাজ(পপ আর্ট) পরে প্রমাণ করে যে বাণিজ্যিক পণ্য আর কেবলমাত্র কনজিউমারের জন্যে জাস্ট একটা একটা প্রোডাক্ট নয়, এটি আমাদের কালচারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হচ্ছে। বিজ্ঞাপনের কাজ যেমন মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা, ঠিক তেমনই ওয়ারহলও শিল্পের মাধ্যমে এক ধরনের "বিজ্ঞাপন" করেছেন, যেখানে পপ আর্ট হইতেছে এক ধরনের আর্টেরই বিজ্ঞাপন!
সোশ্যাল মিডিয়া এবং "১৫ মিনিটের খ্যাতি"
ঠিক এসময়ে ওয়ারহলের আলাপ ছিল ছিল যে, সমাজে যেভাবে গণমাধ্যম এবং বিজ্ঞাপন কাজ করছে, তা এক সময়ে সবার জন্য বিখ্যাত হওয়ার সুযোগ তৈরি করবে কারণ পপ আর্ট আর বিজ্ঞাপনের কাজ হচ্ছে মানুষের মনোযোগ আকর্ষন করা। সুতরাং বিজ্ঞাপন যেহেতু পণ্য কিংবা ভোক্তার জন্যেই তৈরি হয় সেহেতু এটা সবার জন্যেই তৈরি হতে পারে। কারণ দুনিয়াতে সবাই ভোক্তা! পপ আর্টের ভাষায়, "সেলিব্রিটি" শব্দটির অর্থ কেবলমাত্র বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের জন্য সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিজ্ঞাপন এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে যে কেউ খুব অল্প সময়ের জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। হিরো আলমের কথাই কিন্তু ভাবতে পারেন।
ওয়ারহলের ভবিষ্যদ্বাণী সোশ্যাল মিডিয়া আসার পর যেন আরও সত্যে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক এবং ইউটিউবের যুগে, খুব সহজেই যে কেউ মুহূর্তের মধ্যেই বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারে। একটি ভিডিও ভাইরাল হতে পারে, একটি পোস্ট লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে এবং এক মুহূর্তে যিনি অজানা ছিলেন, তিনি হঠাৎ করেই লক্ষ মানুষের নজরে আসতে পারেন। কিন্তু এই খ্যাতি যেমন হঠাৎ আসে, তেমনি দ্রুত চলে যায়। যেমন যদি এখনকার সময়ে খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন কারো ব্যক্তিগত পোষা কুকুরের ইনস্টাগ্রামেও অনেক অনেক ফলোয়ার।
অ্যান্ডি ওয়ারহল তার কাজের মধ্য দিয়ে সমাজের গভীর সমস্যাগুলোকে যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি প্রভাবশালী ট্র্যাডিশনাল মাধ্যমগুলোর ব্যবহারেও প্রশ্ন তুলেছেন। পপ আর্ট ছিল সেই মাধ্যম যা সমাজের গণমাধ্যম, কনজিউমার কালচার এবং ফেম-এর উপর একধরনের এপিক স্যাটায়ার হিসেবে কাজ করে বেশির ভাগ সময়ে। এটি আমাদের বর্তমান সামাজিক বাস্তবতা এবং খ্যাতির প্রকৃতি এবং স্থায়িত্ব সম্পর্কে গভীর চিন্তা করার সুযোগ দেয়। রেফারেন্স হিসেবে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর যেকোনো দেশের কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের গারবেজ লেভেলের কন্টেন্ট প্রোডিউস করার পরও অনেক ফলোয়ার পাওয়ার যে ব্যাপারটা সেটাও চিন্তা করতে পারেন।
সময়ের পরিক্রমায় আর্টের অনেক অনেক মুভমেন্ট হইছে। আর্ট মুভমেন্ট নিয়ে একটা সামগ্রিক আইডিয়া পাইতে চাইলে গুগুল আর্ট এ্যান্ড কালচারের এই লিংকে ক্লিক করে জানতে পারেন। এই যেমন এখন সারা দুনিয়ার AI আর্টের একটা মুভমেন্ট চলতেছে এইটা আরও কিছুদিন পর যখন একটা জায়গায় আর্টিকুলেশন করে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ দেয়া হবে তখন এইটা ঠিক আর্ট মুভমেন্টের ইতিহাসে বিশাল একটা জায়গা জুড়ে নেবে।
১৫ মিনিটের খ্যাতি- ধারণাটি কেবলমাত্র সামাজিক মিডিয়া বা বিজ্ঞাপন শিল্পের সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের সামগ্রিক জীবনের একটি ব্যাখ্যা, যেখানে প্রতিদিন আমরা কিছু সময়ের জন্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি, যেমন আমি আমার চিন্তাগুলোকে লিখিতরূপে এখানে জানানোর চেশটাও এটার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু, ওয়ারহলের এই আলাপটা আমাদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পারসপেকটিভ দেয় যে, খ্যাতি হয়তো অস্থায়ী, কিন্তু এর প্রভাব চিরস্থায়ী।