ফেসবুকে একসময় 'The Idealist' নামের একটি পেইজ ফলো করতাম। সেখানে খুব সুন্দর সুন্দর বাণী থাকতো। পরে পেইজটি আনফলো করে দেই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে খুব একটা আইডিয়ালিস্ট থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি।
এক দশক আগের কথা, একদিন দ্য আইডিয়ালিস্ট পেইজে দারুন দু'লাইন পেয়ে গেলাম। কিন্তু লেখক অজ্ঞাত। ইংরেজি কথার বাংলা অনুবাদ করলে যা দাড়ায়,
"আপনি খুব সুন্দর লিখেন। আপনার মনের ভিতরটা নিশ্চয়ই খুব নারকীয় জায়গা।"
এই দুই লাইন আমার মাথা এত জোরে কামড়ে ধরেছিল যে আজো ছাড়েনি সেই মরণ কামড়।
আসলেই তো। যারা বিউটিফুলি লিখেন সেসব লেখকের মন বা মস্তিস্ক যে নামেই ডাকুন, বেশ ভয়ানক, জঘন্য এবং ক্যাওটিক এক স্থান।
ব্রিলিয়ান্ট রাইটারদের মনের ভিতরটা এক নৈরাজ্যের কারখানা। দুর্দান্ত লেখকদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তীক্ষ্ম হয়। আশেপাশের বা অনেক দূরের সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়-আশয় তাদের নজর এড়ায় না।
আবহাওয়া বা বাতাসের সামান্য গতি পরিবর্তন তাদের রাডারে চলে আসে। কিন্তু এত কিছু খেয়াল করেও তারা চুপ থাকেন বেশিরভাগ সময়। লেখনিতে ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে, আবার কেউ সরাসরি প্রকাশ করে ফেলেন তাদের ভিতরকার নরক।
ঠিক এ কারণেই আগাথা ক্রিস্টি তার নিজের লেখা বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র এরকুল পোয়ারোর সাথে দুইবার দেখা হয়েছে বলে দাবী করেন। হুমায়ূন আহমেদ আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে বলেন তার উপন্যাসের চরিত্রদের তার-ই বাসায় চলাফেরা করার কথা।
একবার ভেবে দেখুন তো! কি মারাত্মক বিভ্রমে ভুগেছেন খ্যাতিমান লেখকদের অনেকেই। বেশিরভাগ হয়তো বিষয়টা চেপে গেছেন সমাজে পাগল আখ্যা পাওয়ার ভয়ে। এম্নিতেই এক্সেলেন্ট কবি, লেখকদের পিঠ-পিছে মেজরিটি মানুষ পাগলই মনে করেন। বাংলাদেশে গদ্যে এগিয়ে থাকা ব্রাত্য রাইসুকে নিয়ে ফেসবুকে ট্রলের যেন শেষ নেই।
আমি কিশোর পাশা ইমনের 'জাদুঘর পাতা আছে এই এখানে' উপন্যাসের ভূয়সী প্রশংসা করি। আমার পড়া সেরা বইয়ের মধ্যে একটি বললে মোটেও বাড়িয়ে বলা হয় না। জাদুঘর-পার্ট ওয়ান লিখার সময় লেখক মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন।
একইরকমের ঘটনা আপনি অনেক লেখকের ক্ষেত্রেই পেতে পারেন। আমার মনে হয় খুব ভালো লিখেন এরকম লেখকদের বেশিরভাগ 'হাইলি ফাংশনাল সোশিওপ্যাথ'। শার্লক হোমসের লেখক আর্থার কোনান ডয়েল অথবা ড্রাকুলার রাইটার ব্রাম স্ট্রোকারকে আমার এরকমই মনে হয়।
তাদের সেন্স এত হাইটেন্ড, তারা মানুষজনের মনস্তত্ত্ব এত ভালো বুঝেন যে লিজেন্ডারি জার্মান চিন্তক নিটশের ভাষায়, 'দয়েস্তভস্কি আমার একমাত্র সাইকোলজিস্ট।'
বেশিরভাগ লেখক যখন নিজেদের লেখনশৈলী বা লেখালেখির বিভিন্ন ট্যাকনিক এবং ক্রাফ্ট নিয়ে কথা বলেন বা লিখেন তখনও অনেক কিছু বলে উঠতে পারেন না। মূলত আসল বিষয়টি মনে হয় বলতে পারেন না বা বলেন না।
আসল বিষয় হল, তার মাথার ভিতরকার চরম নৈরাজ্যের কথা। যে অভিশাপ মার্ভেল কমিক্সের গোস্ট রাইডারের মতন তাকেও বহন করে চলতে হয়। অথবা ডিসি কমিক্সের আরেক অভিশপ্ত জন কনস্ট্যানটাইন যাকে নরক চায় না, স্বর্গেও যার প্রবেশ নিষেধ।
কখনো কখনো অভিশাপও গিফ্ট। বাংলায় যাকে বলে, শাপে বর। বিউটিফুলি লিখতে পারা রাইটাররা তাদের মনের নরক বা স্বর্গ-নরকের মধ্যকার দোদুল্যমান অবস্থানের যে ক্যাওস তা-ই পাঠকের কাছে একটি অর্ডারে উপস্থাপন করে শাপমুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা করেন মনে হয়। এক ধরণের ব্যর্থ প্রচেষ্টা আর কি!