পোস্টস

চিন্তা

স্পাইরাল ডায়নামিক্স: মানুষের চিন্তাভাবনার স্তরভিত্তিক বিবর্তন!

২৯ অক্টোবর ২০২৪

আল ইমরান

গত ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে যেসকল বিষয় নিয়ে পড়াশোনা, ভিডিও এসব থেকে যেসব বিষয় নিয়ে কিছু ধারনা অর্জন করেছি এর মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ন বিষয় হইতেছে স্পাইরাল ডায়নামিক্স। আমি এর আগে যখন য়ুনিভার্সিটিতে থাকতে মাসলোর হায়ারার্কি নিয়ে প্রথমবার জানছিলাম তখন এইটা ব্যক্তিগত চাহিদার ব্যাপারে আমার চিন্তাভাবনাকে একটা দারুণ ক্ল্যারিটি দিয়েছিলো। ঠিক একইভাবে স্পাইরাল ডায়নামিক্স ব্যাপারটা বুঝার পর (এইটা একটা বিশাল টপিক, এখনও সব বুঝি নাই) আমার স্যারাউন্ডিং, আশেপাশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আরও কিছু বিষয়পত্র নিয়ে কিছু ইন্টারেস্টিং ধারনা করতে পারতেছি যেটা মজা লাগতেছে। আজকে এই ব্যাপারে আমার ফিল্টার করা কিছু আন্ডারস্ট্যান্ডিং থেকে কিছু আলাপ দিতে চাইতেছি।

 

এক লাইনে যদি বলি তাইলে স্পাইরাল ডাইনামিক্স হইতেছে মানব চেতনার একটা স্তরভিত্তিক বিবর্তন!

 

মানুষের চেতনা এবং সমাজের বিকাশ একটি জটিল প্রক্রিয়া। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা এবং বিশ্বাসের এই পরিবর্তনগুলো বোঝা সবসময় সহজ নয়। বিভিন্ন পরিস্থিতি, চাহিদা এবং অভিজ্ঞতার ফলে আমরা কিভাবে নিজের চিন্তা ও বিশ্বাসকে গড়ে তুলি এবং পরিবর্তিত হই তা বোঝার জন্য অনেক গবেষণা এবং তত্ত্ব প্রস্তাবিত হয়েছে। এর মধ্যে স্পাইরাল ডাইনামিক্স (Spiral Dynamics) একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, যা মানুষ এবং সমাজের চেতনার বিবর্তন নিয়ে আলোচনার করার একটা দারুণ টুল বলা যাইতে পারে।

 

 

এই তত্ত্বটি মূলত ক্লেয়ার গ্রেভস প্রস্তাব করেছিলেন এবং পরবর্তীতে ডন বেক এবং ক্রিস্টোফার কোয়েন এটিকে আরও ডেভেলপ করেন। স্পাইরাল ডায়নামিক্স তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের মানসিকতা এবং মূল্যবোধ ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয় এবং এই বিবর্তন বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত, যেগুলো প্রতিটি একেকটি রঙের মাধ্যমে বোঝানো হয়। প্রতিটি স্তরের একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য এবং দৃষ্টিভঙ্গি থাকে যা মানুষের চিন্তার বিবর্তনের প্রতিফলন। চলেন স্তরগুলো নিয়ে হালকা পাতলা ধারনা নেয়া যাক।
 

এই থিওরিতে প্রতিটি স্তর রঙের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়, এবং প্রতিটি রঙ একধরনের বিশেষ চেতনার প্রকাশ।

বেইজ (Beige): বেঁচে থাকার স্তর
এই স্তর মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোকে (খাদ্য, আশ্রয়, সুরক্ষা) পূরণের দিকে মনোনিবেশ করে। এটি বেঁচে থাকার প্রথমিক এবং প্রাথমিক স্তর যেখানে মানুষ স্বপ্রণোদিতভাবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের জীবনধারা।

পার্পল (Purple): গোষ্ঠীগত নিরাপত্তার স্তর
এখানে মানুষ গোষ্ঠীগত নিরাপত্তা এবং বিশ্বাসের প্রতি মনোযোগী হয়। পরিবার, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য এবং ঐতিহ্য মেনে চলা এখানে প্রধান বিষয়। এটি বিশ্বাস, রীতিনীতি এবং ঐতিহ্যের মাধ্যমে জীবনের মানে খোঁজার একটি পর্যায়।

রেড (Red): ক্ষমতার স্তর
এই স্তরে মানুষ ক্ষমতা, প্রভাব এবং কর্তৃত্ব অর্জনের চেষ্টা করে। এখানে আত্ম-কেন্দ্রিকতা এবং ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা পূরণের প্রাধান্য থাকে। এটি স্বার্থপর আচরণের স্তর যেখানে শক্তি এবং কর্তৃত্ব প্রদর্শন জরুরি হয়ে ওঠে।

ব্লু (Blue): নিয়ম এবং কর্তব্যের স্তর
ব্লু স্তরে জীবনকে নিয়ম, কর্তব্য এবং উচ্চতর উদ্দেশ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা হয়। এখানে মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক এবং নৈতিক নিয়মের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস থাকে। এটি একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ স্তর যেখানে ন্যায় এবং নিয়মানুবর্তিতা গুরুত্বপূর্ণ।

অরেঞ্জ (Orange): স্বাধীনতা এবং সাফল্যের স্তর
অরেঞ্জ স্তরে মানুষ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং সফলতা অর্জনের চেষ্টা করে। এটি যুক্তিবাদী এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত, যেখানে মানুষ অর্জন এবং উদ্ভাবনের প্রতি মনোযোগ দেয়।

গ্রিন (Green): সমতা এবং মানবিকতার স্তর
গ্রিন স্তর মূলত মানবিকতা, সমতা, এবং সম্প্রদায়ের দিকটিকে তুলে ধরে। এখানে মানুষ পারস্পরিক সম্পর্ক, সাম্য, এবং সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি গুরুত্ব দেয়। এটি সমাজের প্রত্যেকের মতামতকে গুরুত্ব দেয়।

ইয়েলো (Yellow): সিস্টেম এবং আন্তঃসংযোগের স্তর
ইয়েলো স্তরে মানুষ একটি জটিল সিস্টেমকে গভীরভাবে বুঝতে এবং সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করে। এটি বিভিন্ন স্তরের চেতনার পারস্পরিক সংযোগ এবং গতিশীলতা বোঝায়। এখানে স্বাধীন চিন্তা, নমনীয়তা, এবং সমস্যা সমাধানের নতুন পদ্ধতির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

টারকোয়াইজ (Turquoise): মহাবিশ্বের সাথে সংযোগের স্তর


এই স্তরে মানুষ সমগ্র বিশ্ব এবং মহাবিশ্বের সাথে সংযুক্তি অনুভব করে। এটি সবকিছুর একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে সমগ্রতার প্রতি মানুষের আস্থা থাকে এবং তারা একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করে।

Spiral Dynamics Model

 

এই তত্ত্বের মাধ্যমে বেশিরভাগ জিনিসপত্রের সাথে আপনি একটু চিন্তাভাবনা করলেই ভালোমত রেজনেট করতে পারবেন। এইখানের সবচাইতে গ্রাউন্ডব্রেকিং আইডিয়াটাই হইতেছে চিন্তার এই মডেল অনুযায়ী সমাজের একজন ব্যক্তি একইসাথে ভিন্ন ভিন্ন স্তরে অবস্থান করতে পারে। খুবই ভিন্নধর্মী হইলেও এই ধারনাটাই সবচাইতে এপিক!

আমরা সাধারণত মানুষকে একমাত্রিকভাবে বিচার করি—একজন ব্যক্তি হয়তো প্রগতিশীল, ঐতিহ্যগত, কিংবা আধুনিক চিন্তাধারার বলে মনে করি। কিন্তু স্পাইরাল ডায়নামিক্স এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে, একজন ব্যক্তির ভেতরেই একাধিক স্তরের চিন্তা এবং মানসিকতার মিশ্রণ থাকতে পারে।

 

কীভাবে একজন ব্যক্তি একাধিক স্তরে অবস্থান করতে পারে?

 

প্রথমে স্পাইরাল ডায়নামিক্স তত্ত্বে যে বিষয়টি গুরুত্ব পায় তা হলো, প্রতিটি স্তর একটি নির্দিষ্ট ধরণের মূল্যবোধ বা চেতনার সাথে সম্পর্কিত। যেমন—পার্পল স্তর হলো ঐতিহ্য এবং কমিউনিটির প্রতি আস্থা, অরেঞ্জ স্তর হলো ব্যক্তিগত অর্জন এবং সাফল্যের প্রতি মনোযোগ, এবং গ্রিন স্তর হলো সমতা ও মানবিকতার উপর ভিত্তি করে।

যখন একজন ব্যক্তি তার জীবনের বিভিন্ন অংশে এই ধরনের আলাদা আলাদা মূল্যবোধ ধারণ করে, তখনই দেখা যায় যে, সে একাধিক স্তরে অবস্থান করছে। উদাহরণস্বরূপ:

মিস্টার X হয়তো তার পারিবারিক জীবনে পার্পল স্তরের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, যেখানে সে ঐতিহ্য এবং পারিবারিক মূল্যবোধকে খুবই গুরুত্ব দেয়। হয়তো সে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান মেনে চলে এবং পারিবারিক ঐতিহ্যকে সম্মান করে।

কিন্তু তার কর্মজীবনে, সে সম্পূর্ণরূপে অরেঞ্জ স্তরের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। এখানে সে সাফল্য এবং ব্যক্তিগত অর্জনের দিকে মনোযোগী, স্ট্রাটেজিক চিন্তাভাবনা করে, এবং উদ্ভাবন ও সাফল্য তার মূল চালিকা শক্তি।

আবার সেই একই ব্যক্তি আবার সামাজিক কর্মকাণ্ডে গ্রিন স্তরের বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে পারে, যেখানে সে সামাজিক সমতা, মানবিক মূল্যবোধ, এবং সাস্টেইনেবল এনভায়রনমেন্ট নিয়ে চিন্তা করে।

সে হয়তো এনজিওর কাজ করে, পরিবেশ রক্ষা নিয়ে সচেতন, কিন্তু সে পলিটিক্যাল চিন্তাভাবনায় খুবই এ্যানিমালিস্টিক! চোখের সামনে গুলি করে মানুষ মারা হইলেও এইজায়গার চিন্তাভাবনাকে সে ক্ল্যাসিফাই করে ভিন্নভাবে।

 

এই ধারণাটি কেন আমাদের ভাবনায় পরিবর্তন আনে?

 

আমরা সাধারণত একজন ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট পরিচয়ে বিচার করি—প্রগতিশীল, ঐতিহ্যবাদী, আধুনিক ইত্যাদি। কিন্তু স্পাইরাল ডায়নামিক্স আমাদের শেখায়, একজন মানুষের ব্যক্তিত্বে একাধিক স্তরের মিশ্রণ থাকতে পারে। মানুষ শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট স্তরে আটকে থাকে না, বরং সে একাধিক স্তরের মধ্যে চলাচল করে, যা তার অভিজ্ঞতা এবং পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।

আমাদের সমাজে কেউ হয়তো তার পেশাগত জীবনে খুবই অগ্রসরমান এবং আধুনিক চিন্তাধারার, কিন্তু পরিবার এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সে ঐতিহ্যবাহী হতে পারে। একই ব্যক্তি তার সামাজিক কর্মকাণ্ডে সহানুভূতিশীল এবং মানবিকতাবাদী হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে।

স্পাইরাল ডায়নামিক্স এই কঠিন ধারণাকে ব্যাখ্যা করে এবং আমাদের বলে, মানুষ শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট স্তরে আটকে থাকে না—বরং তাদের ভেতর বহুস্তরীয় চিন্তা এবং মূল্যবোধের জটিলতা রয়েছে। সমাজ এবং মানুষের চিন্তা-ভাবনার জটিল প্রকৃতিকে বুঝতে গেলে এই তত্ত্ব আমাদের সহায়তা করে।

স্পাইরাল ডায়নামিক্স আমাদের শেখায়, একাধিক স্তরের বৈশিষ্ট্য ধারণ করা মানেই বিচ্ছিন্নতা বা দ্বৈততা নয়, বরং মানব জীবনের বাস্তবতারই প্রতিফলন। একজন মানুষ তার জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র এবং পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন স্তরের মূল্যবোধ এবং মানসিকতা নিয়ে চলতে পারে, যা তাকে আরো মানসিকভাবে সমৃদ্ধ এবং অভিযোজিত করে তোলে। বেশ চিন্তাভাবনার ব্যাপার। এই টপিকে আমার চিন্তাভাবনাকে গুছিয়ে আরও অনেকগুলা লেখার ইচ্ছে আছে।