বুদ্ধদেবের 'যে আঁধার আলোর অধিক' প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। এই বইয়ের কবিতাগুলো আমি এতো বার এতো খেয়াল করে পড়েছি যে প্রায় প্রত্যেকটা সনেটেরই ৩/৪ লাইন করে মুখস্থ আছে। আমার মতে, বুদ্ধদেবের শ্রেষ্ঠ কাব্যকীর্তি এই বইটাই। অনেকে একমত হতে পারেন আমার সাথে, আবারনা-ও হতে পারেন।
আজ জর্জ ওপেনের ‘The Materials' পড়তে গিয়ে একটা কবিতায় চোখ আটকে গেলো। কবিতার শিরোনাম প্রথমে খেয়াল করিনি। শিরোনামের নিচে কী লেখা আছে, সেটাও দেখিনি। শুধু প্রথম লাইনে 'What are you, apple!' পড়তেই মনে পড়ে গেলো 'সোনালী আপেল, তুমি কেনো আছো?' লাইনটা। বুদ্ধদেবের 'স্টিল লাইফ' কবিতার প্রথম লাইন (আমার যদিও এই কবিতার শেষ লাইনই বেশি প্রিয়)। পরে শিরোনামের দিকে তাকালাম। জর্জ ওপেন এই কবিতাটা অ্যাডপ্ট করেছেন বুদ্ধদেবের ওই 'স্টিল লাইফ' কবিতা থেকেই। শুধু এই একটাই না অবশ্য। পাতা ওল্টাতে দেখলাম, বুদ্ধদেবের ‘স্মৃতির প্রতি' শিরোনামের তিনটি সনেটের মধ্যে দু’টি সনেটও জর্জ ওপেন ওই একইভাবে অ্যাডপ্ট করেছেন৷ আমি অ্যাডপ্ট কথাটা ব্যবহার করছি, কারণ এগুলোকে ঠিক অনুবাদ বলা যায় না। জর্জ ওপেন তিনটি কবিতার মূলভাব ঠিক রেখে ইংরেজিতে নিজের মতো করে লিখেছেন আর কী। পুনর্লিখন বলা চলে একে, কিংবা আরো ভালো হয় trans-creation বললে, ঠিক যেভাবে আমাদের জীবনানন্দ দাশ ইয়েটস বা কিটস বা অ্যালান পো-র কোনো কোনো কবিতা সম্পূর্ণ নিজের মতো করে লিখেছেন, অনেকটা সেভাবেই।
জর্জ ওপেন কি বাঙলা জানতেন? বা বুদ্ধদেব বসুকে চিনতেন? নাকি স্টিল লাইফ কবিতাটার কোনো ইংরেজি অনুবাদ হয়েছিলো, যেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন জর্জ ওপেন? ভাবলাম, গুগল ঘেঁটে দেখি কিছু পাওয়া যায় কিনা। তা পাওয়া গেলো বৈকি। প্যাট ক্লিফোর্ড নামের এক আমেরিকান লেখক বেশ বড়ো একটা আর্টিকেলই লিখেছেন ‘George Oppen, Buddhadev Bose and Translation' শিরোনামে। আর্টিকেলটি লেখা হয়েছিলো ২০০৮ সালে, জর্জ ওপেনের জন্মশতবার্ষিকীতে (আরো একটা মজার বিষয়: বুদ্ধদেব বসু এবং জর্জ ওপেন, উভয়েরই জন্ম ১৯০৮ সালে)। এই আর্টিকেল থেকেই জানা গেলো অনেক কিছু। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাঙলায় এ বিষয়ে কোনো লেখা পেলাম না। জানিনা, হয়তো লেখা হয়েছে, কিন্তু অনলাইনে নেই। তবে না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
যাই হোক, প্যাট ক্লিফোর্ড জানাচ্ছেন, বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে জর্জ ওপেনের প্রথম দেখা হয়েছিলো ১৯৬১ সালে, নিউ ইয়র্কে, রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীর এক আয়োজনে। সেইসাক্ষাৎ ছিলো নিতান্তই আপতিক, যদিওজর্জ ওপেন আগে থেকেই বুদ্ধদেব বসুকে চিনতেন। আমেরিকান প্রকাশক জেমস লাফলিনের সঙ্গে বুদ্ধদেবের জানাশোনা ছিলো, কলকাতায় দেখাসাক্ষাৎও হয়েছিলো দু’জনের। ওপেনের একটা চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে, Jay (Laughlin) said he’s old, ugly and very dark. Looked at me thoughtfully and added, and Bengali (বুদ্ধদেব খাঁটো ছিলেন, কালোতো ছিলেন বটেই, পঞ্চাশের দশকে বয়সও হয়েছিলো যথেষ্ট; কিন্তু ugly ছিলেন কিতিনি? বুদ্ধদেবের চেহারা তোখারাপ ছিলো না)। যাইহোক, লাফলিন-বর্ণিত এই আগলি, বাঙালি কবির সঙ্গেই জর্জ ওপেন এক অন্তরঙ্গ সাহিত্যিক লেনদেনে জড়িয়ে পড়েন।
এই লেনদেনের সূত্রপাত অনুবাদের মাধ্যমে। ’৬১ সালে বুদ্ধদেবের সঙ্গে যখন জর্জ ওপেনের দেখাহয়, বুদ্ধদেব তখন নিজের কয়েকটি কবিতা ইংরেজিতে লেখার, তথাঅনুবাদ করার চেষ্টা করছেন (রবীন্দ্রনাথের মতোই)। এই অনুবাদের কাজেই জর্জ ওপেন তাঁকে সাহায্য করা শুরু করেন। খুব ভালো ইংরেজি তিনি জানতেন নিশ্চয়ই, কিন্তু ইংরেজি তো তাঁর মাতৃভাষা ছিলোনা। সুতরাং ইংরেজি অনুবাদে ‘Native Tone’ ব্যাপারটা নিশ্চিত করাটা তাঁরপক্ষে একটু কঠিন ছিলো। এদিকে জর্জ ওপেনের মাতৃভাষা ইংরেজি, বড়ো কবিও তিনি বটেন, কিন্তু তিনি বাঙলা জানেন না এক বর্ণও। ফলে দুজনের বোঝাপড়ার মধ্যে একটা দুরত্ব থেকেই গিয়েছে। প্যাট ক্লিফোর্ড এই দুই কবির পত্রালাপের যে পর্যালোচনা করেছেন, তাতে মনে হয়, বুদ্ধদেব বসু চাইছিলেন তাঁর মূল বাঙলা কবিতার প্রতি যথাসম্ভব বিশ্বস্ত থেকে একটা চলনসই, কিন্তু কাব্যগুণসমৃদ্ধ ইংরেজি অনুবাদ দাঁড় করাতে। কিন্তু জর্জ ওপেন যেনো চাইছিলেন একটা স্বতন্ত্র ইংরেজি কবিতা লিখতে, যেখানে বুদ্ধদেব বসু অনুপ্রেরণা হিসেবে থাকলেও কবিতাটি হবে একটি নতুন কবিতা, অনেকটা জীবনানন্দের ‘হায়চিল', ‘অবসরের গান’, কিংবা ‘বনলতা সেন'-এর মতো। এই টানাপোড়েনটা জর্জওপেন কতোটা অনুভব করেছিলেন, সেটা বলা মুশকিল, কারণ হাজার হলেও মূল কবিতটা তিনি লেখেননি। কিন্তু বুদ্ধদেব যে এই টানাপোড়েন সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলেন, এবং কিছুটা অসন্তুষ্টও ছিলেন, সেটা বোঝা যায় ওপেনেরই লেখা একটা চিঠি থেকে, ‘I remember that you had not really liked my version- had not, as you wrote, been ‘at all at home' with it...’ অন্যদিকে বুদ্ধদেবও তাঁর চিঠিতে লেখেন, I felt the essence of my poem in it, although your style is very, very different. অবশ্য শুধু যে স্টাইলই আলাদা ছিলো, তা নয়; বরং ওপেনের অনুবাদে বুদ্ধদেবের মূল কবিতার বেশির ভাগ শব্দ ও উপমাই একদম হারিয়ে যায়। বিশেষকরে, স্টিল লাইফ কবিতাটি মূলে যেখানে ছিলো চৌদ্দ লাইনের সনেট, ওপেন তাকে পরিণত করেন পাঁচ লাইনের একটি ক্ষুদ্র কবিতায় (ওপেন নিজেই বলছেন, কবিতাটা ‘violently shortened'), যেখানে কেবল প্রথম লাইনের ‘What are you, apple!’ ছাড়া মূল কবিতার সঙ্গে তেমন কোনো আক্ষরিক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। বুদ্ধদেব essence হিসেবে ওই কবিতায় হাজির থাকলেও author হিসেবে আদৌ হাজির ছিলেন না। মজার বিষয় হলো, ১৯৬২সালে ওপেনের অনুবাদে ‘স্মৃতির প্রতি’ এবং ‘স্টিল লাইফ' যখন সানফ্রান্সিসকো রিভিউ-তে প্রকাশিত হলো, তখন দু’টি কবিতারই শিরোনামের নিচে লেখা ছিলো translated by Buddhadeb Bose and George Oppen'। বুদ্ধদেবকে লেখা এক চিঠিতে ওপেন জানিয়েছিলেন, তিনি যথাযথ নির্দেশনা দেওয়ার পরও ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ এই ভুল করে ফেলেছে। ওই একই চিঠিতে ওপেন তাঁর প্রকাশিতব্য The Materials কাব্যগ্রন্থে কবিতা দু’টি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বুদ্ধদেবের অনুমতি প্রার্থনা করেন। বুদ্ধদেব প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন।
পাঠকদের সুবিধার্থে ‘‘স্টিল লাইফ’ কবিতাটির মূল বাঙলা ভার্সন, বু্দ্ধদেব-কৃত অনুবাদ এবং জর্জ ওপেন-কৃত অনুবাদ এখানে হাজির করাহলো:
স্টিল লাইফ
সোনালি আপেল, তুমি কেন আছ ? চুমো খাওয়া হাসির কৌটোয়
দাঁতের আভায় জ্বলা লাল ঠোঁটে বাতাস রাঙাবে ?
ঠাণ্ডা, আঁটো, কঠিন কোনারকের বৈকুণ্ঠ জাগাবে
অপ্সরীর স্তনে ভরা অন্ধকার হাতের মুঠোয় ?
এত, তবু তোমার আরম্ভ মাত্র। হেমন্তের যেন অন্ত নেই।
গন্ধ, রস, স্নিগ্ধতা জড়িয়ে থাকে এমনকি উন্মুখ নিচোলে।
তৃপ্তির পরেও দেখি আরও বাকি, এবং ফুরালে
থামে না পুলক, পুষ্টি, উপকার । কিন্তু শুধু এই ?
তা-ই ভেবে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে । কিন্তু মাঝে মাঝে
আসে ভারি-চোখের দু-এক জন কামাতুর, যারা
থালা, ডালা, কাননের ছদ্মবেশ সব ভাঁজে-ভাঁজে
ছাঁড়ে ফেলে, নিজেরা তোমার মধ্যে অদ্ভুত আলোতে
হ’য়ে ওঠে আকাশ, অরণ্য আর আকাশের তারা —
যা দেখে, হঠাত্ কেঁপে, আমাদেরও ইচ্ছে করে অন্য কিছু হ’তে ।
***
Still Life
(Translated by Buddhadev Bose)
O apple, what are you? Redness of lips withdrawn
After the kiss, striking the air with luster?
Or an apsara’s rounded breast, darkened with the rapture
And held in the hand of a god whose sight is gone?
So much, yet just begun! This autumn seems unending.
Enough! But more. Even the skin is meshed
In eager sweetness. This glad befriending
Works through the loss undiminished.
And is that all? So think the sleepy ones.
But when some lust-encumbered eye
Sees through bowl and orchard, tears across the veils,
And in a strange spell of light, becomes
In you a forest, a spacious sky —
We too then wish we were something else.
***
Still Life
(From a poem by Buddhadeva Bose)
- George Oppen
What are you, apple! There are men
Who, biting an apple, blind themselves to bowl, basket
Or whatever and in a strange spell feel themselves
Like you outdoors and make us wish
We too were in the sun and night alive with sap.
বুদ্ধদেব ও জর্জ ওপেনের মধ্যকার এই লেনদেনকে অনুবাদের চেয়ে বরং ‘collaborative poetry' বলাই বোধ হয় বেশি যুক্তিযুক্ত। বুদ্ধদেব নিজে বাঘা অনুবাদক ছিলেন। অনুবাদক হিসেবে অন্য ভাষার একজন কবিকে নিজ ভাষায় কিভাবে হাজির করতে হয়, তা তাঁরভালো করেই জানাছিলো। অন্যদিকে, বুদ্ধদেবের এই কয়েকটি কবিতা ছাড়া জর্জ ওপেন আর কখনো কোনো ধরনের অনুবাদ বা অনুসৃষ্টির চেষ্টা করেননি। তিনি হয়তোওই অর্থে নিজেকে অনুবাদক মনেওকরতেন না। ফলে ওপেনের এই প্রচেষ্টাকে আমি ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে চাইনা৷ খুব বড়োকবিও অনুবাদক হিসেবে কখনোকখনো ব্যর্থ হতে পারেন, যদি কবি হিসেবে তার নিজের যে স্টাইল, সেই স্টাইল থেকে বেরিয়ে এসে যার কবিতা অনুবাদ করছেন, তার স্টাইলে ঢুকতে নাপারেন। যেমন, সুধীন্দ্রনাথের কোনো কোনো অনুবাদ পড়লেমনে হয় সুধীন্দ্রনাথের কবিতাই পড়ছি, ডি. এইচ. লরেন্সের কবিতা পড়ছিনা, বা হেইনের কবিতা পড়ছিনা। কিন্তু এরপরও ওই অনুবাদগুলো টিকে যায় তাদের কাব্যগুণের কারণে।
প্যাট ক্লিফোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বুদ্ধদেবকে লেখা ওপেনের চিঠিগুলো একটা বাদে সব হারিয়ে গেছে। কিন্তু বুদ্ধদেব যে চিঠিগুলো লিখেছিলেন, সেগুলো রক্ষিত আছে আমেরিকায়। সম্ভবত Mandeville Special Collections Library at UC San Diego-তে। সেই চিঠিগুলো পড়ার কোনো সুযোগ কি বাঙালি পাঠকেরা কখনো পাবে ?
.