পোস্টস

পোস্ট

দ্বিখণ্ডিত যাযাবর

৩০ অক্টোবর ২০২৪

জাফর সাদেক রুমী

আপনি এখন যে বাড়িটায় নিয়মিত বসবাস করছেন, সেটা আপনার জীবনের কততম নিবাস? নাহ্, হোটেল, রিসোর্ট, আত্মীয়র বাড়ি- এই টাইপের স্বল্পস্থায়ী বিনোদনমূলক আবাসকে হিসেবে ধরলে হবে না, বরং জীবনের প্রয়োজনে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে থেকেছেন-এমন বাড়ি হতে হবে! মোটামুটি, কসর নামাজ পড়ার শর্ত পূরণ হয় না, এমন বাড়ি হতে হবে। গুনতে থাকুন!

হাতের কড়ায় গুনে দেখলাম আমার সংখ্যাটা কিছুটা অবিশ্বাস্য। তবে যাদের বাপের বদলির চাকরি, কিংবা যারা আমার মত বছর বছর চাকরি পাল্টেছেন তাদের বাড়ির সংখ্যাটা আমার মতই হবে হয়তো।!

 

আমি আমার জীবনের ৩৭তম বাড়িতে থাকছি, বয়স চল্লিশ হওয়ার আগেই।সেইসাথে পার্ট-টাইম, ফুলটাইম, সরকারি, বেসরকারি মিলিয়ে চৌদ্দতম চাকরিতে আছি, তৃতীয় কোন দেশে। মানে একটা পারফেক্ট আওলাঝাওলা যাযাবর জীবন!

তবে আমার যাযাবর জীবনের সর্বশেষ আওলা পরিবর্তন হল, আমি একটা নতুন দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছি। বাচ্চারাতো জন্মসূত্রেই ছিল, আর গতমাসেই আমরা কানাডার নাগরিকত্ব পেলাম।

 

শুনেছি, আজকাল বাংলাদেশে এই নাগরিকত্ব  বহুল অরাধ্য, আর অলিতে গলিতে কানাডার ভিসা কিংবা নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য লোকজন অফিস খুলে বসেছে! কড়ি ফেল্লেই তেল মাখার সুব্যাবস্থা!

 

তবে আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অতো সহজে হয়নি- কড়ি ছিল না বলে। আবার খুব কঠিন সংগ্রাম করে এতোদূরে এসেছি- তেমন মোটিভেশনাল গল্পও হয়তো আমরা শোনাতে পারবো না। প্রবাসজীবনে থিতু হওয়া সবসময়ই খুব কঠিন একটা ব্যাপার, কিন্তু মহান আল্লাহ আমাদের জন্য ব্যাপারটা তূলনামূলক সহজ করে দিয়েছেন, এইজন্য আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ- আলহামদুলিল্লাহ।

 

প্রবাসজীবন মানেই কি স্বর্গযাপন? ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। এই জীবনটা যাপন করার জন্য আমাদের বন্ধু হারাতে হয়েছে, আত্মীয়তা হারিয়েছি চিরতরে, আপনজনের সাথে শেষ দেখা হয়নি, প্রয়োজনে কিংবা উতসবে পাশে থাকতে পারিনি অনেক আপনজনের। সকল সঞ্চয় একাধিকবার নি:শেষ হয়েছে, যে টাকায় দেশে হয়তো অন্তত: বছর দশেক বসে খাওয়া যেতো।  সবক'টা বিপদ সামলেছি একা একা। সেইসাথে প্রতিনিয়ত ভুগেছি এক্সিসটেনশিয়াল ক্রাইসিসে, মাঝে মাঝে ডুবতে ডুবতে ডিপ্রেশনের তলানিতে পৌঁছে গিয়েছি। আবার আছাড়িপিছাড়ি সাঁতার কেটে ভেসে উঠতে হয়েছে বারবার!

 

তাহলে কী জীবনের এই নতুন চ্যাপ্টারে আমি উদ্বেলিত নই?

 

নিঃসন্দেহে এক্সাইটেড! সবচে বড় ব্যাপার হলো, এইটা আমাদের দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পরিসমাপ্তি। গোটা দুনিয়া একদিন ঘুরে দেখার স্বপ্ন নিয়ে, এবং শুধুমাত্র এই একটা মেজর স্বপ্ন নিয়েই আমি দেশ ছেড়েছিলাম। সুতরাং, নতুন পরিচয়টা আমাকে স্বপ্নপূরণের আরো কাছে নিয়ে এসেছে, তাই আমি অবশ্যই এক্সাইটেড এবং আল্লাহ'র কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু, একইসাথে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসজনিত ধাক্কার আফটার শকে খানিকটা বিমূড়ও বটে! আমি এখন বাংলাদেশী নাকি ক্যানাডিয়ান?

 

সোশ্যালিজম আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ আমার জীবনদর্শনের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুতরাং, নিজেকে আজকাল গ্লোবাল সিটিজেন ভাবলেও আইডেন্টিটিজনিত খানিকটা খচখচানি এখনো প্রকট।

নাগরিকত্ব নেয়ার সেরেমনিতে যখন কাঁপা গলায় গলা মেলাচ্ছিলাম "ও কানাডা" গানের সাথে, নতজানু হয়ে স্বীকার করে নিচ্ছিলাম ব্রিটিশরাজের অধীনতা, তখন চোখটা বারবার ভিজে যাচ্ছিলো। আমি এখনো জানিনা সেই ভিজে যাওয়া চোখের জল কতটা অর্জনের আর কতটা বিসর্জনের। ফার্স্ট জেনারেশন ইমিগ্রান্টের নিয়তিই তো এই- না ঘরকা, না ঘাটকা।

 

তবে, দিনশেষে নিশ্চিত জানি, নিজের মধ্যে নানান ভাঙাচোরা থাকলেও, এই ইমিগ্রেশনটাই আমার "চয়েস", নিজের বেছে নেয়া পরম কাংখিত নিয়তি। মায়ের পেটে দশমাসের বেশি একদিন থাকাটাও যেমন ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার, গাছের ফল পেকে যাওয়ার পরে গাছে ঝুলে থাকা মানেই যেমন পঁচে যাওয়ার অপেক্ষা- তেমনি আমার লাইফসাইকেলে বাংলাদেশ চ্যাপ্টারেরও ঘন্টা বেজে গিয়েছিল। সেইসাথে বাংলাদেশে তাল মিলিয়ে থাকার জন্য আমি অযোগ্যতো ছিলামই!

একসময় আদিপিতা আদমকেও তার জন্মভূমি ইডেনের আরাম আয়েশের বাগান ছাড়তে হয়েছিল, রিজিকের টানে পা রাখতে হয়েছিল দুনিয়ার মাটিতে- তার সন্তানাদিকেও তাই প্রতিনিয়ত নিজের কম্ফোর্টজোন ছেড়ে পিতার পদাংক অনুসরণ করতে হচ্ছে।

 

যেদিন থেকে আমাদের পিতার দু:সাহসী শুক্রাণু বেরিয়ে পড়ে ডিম্বসন্ধান অভিযানে, সেদিন থেকেই আমাদের রক্তে সাগরসন্ধানের ডাক। সেই ডাক কেউ শোনে, কেউ শোনে না। যারা শোনে তাদের ঝড়জল মাথায় নিয়ে অভিযানে বেরুনো ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকে না। আমি নিরুপায়দের দলে ভিড়েছি!

তাই আমি এখন এক দ্বিখণ্ডিত যাযাবর! আধখানা বাংলাদেশী, আধখানা ক্যানাডিয়ান!