পোস্টস

প্রবন্ধ

বাংলাদেশ ভার্শন ২.০ : ভবিষ্যৎ যাইতেসে কোনদিকে ?

২৯ অক্টোবর ২০২৪

জাফর সাদেক রুমী

(এই আর্টিকেলটা লেখসিলাম হাসিনাশাহীর পতনের পর- ঐদিনেই, পতন পরবর্তী তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে। ফেসবুকে পোস্ট করলেও তখনই পাবলিক করি নাই। যতটা না প্রেডিকশন-দূর্বল মানুষের গালি খাওয়ার ভয়ে, তার চাইতে বেশী হইল- আমর সাথে যুক্ত থাকা আশাবাদী মানুষদের এমন নৈরাশ্যবাদী লেখা দিয়া নিরাশ করতে চাই নাই, চাই নাই তাদের আশার বেলুন ফুটা কইরা দিতে। নৈরাশ্যবাদী হইলেও বাস্তবতা এইটাই- এবং গত কয় মাসে এই প্রেডিকশন সত্য হইতেই দেখতেসি। এইখানেও আর্টিকেলটা দিলাম মূলত: আর্কাইভে রাখার জন্য- কেউ পড়লে সেইটা বাড়তি পাওনা।)

 

নয়া স্বাধীনতা তো এসেই গেল। এখন কী হবে?

 

আসেন, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক আর দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু প্রেডিকশন করা যাক।

 

মজার ব্যাপার হলো, বর্তমানের পুরো পরিস্থিতি কিংবা গোটা দেশের রাজনীতি আর ভবিষ্যত বুঝতে হলে পুকুরের বাস্ততন্ত্র বোঝা ছাড়া অন্যকোন উপায় নেই। সুতরাং সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে, দেশ আর মানুষের কথা বলার আগে চলেন বাড়ীর পাশের কোন এক পুকুরের আজাইরা আলাপ দিই। ক্লাস সেভেনে পড়া পুকুরের সেই বাস্ততন্ত্রের আলাপ। এই প্রেডিকশনে আপনার কোন আস্থা থাকলে, কিংবা অনাস্থা থাকলে, একমত কিংবা দ্বিমত হলে, কমেন্ট করুন। জানান দিন আপনি কী ভাবছেন এবং কেন!

 

পুকুরের বাস্ত্ততন্ত্রে কী থাকে? থাকে মোটামুটি তিন ধরণের উপাদান- উৎপাদক, খাদক আর বিয়োজক। নানানরকমের ক্ষুদে জলজ গাছপালা, শৈবালা, ফাইটোপ্লানকটন- এইগুলা হইলো উৎপাদক। এদেরকে খাওয়া দাওয়া করে বেঁচে থাকে পানির উপরে ভাসমান জলজ মাছি টাইপ জিনিসগুলা হইলো প্রাইমারি খাদক। আর এই প্রাইমারী খাদককে খায় ছোট ছোট মাছ, ব্যাঙ ইতাদি সেকেন্ডারি খাদক। ফাইনালি, রাক্ষুসে মাছ আর নানান জাতের পাখি, মানুষ, অন্য প্রাণী- যারা নির্বিশেষে খায়দায় তারা সর্বোচ্চ খাদক।

 

তাহলে এই রাক্ষুসে মাছকে কে খায়? খায় হইলো বহির্শত্রু। নাহ, পানকৌড়ি-গাংচিলের মত ছোটখাট বহির্শত্রুরা এদের বাগে আনতে পারেনা তেমন। হয় আরো বড় মাছ কিংবা কুমির কিংবা ভোঁদড় টাইপ প্রাণীর পেটে যায় ওরা। নয়তো মানুষেরা এদের আটকে ফেলে বড়শীর আগায় বাঁধা টোপের ছলনায়।

 

আর যারা অনেক চালাক? যেইসব রুইকাৎলা ধরা পড়ে না টোপের ফাঁদে? তাদের রাজত্ব কীভাবে শেষ হয়?

 

তারা দীর্ঘদিন বাঁচে। বাঁচতে বাঁচতে বাঁচতে বাঁচতে তারা দূর্বল হয়ে পড়ে। সার গায়ে বাসা বাঁধে অজস্র পরজীবী। পরজীবীরা চুপচাপ রক্তচুষে দূর্বল করে দেয় বড় মাছকে। আর পেটে যাওয়া হাজারো নিরপরাধ ছোটমাছের অভিশাপে বড় মাছের পেট ফুলতে থাকে, ফুলতে থাকে। বড় মাছ হয়ে পড়ে আরো ধীর, অলস, অসহায়। কপাল ভাল হলে দূর্বল হতে হতে একদিন এম্নেই প্রাণবায়ূ বেরিয়ে যায়। নয়তো একঝাঁক শিং কিংবা টাকি কিংবা ফটকা টাইপের রাক্ষুসে মাছ সুযোগ বুঝে খুবলে খেতে থাকে বড়মাছকে। ওদেরকে দাপট দেখানোর মত আর কোন শক্তি অবশিষ্ট থাকে না বড়মাছের। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে নিজের মৃত্যুর সাক্ষী নিজেকেই হতে হয়। এমনও সময় আছে, বড় একটা ঝাঁক বেঁধে টেংরা পুটিরাও সাবড়ে দিতে পারে বড় মাছকে। কথায় আছে, হাতি গাতায় পড়লে চামচিকাও লাথি মারে- তেমনই একটা ব্যাপার।

 

এর পরের ভূমিকা বিয়োজকদের। তারা সব মৃতদের গারবেজ খেয়ে, পঁচিয়ে ধঁচিয়ে পুকুরকে আরো নোংরা করে তুলে। তবে পুকুরে বড়মাছের সংখ্যা বেড়ে গেলে পরজীবি আর বিয়োজকদের কাজ বেড়ে যায়। পুকুর নোংরা থেকে নোংরাতর হয়। পুকুরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। সব স্তরের ঊৎপাদক আর খাদকেরা খাবি খেতে থাকে অক্সিজেনের অভাবে।

 

আজকের পুকুরবিষয়ক আলাপ আপাতত এইটুকুই।

 

কিন্তু ধান ভানতে শিবের গীত কেন? কারণ এই মাছের জীবনের সাথেই মানবজীবনের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন কৌটিল্য। সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য নাকি তার অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করেছিলেন "মাৎস্যন্যায়" এর কথা। সংস্কৃত "মাৎস্যন্যায়" শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘মাছের ন্যায়’। মানে, মাছের মত। মাছের দুনিয়ায় মাছেরা যে নিয়ম মেনে চলে, সে নিয়ম মানবসমাজেও চলে।

 

দেশের অর্থনীতি, বাজারব্যাবস্থা, উৎপাদনব্যাবস্থাকে চালু রাখে কে? সেই দেশের অতি সাধারণ লোকজন, কিংবা উৎপাদকেরা। পুকুরের উৎপাদকদের বেশীরভাগকেই যেমন সহজে চোখে পড়ে না, খালি চোখে দেখা যায় না, একটা দেশের উৎপাদকেরাও চলমান ঘটনায় অদৃশ্যই থেকে যান প্রায়শই।

 

তবে সেকেন্ডারি খাদকেরা আরেকটু মজায় থাকে। ছোট মাছেরা যেমন ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়ায় বন্ধুবান্ধব নিয়ে, ব্যাঙেরা যেমন গান গায় একটা ভাল সঙ্গী খোঁজার জন্য, যেমনভাবে মধ্যপন্থি এই খাদকেরা খালি পার্টি করে পুকুরের এই মাথায়, ঐ মাথায়- দলেবলে গিলে খায় উৎপাদকদের, তেমন মধ্যমস্তরে থাকা মানুষেরাও উৎপাদকদের মাথার উপরে চড়ে বসে মজা মারতে থাকে। এরা মনে করেন দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি; মূলত: মধ্যবিত্তরাই দেশের মধ্যস্তরের খাদক।

 

আর টারশিয়ারি খাদকেরা? মানে শিং-মাগুর-রুই-কাৎলারা? তারা একটু ভাবে থাকে; কারো সাথে তেমন মেশে না, তবে দাপট দেখায় নিজেদের খেয়ালখুশিমতো। একলাই ঘুরে ফিরে আর ক্ষুধা লাগলে টপ করে গিলে খায় দুই-চারটা সেকেন্ডারি কিংবা প্রাইমারি খাদক কিংবা উৎপাদককে। চুপচাপ ছোটমাছ খায়, হামেশাই পায় লুটপাটের ভাগ।

 

এইবার ফেরা যাক দেশের রাজনীতির গল্পে। আমাদের বড়মাছ বুড়িয়ে গিয়েছিল। তার অত্যাচারের দিন শেষ। তার গায়ে বাসা বেঁধেছিল হাজারো পরজীবি পোকা। চেটে-চুষে দূর্বল করে দিয়েছিল তাকে। প্রাইমারি লেভেলের টেংরা পুঁটিরা জোট পাকিয়ে খেয়ে দিল বড় মাছটাকে । ফাইনালি, নিজেই নিজের পতনের সাক্ষী হওয়ার ভাগ্য নিয়ে দেশ ছাড়ল সে।

 

এই বড়মাছটাকে হটানো ছাড়া আমাদের দ্বীতিয় কোন উপায় ছিল না।

 

কিন্তু, সেইসাথে সত্যিটা হচ্ছে রাক্ষুসে মাছেদের থেকে আমাদের কখনো মুক্তি নেই ।এখন আবার নানা ধরণের নানান জাতের শিং-মাগুরেরা জোট বাঁধবে সুবিধা নেয়ার জন্য। ওদের চেষ্টা থাকবে সবগুলো বড় মাছকে সাবড়ে দিয়ে নিজের রাজত্ব কায়েম করা। কারণ বড়মাছের কারণেই ওরা ভাল ভাল খাবার ওরা এতোদিন খেতে পায়নি। বড়মাছের পক্ষেও থাকতো কয়েকটা শিং-মাগুর। এতোদিন ওরা বড়মাছের এঁটো খেয়েই বাঁচতো। ওদের নীতির তেমন ঠিক ঠিকানা নাই। যেকোন মূহুর্তে মিশে যাবে বিপক্ষশ্রোতে।

 

"মাৎস্যান্যায়" এর পুরো প্রাকটিকাল ইতিহাস আমাদের দেশে আছে। সময়টা ছিল রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর থেকে পাল রাজবংশের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত । মাছের রাজ্যের নিয়ম কানুন ওদের জন্য ঠিক আছে। কিন্তু মানবসমাজ প্রতিষ্ঠিত। মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণ আর নানানজনের সর্বময় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের ভিত্তিতেই মানবসমাজ প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং মাছেদের রাজ্যের নিয়ম মানুষের রাজ্যে প্রতিফলিত হওয়া মানেই অরাজকতা। সেই অরাজকতাই চলেছিল পাল বংশের রাজা গোপাল সিংহাসনে বসা পর্যন্ত ।

 

১৬০৮সালে লেখা ’ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস’ গ্রন্থে তিব্বতি সন্ন্যাসী তারনাথ লিখেছিলেন: ‘প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, ব্রাহ্মণ ও বণিক যার যার নিজের এলাকায় ছিলেন এক এক জন রাজা, কিন্তু সমগ্র দেশে কোনো রাজা ছিলেন না’। আর কৌটিল্য বলেন, " যখন দন্ডদানের আইন স্থগিত বা অকার্যকর থাকে তখন এমন অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয় যা মাছের রাজ্য সম্পর্কে প্রচলিত প্রবচনের মধ্যে পরিস্ফুট। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত বড় মাছ ছোটটিকে গ্রাস করে, কারণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অবর্তমানে সবল দুর্বলকে গ্রাস করবেই।"

 

সদ্য ইতিহাস হওয়া আমলেও যেমন এই অবস্থা চলছিল, আনফরচুনেটলি, কমপক্ষে আগামী পাঁচবছরেও এই অবস্থাই চলবে। মহাপরাক্রমশালী শাসক শশাংকের পরে যদি এক শতক মাৎস্যন্যায় চলে, আগামী পাঁচবছরেই আমরা সেই অস্থিরতা কাটিয়ে ফেলবো, সেই আশা বাস্তবতা বিবর্জিত।

এই বিজয়ের পর যে গণলুটতরাজ চলবেই। এইটার অন্যথা হবে সেটা কেন লোকে আশা করেছিল? সূর্যসেনের ডানহাত অনন্ত সিংহকে আমরা দেখেছি বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ডাকাতি করতে, নকশাল আন্দোলনও একসময় পথ হারিয়েছহিল, মুক্তিযুদ্ধের পর অসংখ্য যোদ্ধাকে আমরা নিজের চোখে তস্কর বনে যেতে দেখেছি- যারা এমনকি সদ্যবিগত সরকারেই ছিল। সুতরাং, আচম্বিতে কোন এক ফেরেশতা এসে দেশে সুশাসন জারি করবে এই আশা না করাই ভাল।

 

বাঙালীর সবচে' বড় ভুল ইতিহাসকে ডিনাই করা। মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যই আমাদের জীবনে বড় ঘটনা, কিন্তু সবচে' বড় ঘটনা নয়। তার চাইতে বড় ঘটনা সাতচল্লিশের দেশভাগ। আমরা কখনোই সেই ক্ষতটা এড্রেস করিনি। সেই দেশভাগ এবং দেশভাগের মূলনীতির মাঝেই লুকি্যে আছে আমাদের সকল বিভেদের বীজ। আমাদের অতীতের এবং ভবিষ্যতের সকল অবিশ্বাস, ক্ষতি আর সেই অবিশ্বাসকে পুঁজি করে চলা বিজনেসটার মূলধন এই বীজটাই।

 

আমি চাই কিংবা না চাই, শান্তি খুব দ্রূত ফিরবে না।

 

একাত্তরের বিজয় পূর্ণাঙ্গ বিজয় হিসেবে আসেনি আবেগি মানুষের অবাস্তব এক্সপেকটেশনের জন্যই। এবারের বিজয়ও সহসা প্রকৃত মুক্তি আনবে না কারণ সবার "পারপাস" পরিষ্কার ছিল না নিজেদের কাছেই। জুয়াড়িরা কখনো মিলিয়নিয়ার হতে পারে না কেন? ওরা কী জেতে না কখনো? ওরা জেতে, কিন্তু খেলে যাওয়াটাই ওদের নিয়তি-কারণ জিতে গেলে সেই টাকায় কী করবে সেই পরিকল্পনা কখনো জুয়াড়িদের থাকে না। আজীবন বঞ্চিত থাকতে থাকতে বাংলাদেশের মানুষেরাও জুয়াড়ি সাইকোলজির হয়ে ওঠেছে।

 

মাসলো বলেন, মানুষের প্রাথমিক চাহিদা ফিজিওলজিকাল নিড(খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি), এরপরে নিরাপত্তার নিড, এরপরে ভালোবাসা পাওয়ার নিড। যেহেতু প্রাথমিক নিডগুলাই আমাদের পূরণ হয় না, আমরা পাশবিক সমাজের চাইতে খুব বেশি পরের স্তরে যেতে পারি না। আমরা হয়ে ওঠি স্বার্থপর, লোভী, রক্তপিপাসু। আমরা একজন আরেকজনকে অবিশ্বাস করি এবং প্রস্তুত থাকি যে কোন মূহুর্তে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। এই অবিশ্বাসের দেশে হুট করে বিশ্বাসের জন্ম হবে কীভাবে? কীভাবে আসবে শান্তি?

 

এই অবিশ্বাস আমাদের খুব বেশী দূরে যেতে দেবে না। এবং এই সুযোগটা নিয়মিত নেবে উঁচুতলার বড়মাছেরা। আমরা ছোটমাছ ছোটমাছই থাকব- এর বাইরে নতুন কিছু আশা করা যাদের কাজ, আমি তাদের দলের নই। আবার নতুন কোন বড়মাছেরা নেবে আমাদের নতুন রাজ্যের মালিকানা, আর কামড়াকামড়ি করবে নিজেদের মধ্যে। আবারো রাজায় রাজায় যুদ্ধ হবে, প্রাণ যাবে উলুখড়ের।

 

আমাদের আগের সরকারগুলো তার আগের সরকারের উপর দোষ চাপিয়ে দায় কাটিয়েছে। নতুন যেই সরকারই আসুক, তারা আগের সরকারকে দোষ দিতে দিতে সময় কাটাবে।যারা আসবে, তারা সেই ইতিহাসের প্যানপ্যানানি শুনাবে। ওরাও বলবে তৃতীয় আরেকটা শক্তির মত বায়বীয় কোন এক শক্তির কথা। কারণ ব্যার্থতার দায় স্বীকার করার চাইতে অন্য কোন কল্পিত শক্তিকে দেয়া সুবিধাজনক কাজ।

 

তাছাড়া, জয়ী হও্য়ার নিয়ম কি? কাউকে পরাজিত করতে হয় জয়ী হতে হলে। সুতরাং, সারাক্ষণ পরাজিত করার মত একটা শক্তির উপস্থিতি না থাকলে নিজেকে জয়ী প্রমাণ করা যাবে না। লোকজন অচানক কাউকে আক্রমণ করে পরাজিত করবে, কিংবা কাউকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করবে নিজেকে বিজয়ীর আসনে দেখার জন্য।

 

আমাদের হাতে কি অপশন ছিল? কোন অপশনই ছিল না, কিন্তু ধ্রুব রাঠীর বলা সেই আগুনলাগা বাসে চড়ে ছিলাম বলে আমাদের নামা জরুরী হয়ে পড়েছিল-এইটুকুই। আমাদের রাস্তায় আর কোন গাড়ী নেই যেটাতে আমরা চড়ে বসতে পারি।

 

আইন-শৃঙখলা পদ্ধতি ভেঙে পড়বে। পুলিশ আর্মি বিডিআর মানুষের আস্থা সম্পূর্ণভাবে হারিয়েছে। অবিশ্বাস আর অনাস্থা আমাদের ভেঞেচুরে ফেলবে। আরো অনেক অনেক রক্ত ঝরবে। সেই রক্ত ঠেকানোর কোন উপায় নেই।

 

আগামী বেশ কয়েকটা বছর আমাদের যাবে হাঁসফাঁসিয়ে হাঁসফাঁসিয়ে, হাজা-মজা পুকুরের সব মাছেদের মত।

 

আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি, যেইখানে আমাদের সবসময় সারভাইভাল মুডে থাকতে হয়। আন্দিজ পর্বতে বিমান দূর্ঘটনার পর রাগবি টিমের লোকজন যেমন এক বন্ধু আরেক বন্ধুর মাংস চাবাইয়া বাঁইচা ছিল, আমাদেরও সেইরকম আরেক ভাইয়ের মাংস খাইয়া বাঁচা ছাড়া অন্য উপায় নাই।

 

যারা বোঝার চেষ্টা করতেসেন দেশ কোনদিকে যাইতেসে, রেফারেন্সের জন্য ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলুশন সহ যাবতীয় ইতিহাস ঘাঁটতেসেন- এবার একটু অফ যান! বরং আমাদের অঞ্চলের ইতিহাস পড়েন। শশাংক মারা যাওয়ার পর রাজা গোপালের সিংহাসনে আরোহণ পর্যন্ত কি হইসিল এইটা একটু পইড়া দেখেন! ’৭১ পরবর্তী ইতিহাসটাও দেখেন!

 

প্রবল নৈরাজ্য, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, আশাভঙ্গের বেদনা, নানান রকম গ্রুপিং, ইস্লামিস্ট VS প্রগতিশীল - ছাত্র vs বয়স্কজন ইত্যাদি নানা ক্যাচালে আগামী বছর পাঁচ যাবে! প্রতিবেশী দেশগুলাও খুব একটা মাথা ঘামাবে না, যদি না কোন কিছু তাদের উপর হুমকি হয়ে আসার সম্ভাবনা হয়। বরং তারা এই নৈরাজ্যই চাইবে, যেইটাতে তাদের বরং লাভ বেশী।

 

কয়দিন পর নিজেদের দূর্ভাগ্যের জন্য শিক্ষার্থীদেরও দায়ী করা হবে- এইটা নিশ্চিত। যারা মাথা নাড়তেসেন তারা রবার্ট ব্রাউনিং এর "দ্যা প্যাট্রিয়ট' কবিতা একবার পড়ে দেখতে পারেন। '৭১ এর আগে-পরে মুজিবের প্রতি লোকজনের দৃষ্টিভংগি নিয়ে গবেষণা করতে পারেন।

 

স্বাধীনতা পরবর্তী অরাজকতাকেও এইবার আমরা ছাড়াইয়া যাব বিভিন্ন কারণে। হতাশায় অসংখ্য মানুষ আত্মহত্যা করবে আগামী পাঁচ বছরে। এই সংখ্যা হবে বিগত পাঁচ বছরের তিনগুণ! আর যারা বেঁচে থাকবে, তাদের অনেকেই নানারকমের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যায় পঙ্গু হবে। যেই জেন-জি-রে লইয়া লাফাইসেন তাদেরকে মাথা থেকে ছুঁড়ে ফেলবেন অনেকেই- আর সবচে ভুক্তভোগী হবে তারাই।

 

ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া কঠিন কাজ। শাসকেরা পারে নাই,আমরা কেন পারব? আমাদের রক্ততো আলাদা কিসু না!

 

কোন একদিন হাসিনার জালিম সরকারের পতন যতটা অবশ্যম্ভাবী ছিল, তার পতনের পর অরাজকতা আর অস্থিরতাও ততটাই! একটা সঠিক নেতৃত্বের অভাবে সেই পতন যেমন দেরি হইসে, দেশ ঘুরে দাঁড়াবে না শুধুমাত্র সেই সৎ আর চিন্তাশীল নেতার অভাবেই! তবে হাসিনার পতন যেমন জরুরী, হইতে পারে দেশ রিফর্মের জন্য এই অরাজকতাও জরুরী!

 

হালকা পাতলা ইতিহাস ঘেঁটে যা বুঝলাম নিজের জন্যই কয়েকটা নোট নিয়া রাখি! যদিও আমার এই সস্তা প্রেডিকশন ভুল প্রমাণ হইলেই খুশি হব! আপনার প্রেডিকশনগুলাও কমেন্টে রাখতে পারেন!

 

- নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হবে

- বড় ব্যাবসায়ীরা বিজনেস বন্ধ করবে বেশকিছু, বা বিজনেসের ব্যাপারে কনজারভেটিভ হবে

- শেয়ারবাজারের উত্থান সাময়িক, আবার পড়ে যাওয়ার চান্স বেশী

- প্রবাসী রেমিটেন্স বাড়লেও নানবিধ লোন এবং নানা খরচের খাতের কারণে ওভারঅল রিজার্ভ কমবে

-কয়েকটা ব্যাংক বন্ধ হইতে পারে, বড় অনেক সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ হবে

- ক্রাইম বাড়বে ভয়াবহ রকমের, পুলিশ কাজে ফিরলেও তাদের কেউ গুনবে না সহজে

- রিভার্স ব্রেন ড্রেণ নিয়া যেইসব পোস্ট দেখসেন, নোট রাইখেন। রিভার্স তেমন হবে না, বরং বিদেশযাত্রার হার বাড়বে

- স্বাস্থ্য কিংবা শিক্ষাখাতে পলিসিগত কিছু পরিবর্তন আসবে, তবে যেই লাউ, সেই কদুই থাকবে।

- পৃথিবীর গুজবের রাজধানী হবে বাংলাদেশ

- কিছু সামাজিক পরিবর্তন হবে না এমন নয়, কিন্তু সেইগুলা তেমন সিগনিফিকেন্ট কিছু না।

-মানবাধিকার থেকে শুরু করে সামাজিক নিরাপত্তা -সবই বিঘ্নিত হবে।

- মুদ্রাস্ফিতি হবে, ফরেন ইনভেস্টমেন্ট কমবে

- দুর্নীতি, মজুদদারি আরো বাড়বে; রেডটেপ আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বাড়বে

- ডেইলি লাইফের জটিলতা বাড়বে

- প্রতিবেশী দেশগুলাতে একই স্টাইলের বিপ্লব প্রতিবিপ্লব ঘটবে

- ধর্মীয় সহিংসতা বাড়বে

- প্রতিবেশী দেশ বন্দী বিনিময় বা এই ধরনের কিছু কার্ড খেলবে ক্ষমতায় থাকাদের নেকনজরে থাকার জন্য

- রাজনৈতিক দলগুলা বিশৃঙ্খলা করবে দ্রুত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে অসহযোগিতা করবে

- ইসলামপন্থী সমর্থিত বিএনপিপন্থী সরকার হইল দেশের নিকট ভবিষ্যৎ

-প্রচুর রাজনৈতিক হত্যা ঘটবে, এমনকি নিজেদের অন্তরকোন্দলেই

- ধর্মভিত্তিক বিভাজনের পর জেনারেশনভিত্তিক বিভাজন সামনে আসবে অচিরেই!

- দিনশেষে যেই সরকার আসবে সেই সরকার আর আগের সরকার এর মধ্যে পার্থক্য থাকবে শুধু দলীয় নামে

 

ইতিহাস থেকে আমরা আসলেই শিখি না। একাত্তর আমাদের ইতিহাসের সবচাইতে বড় ঘটনা নয়। বরং কলোনিয়াল সাম্রাজ্য যে ডিভাইড এন্ড রুল নীতি করসিলো হিন্দু-মুসলামানের দুরত্ব বাড়াইয়া, এবং তার প্রেক্ষিতে যে '৪৭ এর দেশভাগ, সেইটাই এই অঞ্চলের সবচাইতে বড় ঘটনা। তার ফলেই একাত্তর আসছে, সেই একই জিনিস বেইচা ২০২৪ এর শাসকরা ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইসে, সেই একই জিনিস বেইচা প্রতিবেশীরা তাদের রাজনীতি চালায়। পুরা রাজনীতি বিজনেসটাই চলে বিভাজনের উপর- সো, আমরা সবাই এক হয়ে মিলেমিশে থাকতে পারি শুধুমাত্র ইউটোপিয়ায়, বাস্তব দুনিয়ায় না।