পোস্টস

গল্প

“চরিত্রেরা নিজেদের সাথে কথা বলে”

৩০ অক্টোবর ২০২৪

Tahmid Hasan

মূল লেখক তাহ্‌মিদ হাসান

“চরিত্রেরা নিজেদের সাথে কথা বলে”

তাহ্‌মিদ হাসান 
 

 

“এই রেহান আজকাল যা-তা ডায়লগ লেখা শুরু করছে। টাকার খোঁচাখুঁচিতো সব যায়গায়। এজন্য সস্তা চিরা মুড়ি ভাজা ডায়লগ দাও, পাঁচ টাকার স্যান্ডউইচে তিন লিটার চীয্‌ দাও… ...আররে বৎসে যে তোমার

স্যান্ডউইচ গিলতে যাবে সে তো তার মাথার কাটা অংশে বাধ্য হইয়া স্যান্ডউইচের ছিটা দিবে। এই বুড়া বয়সে এখনও পর্যন্ত বুঝলাম না পোলাপান স্টাডি করতে এত ভয় পায় ক্যান? ত্যাক্ত বিরক্ত কণ্ঠে স্ক্রিপ্টের পাতা উল্টাটাতে উল্টাতে নিজের গাড়িতে কথাগুলো আওড়াতে লাগল রাকিব। 

“ভাই ভুতে পিছনে চুলকায় আজকাল সবার। জানেনই তো। সময়ের দাম তো রেট করা। লেখা ভাল হোক না হোক, লেখা লাগবেই। বাজারে যে কয়দিন পর চাউল-ডাউল এর সাথে লেখা ফ্রী পাওয়া যাবে, তা নিয়ে আমার আর কোন সন্দেহ নাই। কিছু লেখা দেখলেই মনে হয় যে খালি শুটকি দিয়া ভাত খাওয়ার জন্য লিখছে হালায়।”

মেজাজ এতই খারাপ রাকিবের যেখানে হাসার কথা সেখানে তো হাসি আস্‌লই না উল্টা ডায়লগের সাথে পাশে বসা সোহেলের কথাবার্তার অপ্রীতিকর মিল দেখে মনে চাচ্ছিল সবকিছুরে লাত্থি মেরে এখানেই, এ গাড়ির ভেতরে স্ক্রিপ্ট্রাইটিং এর ছোটখাটো একটা রেভ্যুলশন ঘটায়ে ফেলতে। আপাতত যা সম্ভব না। সম্ভব হইলে ডিরেক্টর সমাজের চিরস্থায়ী শান্তির জন্য নোবেল পিস্‌ প্রাইজটা সেই পেত তাতে তার নিজের কোন সন্দেহ নাই। কাজের কারনেই তার মেজাজটা মেপে মেপে দেখাতে হয় সব যায়গায়। কিছুক্ষন পরে তার নেক্সট ডিরেক্টরিয়ালের জন্য কিছু মেয়ের অডিশন নিতে হবে। তাই গম্ভির ভাবটা সে চোখে মুখে রাখতে চায় না। কাজের পরিবেশ থাকবে ফ্রেন্ডলি, হার্ম্ফ্রি। সেখানে ‘অকারন মুডে’ সিচুয়েশন পল্যুট না করাটাই বেটার। আর ক্যারেক্টার টাও বেশ ইন্টারেস্টিং, মেইন প্লট এর একটা মিস্ট্রি এলিমেন্ট। সেখানে কিছু পরিবর্তন দরকার ছিল এই মুহূর্তে, বিশেষ করে ডায়লগ্‌গুলোয়। জ্যাম থাকলে করা যেত। মরার ভাগ্য আজাইরা কারণে আজাইরা সমস্যা নিয়ে আসে, কিন্তু আজাইরা সময়ের প্রোডাকটিভ সল্যুশন নিয়ে আসে খুব কম ক্ষেত্রেই। রাকিবের বার বার লাইনগুলোর ওপর চোখ যায় আর মেজাজ বিগড়ায়। এই বাল-ছাল যা রেহান লিখে রাখসে, তা যে কোন যায়গা থেকে কানে ঢুকলেই মাথা খারাপ হয়ে যায়। রাকিবের ধারণা অনুযায়ী সময়টাই সস্তা জাচ্ছে। এজুকেশন থেকে মানুষের লিভিং পর্যন্ত। এজুকেশন বিনোদনধর্মী হতে পারে, কিন্তু সস্তা আলোচনায় না। দুইদিন পর, কোন লেসন একটা ফ্যাক্ট মনে হলে আমরা তা সস্তা মাধ্যমে ঝেড়ে দেই। অবজারভেশন এর জায়গাটা যদি মানুষের মত বিশাল কোন ক্ষেত্র হয়, Then it’s not always necessary to find it in a troll or a meme. Pathetically those shitways imbalances every thought ways, both in positive or negative terms. চিন্তাটা রাকিব মানুষের মধ্যে ইন্‌জেক্ট করতে চায়। একটু পর সে যে ক্যারেক্টারটার অডিশন নিতে যাচ্ছে তার চরিত্রের পেছনের গল্পটা অনেকটাই এরকম। এজন্য ডায়লগ্‌গুলোয় দরকার ছিল ডার্ক হিউমার। কিন্তু এখন রেহানকে ঠিক্‌ঠাক মত গাইড করতে না পারায় রাকিবের হাড়ে-ভাতে সুইসাইডে মরার অবস্থা। এই ডায়লগ্‌গুলো লিখতে, চিন্তাতে যে সময় দরকার তা যথেষ্ট দেয়ার দুইদিন পর আজকে সকালে এসে তা তার হাতে পৌছয়। রাকিব একেক প্রজেক্ট এর জন্য একেক মেথড এপ্লাই করে। যেমনটা এই প্রজেক্ট এর ক্ষেত্রে কিছু স্পেসিফিক সিনের জন্য। কিছু সিন সে ইচ্ছে করেই নিজে লেখেনি, কারন তার ধারনা নিজের জানা কিছু কথা মাঝে মধ্যে অন্যের মুখ থেকে শোনা ভাল। যার কারনে রেহানকে এপয়েন্ট করা। আর এই বান্দাই কাজটাকে ফাজলামো বানিয়ে তার মেজাজের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করল। সব পাশে সরিয়ে আপাতত এখন কাস্টিংটাই সারতে চাচ্ছে রাকিব। মুডটাকে ডাইভার্‌ট করতে কিছুক্ষন আগে হওয়া বৃষ্টির ঠাণ্ডাটা গায়ে মাখতে চাইল। তার 96’ পাযেরো মডেল গাড়ির গ্লাস নামাতে নামাতে ড্রাইভার কে আদেশ দিল ভলিউম মোটামুটি রেখে গান ছেড়ে দিতে। সোহেলের বস এর মেজাজ পড়াই। তাই কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ নিজের ফোন এ ডুবে ছিল এতক্ষন। গান তার মত বেজে চলল Bruce Springsteen এর স্বরে, “I wanna die with you Wendy on the street tonight In an everlasting kiss…..”     

                                                    

 

 

“I’ll work with it, Sir. Hope I won’t let you down.” Participant No. 5 অনুনয়ের স্বরে তার শেষ কথাগুলো বলে রুমের দরজা ভিড়িয়ে চলে গেল। 

রুমটা মাঝারি সাইজের। দরজা বরাবর দেয়ালটা ঘেঁষে একটা তিনজনের সাইজের বড় সোফা। তাতে এতক্ষণ আরামে হেলেদুলে অনেকটা ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে সবার অডিশন নিচ্ছিল রাকিব আর তার এসিস্ট্যান্ট সোহেল। তাদের হাত চারেক সামনে অডিশনিদের জন্য রাখা একটা ছোট টেবিল ও চেয়ার। প্রপ্স হিসেবে টেবিলটায় আছে কয়েকটা কাগজ ও মার্কার পেন । আর চেয়ারটার ঠিক পেছনে আছে একটা হোয়াইট বোর্ড, যাতে বড় করে লেখা “Welcome to detention”। মোটামুটি ক্লাসরুমের একটা ফিল দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যাতে  অডিশনিরা ক্যারেক্টারটার কিছুটা ফিল পায়।  রুমে ঢুকতে ডান পাশটার মাঝামাঝি টেবিলটার মুখোমুখি একটা ট্রাইপডের সাথে ক্যামেরা সেট্‌ করা, অবশ্যই অডিশন রেকর্ডের জন্য। বামপাশটায় ইন্টারেস্টিং কিছু নেই। দেয়ালে ফ্রেম করা একটা মৃত শরীরের আঁকা ছবি আছে আর একটা তোষক আর একটা বালিশ আছে। অফিসের পিওন সেখানটায় কাজের সময়ে মাঝেমধ্যেই শরীর জুড়ায়ে ঘুমায়।   

“ভালই তো লাগল বস। আগেরগুলার থেকে মাচ্‌ বেটার। মনে হইল নিজের কাজটা বোঝে। সবচেয়ে বড় কথা হল ওই জোকারের ডায়লগগুলা ওর মুখে মানায়ে গেছে। এক্সপ্রেশন ভাল ছিল তাই ঠিকঠাক লাগছে। একটা তাড়াহুড়া বোঝা যায় ডেলিভারির সময়, ওটা আমরা ম্যানেজ করে নিতে পারব। She’s surprisingly overwhelming.” সোহেল বেশ বোঝাতে চাইল। আসলে সে বোঝাতে চাইল না শুধু ইম্প্রেসড হওয়ার এক্টিং করল। অডিশনে মনের মত সুন্দরী না পেয়ে সে বেশ বোর ফিল করছিল। প্রশংসা করে বলা কথাগুলো বলা এখান থেকে তাড়াতাড়ি বের হওয়ার জন্য। 

“দেখি, আরও একজন তো আছে।” কিছু পয়েন্টস্‌ নোট করতে করতে সোহেলের দিকে না তাকিয়ে বলল রাকিব।  

“বস আমি যাই। এইটারেই ফাইনাল করবেন জানি। ওইদিকে প্রডিউসারের মেয়েটারে নিয়ে একটা ঝামেলা বাঁধছে। উনি নাওয়ারের পাশের রুমটায় থাকতে চান। রিসর্টে মরার বাপের একটা খালি স্যুইটও নাওয়ারের স্যুইটের পাশে পাওয়া যায়  নাই। এখন ম্যানেজার্‌রে কিছু দিয়ে যদি কনভিন্স করা যায়। তখন থেকে ট্রাই করতেছি ফোনে ম্যানেজ্‌ করতে, মান্‌তেছেই না শালা। কাছেই তো আসে রিসর্টটা, যায়া একটু দেখি কি করা যায়। এরপর রাতে আপনারে মিট করতেছি বস্‌।”

রাকিব ডিরেক্টরদের চোখ খাই খাই করা দৃষ্টি দিয়ে কিছু বলতে যাবে সোহেলকে, তার আগেই সোহেলের ফের নিজস্ব ঢঙের বিশেষ ভাঁজ। বলতে লাগল, ” বস্‌ আপনি যেমনে বুঝতেছেন অমন না কিছু। টাকাটা আমিই দিমু, কোন মারিং কাটিং করমু না, খোদার কসম।”


উলটো কথা শুনে “তুমি মিয়া একটা  আজাইরা বাল……” ছাড়া রাকিব আর কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল না। তার সোহেলকে চেনা আছে পুরোপুরি। সোহেল সাহেব তার কোনরকম ভ্রূক্ষেপ না করে নিজের বিশেষ ভাঁজপড়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতেই থাকলেন। যার মেটাফোরিক আবহাওয়াটা এখানে অনেকটা এরকম, ” আমি একজন বিশিষ্ট কনভিন্সিং কুতুব। প্রডিউসার এবং তার আত্মীয়-প্রতিবেশি সবার  সুখ-দুঃখ বোঝাটা আমার বায়ডেটার বিহেভারিয়াল রেফারেন্স। আমাদের লিড অ্যাক্টর একজন ব্যাক্তিত্ববান মানুষ হওয়া সত্তেও আমার ধারণা অনুযায়ী লুইচ্চামির প্রথম পাঠ নেয়ার জন্য প্রচণ্ড উইল পাওয়ার জন্মগতভাবে ডি.এন.এ ক্যারেক্টারস্টিক্‌সে নিয়ে বসে আছেন। শুধু আমার জন্যই এই বিশেষ সমস্যাগুলোর সৃষ্টি, একমাত্র আমিই এই ‘গো-ত্রিয়’ সমস্যাগুলোর ত্রাণকর্তা। “


শেষমেশ রাকিবের হাসিই ধরল। এ জাতীয় নন্সেন্সিকাল প্রবলেমে সে বেশিরভাগ সময়ে বিরক্তই হয়, কিন্তু এখন জারপনারই হাসি পাচ্ছে। যত যাই হোক, কিছু উটকো-ফুট্‌কো সমস্যা প্রায়সময়ে তৈরি হয়, হতে পারত এসব এসে তার ঘাড়েই জমত। এরচেয়ে লক্ষ কোটিগুন ঢেড় বড় সমস্যা নিয়ে থাকতে হয় তার। সোহেল ট্যাকল্‌ দেয় তাই তার টেরটাও পাওয়া লাগে না।  তাৎক্ষনিক বিরক্তির ব্যাপার বেশিরভাগ সময়ে তাই তাৎক্ষনিক-ই থাকে। হঠাৎ রাকিবের মনে পড়ল আরও একজন তো বাইরে বসে আছে অডিশন দিতে। দেরি না করেই হাঁক ছাড়ল “No. 6, come in….”


 


কোন শব্দ না করে রাকিবের সামনের চেয়ারটায় বসে পড়ল মেয়েটি। হাতে তার অংশের স্ক্রিপ্টটুকু। কোমল স্ফীত স্বরে সম্ভাষণ জানাল, “ Good evening, Sir”

রাকিব প্রথমে মাথা তুলল না। ”Yes Indeed” বলে তাকাল মেয়েটির দিকে। প্রথমেই চোখে পড়ল পোষাকের নীল বেগুনির চাপা উল্লাস। মেয়েটার বসার ভঙ্গিটা সপ্রতিভ। গায়ের ওড়নাটা বামপাশে এলিয়ে বসেছে। তাতে তার ভারী বুকখানা অনেকটাই উন্মুক্ত। হাতদুটো শক্ত করে টেবিলের ওপর একরকম বেঁধেই বসা। যেন অডিশনটা সেই নেবে। হঠাৎ চোখের দিকে লক্ষ্য করতে গিয়ে ঝিম ধরে উঠল। মনে হতে থাকল সে বোধহয় অসীম শুন্যের মাঝামাঝি কোথাও এইমাত্র প্রবেশ করেছে । বড় বড় ঈষৎ কাল চোখগুলো প্রথম চোখ দেখায় শূন্যতাকে কেন মনে করিয়ে দিল সেটাও একটা রহস্য । তার নিজের দৃষ্টিরও কি কোন তারতম্য হল? বোধয়। তবে সে টের পেল না। ভাবনার দৃষ্টিকে আর প্রসারিত না করে রাকিব সরাসরি পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতায় চলে গেল।

“So how’re you doing today?”

“Ohh, seem’s a very interesting day. I’m looking forward.” সুদীপ্ত প্রতিউত্তর মেয়েটার।

“Ah, you sound like a hope. So, Tridha right? যারিফের লাইন্স আমি করছি। I guess you’re well aware of impromptu Acts। তোমাকে যতটুকু সম্ভব মানিয়ে নিতে হবে। I’ll try my best to make myself sound like him & I’m okay with any improvisation. I guess It’s needed here. So, let’s not kill any single second. You may now start & bleed.” 


এই অংশে জেনে নেয়া দরকার গল্পের এই চরিত্র একজন সাপোর্টিং টিচার। যার প্রধান দায়িত্ব কোন ‘x’ স্কুলের ডিটেন্‌শন আওয়ারে বাচ্চাদের ডিসিপ্লিন মেইন্টেন করা। মূল গল্পটিতে সে একটা হিডেন ফোর্সের টুল। তার চরিত্রের এপ্রোচটাই গল্পের একটা বড় পরিবর্তনের সূচনাবিন্দু। পরিবর্তনটা কিভাবে হতে পারে তা ত্রিধার অ্যাক্ট থেকেই জেনে আসা যাক-

ত্রিধা- “ডিটেন্‌শনে পরপর ছয়দিন। আজ কি করলে যারিফ?”

( যারিফরূপী রাকিবের কোন উত্তর নেই। টেবিলে আঙুল দিয়ে চিন্তায় কি যেন আঁকছে।)

” এবারও নিশ্চয়ই হোমওয়ার্ক ঠিকঠাক করতে পারনি।”

( যারিফরূপী রাকিব বিড়বিড় করে কি যেন বলল। কিছু বোঝা গেল না)

“তোমার রাগটা বোঝা যাচ্ছে। আমি কিন্তু আজকেও এখানে পেন্ডিং হোমওয়ার্কগুলো করতে বলব না। রাগ জমিয়েই রাখ। এক্সামের ঝামেলা থেকে বাঁচতে বেশ কাজে লাগবে। Btw, তোমার কি এমন কোন প্ল্যান আছে নাকি? সরাসরি রাস্টিকেট হওয়ার?”

যারিফরূপী রাকিব ত্রিধাকে কিছুটা হকচকিয়ে দেয়ার জন্য এই অংশে ইম্প্রোভাইজ করল “আপনি জানেন না ম্যাম। এই স্কুল এখন আমাকে রাস্টিকেট করবে না। Monthly 30k loss না তাইলে!”

“হাহ্‌হাহ্‌!! লস্‌ ইকুয়েশন এত ভাল বুঝলে, কিন্তু স্কুল তাতে ধন্য হল না কেন? আমাদের তো তোমাকে নিয়ে একটা সেলেব্রেশন পার্টি দেয়া উচিত।” এবার ত্রিধার ইমপ্রোভাইজেশন, রাকিবের এক্সপেক্টেশন থেকে যা অনেক ভাল ছিল ।


ত্রিধা সুযোগটাকে গ্রহন করল নিজেকে এ চরিত্রে পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিয়ে। রাকিব জানার বাইরে জানতে শুরু করল চরিত্রের ভেতর আরেক নতুন চরিত্রকে। 

“শোন যারিফ, নিজের লার্নিং থেকে কিছু শেয়ার করি। যদিও আমি জানিনা তুমি কতটুকু কাজে লাগাবে, তারপরেও আমার বলাটা বোধয় ভাল। আমরা আমাদের এই ছোট্ট জীবনটা যতটুকু সময় নেগ্‌লেক্ট করছি, ঠিক একই পরিমাণ সময়টা দিয়ে আমাদের আরেকটা ‘আমি’-কে হয়ত অনেক যত্নের সাথে বিল্ড করতে পারতাম। আমি আর তুমি এই স্কুলটায় শুধুমাত্র একটা রোলপ্লে করছি। যেখানে সব 

রেসপন্সিবিলিটি শেখানো হয় না। যে বিশেষ ‘আমি’-টার কথা একটু আগেই মেনশন করলাম, ওটারও একটা রেসপন্সিবিলিটি আছে। রেসপন্সিবিলিটি নিজের টাইমকে প্রপারলি ব্যালেন্স করা। তাই এই আমিকে স্প্রেড্‌ করার মিডিয়াম হিসেবে পানিশ্‌মেন্টকে বেছে নিওনা প্লিজ্‌। পানিশ্‌মেন্ট হয়ত তোমাকে স্বপ্ন দেখতে দিচ্ছে না। জেনে রাখ, এভাবে আমরা নিজেদেরকে ডিটেনশনেই শুধু আটকে রাখি না কথা বলি অন্ধকারের সাথে। অন্ধকার হচ্ছে অচেতন অবস্থাটা। সেখানে ইচ্ছেটা নেই মরে যাওয়া আছে।”


ব্যাপারটা এখন আর পারফরম্যান্সে সীমাবদ্ধ থাকল না। কারও পূর্বধারণা ছাড়াই পুরো অডিশনটা একটা নাটকীয় মোড় নিয়ে ফেলল। রাকিবের সমস্ত ইন্দ্রিয় তব্ধা খেয়ে উপভোগ করছিল পুরো এক্টটা। খুব সাবলীল ঢঙে আসা কথাগুলো মেয়েটার সৌন্দর্যও টেনে উপস্থাপন করছিল বিভিন্নভাবে। পরিবেশনাটা  ঠেকছিল একটা কল্পিয় যোগাযোগের মত। সেখানে প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে কিসের একটা আত্মবিশ্বাসের বিচ্ছুরন দেখছিল রাকিব। ঠোঁটদুটো যেন শুধুই নড়ছিল না, অসাধারণত্বও জানাচ্ছিল সাথে। মিহি কণ্ঠটাও তাতে পূর্ণতা খুঁজে পেল যেন। যে কেউই এভাবে ভাবতেই প্রেমে পড়ে যাবে। ভাবনাগুলো সামনের সুন্দর অবয়বটায় বারবার ধাক্কা খেয়ে ফেরত আসছিল। হঠাৎ খেয়াল হল সুন্দর ঠোঁটগুলো তাকে আবার  কি যেন বলতে চাইছে। কানজোড়া সম্বিত ফিরে পেয়ে শুনল, “ কি যারিফ! এতক্ষণ ধরে চুপ কেন? রেসপন্সিবিলিটি কি কিছু বলে না?”

রাকিব এমন হতভম্বতার মধ্যেই জানতে পেরেছিল যে এই মেয়েটিই সেই চরিত্র যাকে সবার দেখার কথা। কোন রাখঢাক না রেখে সমস্ত নাটকীয়তা নিয়ে ঘোষণা দিল-

“ আমি যাকিব শপথ করিতেছি যে, এই ধরাধামে অপর কোন ব্যাক্তি তার প্রিয় মুখখানি এই চরিত্রে কল্পনা করার দুঃসাহসও কখনও করবে না, অন্তত যতদিন আমি বেঁচে আছি।”

“আমি হাসব না কাঁদব? কিছুই তো বুঝছি না।” চোখ টলমল ত্রিধার। রাকিবকে ধন্যবাদ জানাতে যেয়ে কি কথাটা আটকে গেল বোঝা গেল না। তবে সে হাসছিল। খুব সুন্দর করেই হাসছিল। 

হঠাৎ রাকিবের ত্রিধার ঠোঁটগুলোর দিকে তাকিয়ে একচিলতে ভাবনার মত মনে হল মৃত্যুর ঘোষণাটাও কি এমন গাড়লাল রক্তপিণ্ডে ভর করে ভেসে আসবে? এই অবধারিত সৌন্দর্যের বিশেষ রুপ কি এই? ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং হত তাহলে।

 


“রুটিন"

 

রাতে ম্যান ইউ আর লিভারপুলের খেলার মাঝেই কখন চোখ লেগে গিয়েছিল রাকিব টের পায়নি। ঘুম ভাঙ্গার পর সে নিজের এক পা আবিষ্কার করে মেঝেতে, আর এক পা ডিভানে এলানো অবস্থায়। ছোট বালিশে ঘুমের খেসারত, ঘাড়ের ব্যাথাকে সারা দিনের জন্য সঙ্গী করে বিছানা ছাড়া। এ বাসাটায় গত তিন বছর ধরে সে একলা থাকছে। রাকিবের ওয়াইফ নিমা ছেলে আরাবকে নিয়ে এখন কানাডায় থাকে। না, বিচ্ছেদ তাদের হয়নি, বলা যায় সেপারেশন চলছে। আরাব পড়ালেখায় বেশ ভাল করছিল, ওর বেটার ফিউচারের চিন্তাও নিমার ছিল, যেজন্য এখন থিতু হওয়ার চেষ্টা। রাকিবের সায় ছিল না অবশ্য। তবে সেভাবে আপত্তিও জানায়নি এভাবে ওকে ছেড়ে দূরে থাকার সিদ্ধান্তে। এক্ষেত্রে অজুহাত হতে পারে তার অতিরিক্ত ব্যাস্ততা অথবা কাজের প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ। সংসারধর্ম শুধু ছুটির দিনগুলোতে পালনের জন্য না। এর বাইরেও বাবাদের অনেক দায়িত্ব নিতে হয়, নিজেদের একাংশটাকে সন্তানের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হয়, তা রাকিব কখনও জেনে বুঝে ঠিকঠাক করতে পারেনি, হয়তবা বিভিন্ন কারনে পেরে ওঠাটা সম্ভবপর হয়নি । আরাব শুধুমাত্র তার বাবার পরিচয়টা জেনেই বড় হচ্ছিল। বাবার সংস্পর্শ মেলেনি, বাবার পিতাসুলভ আনুকল্য বোঝেনি। তার সুসংবাদ-দুঃসংবাদ্গুলো যথাসময়ে ভাগাভাগি করতে পারেনি। একজন মায়ের পক্ষে বাবার এ অনুপুস্থিতি সবসময় মানিয়ে চলা সম্ভব না। নিমা নিজে একজন সফল পেশাজীবী। একটা ইন্টেরিয়র ফার্ম দশ বছর ধরে অত্যন্ত সফল্ভাবে পরিচালনা করছে সে। নিজে আর্কিটেক্ট না, তবে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ভাল বোঝার কারনে ফার্মের অবস্থান বেশ শক্ত। এতকিছুর পরও আরাবের দেখভালটা সে ভালভাবেই সামলেছে। রাকিবের মতো ব্যাস্ততার অজুহাত দেখালে, আরাব হয়ত বার বার অসুখে পড়ে পরবর্তীতে শরীরে কোন সিভিয়ার ড্যামেজ নিয়ে বেড়ে উঠত। নতুন জুতো আর পড়া হতো না, পুরনো ছেঁড়া জুতো পড়ে হাঁটার ‘স্বেচ্ছা ট্রেনিং’ নেয়া লাগতো। পৃথিবীটাকে চিনতে হতো একটা এক্সপেরিমেন্টাল চিড়িয়াখানা হিসেবে, যেখানে সবাই যার যার আয়নায় শুধু নিজেকেই দেখছে চিন্ছে। নিমা শুধু শুধুই মনে করে না ছেলের অধিকারটুকু কেবল তারই। আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নেয়াটা আরও কিছু কারনে সহজ ছিল। সে চাচ্ছিল তার বিজনেসও আরেকটা নতুন শেপে আসুক। কাজের সুবাদে কানাডায় বেশ কতক ক্লায়েন্ট পেয়েছিল সে। শুধু একটা মনিটরিং অফিস চালু করে কানাডা থেকেই দেশের বিজনেস দিব্যি অপারেট করছিল। দেখতে দেখতে এ তিন বছরের মধ্যে কোম্পানি আরও প্রোগ্রেস করল। সবকিছু ভালভাবে গুছিয়ে আনার পর তার আর আরাবের জীবন এখন সম্ভবত অনেক স্বস্তির। গুজব এখানে ফোনে, কাগজে, টিভিতে বা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়দের মুখে,  তাদের পিছু ধরে না। সাফল্য, খ্যাতির মায়া সব পাইয়ে দেয় হয়তবা, কিন্তু সাথে দিয়ে যায় ওসব অনাকাঙ্খিত যোগাযোগ। রাকিবের খ্যাতি তাই নিমাকে কখনও ভুলিয়ে রাখেনি। এসমস্ত মাথব্যাথাই তাদের আলাদা হতে বাধ্য হওয়ার কারন। 


সেলফোনে ফেস্‌ রেকগ্নেশান এপ্রূভ হওয়ার পর ভেসে উঠল আরাবের পিক্‌। রুটিনমাফিক পুরনো ক্ষতগুলো এভাবেই দাবড়ে বেড়াচ্ছিল রাকিবের অবচেতনে। ঝিমধরা অনুভূতিগুলো ছেড়ে গেলে অহেতুক আসবাবে পূর্ণ একলা ঘরটায় সে নিমা আরাবের প্রচণ্ড অনুপুস্থিতি টের পায়। তার ক্লান্ত লাগতে থাকে নিজে নিজে চা বানিয়ে খেতে, নাস্তা সারতে, ফাইলপত্র গোছাতে, জুতো পরিষ্কার করতে, সমস্ত কাজ ও অবসর জানতে। তার জন্য আপাতত স্বস্তির ব্যাপার যে দিনের বেশিরভাগ সময়টুকু তার কাজ কাটিয়ে নিতে যাচ্ছে, বাকীটা হয়তোবা অভিমান পার করে নেবে। নিজের প্রয়োজনে হাজারবার আওড়ান কথাগুলো সে বেরুতে বেরুতে আবার নিজেকে শোনাল, “ সজনে যার খিয় সাধ, কর্মে তার ব্যাপ্তি লাভ”।



প্রারম্ভ


ছবির প্রি-প্রডাকশনের কাজ অনেকটাই গোছান হয়ে গেছে। আজ ক্রূদের সাথে টিম মিটিঙে  ফিল্মিং

এর ডেট প্ল্যান এবং টেকনিকাল বিষয়গুলো ফাইনালাইজ করা হবে। গাড়ি সজোরে অফিসের দিকে ছুটছে। রাকিব ভেতরে বসে চেক্‌লিস্ট তৈরি করছিল। ইদানিং তার কপালে জ্যাম জুটছে না। সময়ের আগেই সবখানে তার ক্রমাগত উপস্থিতি। এবারও এর ব্যত্যয় হল না। বাদবাকি ক্রূদের আসার আগেই সে অফিসে রীতিমত বোরড।  

মিটিং রুমটা এ ধরনের অফিসের জন্য একটু ছোটই বলা চলে। আয়তকার টেবিলটা পুরো রুমটার সিংহভাগ জুড়ে। জনা বিশেকের বসতে পারার জন্য চেয়ার আর মাথার উপরে তাকসমৃদ্ধ দেয়াল,শুধু দরজার সাথের দেয়ালটা কিছুটা দেখা যায়। তার মাঝমাঝি প্রজেক্শনের জন্য একটা পর্দা ঝোলান। রুমের অবশিষ্ট মানুষ বলতে এখন শুধু সেই বসে আছে। একলা বসে বাকিদের জন্য মধুর অপেক্ষা করছে।


একে একে সব বান্দারা হাজির। দেরি না করে রাকিবও মিটিং তাড়াতাড়ি শুরু করে দিল। মিটিং এর মাঝখানে বরাবরের মতো ক্রিয়েটিভ গোলগুলো প্ল্যান করতে সবার বেশ ঝক্কি পোহাতে হল। কারও কোটেশন ভুল তো, দেখা গেল স্টোরিবোর্ডে এডিশনাল ডিটেলস্‌ বাদ পড়ে গেছে। ওইদিকে লজিস্টিকসের মামাদের সাপোর্ট সিস্টেমেই গলদ। জননন্দিত প্রোডাক্শনের স্যারেরা(ম্যানেজার) আবার  একেকজন বিতিকিচ্ছিরি সব ডিমান্ড করে বসে আছেন। আর টিমের এসব আপামর স্বাধীনচেতা জনগনের কল্যাণে বাজেটে লাখ্‌খানেক টাকা সর্বসমক্ষে বিনা হদিসে ‘নন্দিত মারা’ খেয়ে গেল। সবশেষে আস্‌ল পারফরমার দেবদেবীদের স্কেজুল। উনারা তো ইগো দিয়ে গোটা ইন্ডাস্ট্রি জয় করে রেখেছেন। তাহারা সবাই সর্বপ্রথম নিজের পরিচয়টা সবচাইতে বেশি বোঝেন, কাজটা তার তুলনায় একটু কমই। ছাড়ের প্রসঙ্গ আসলে নিজেদের দেবতাজন্মের কষ্টের কথাগুলো তারা চিত্তভরে স্মরণ করিয়ে দেন। মেজাজটা রাকিব চাইলেও ঠিক রাখতে পারে না সবক্ষেত্রে। এমন সমস্যাগুলোর চৌহদ্দি ‘অভিজ্ঞতা-বাবা’ সয়ে আসছেন বহুদিন ধরে। রাকিবের জন্মের কারন যেহেতু এই কর্ম, তাঁর আর বিশেষ কিছু করারও নেই। শুধু বসে বসে সবার মাঝে একটা ড্রাইভ তৈরি করে সে। বাকিদের ইগোটা প্রানপণে চেষ্টা করে কোন না কোন প্যাশনে রুপান্তর করতে। তার কাছে একটা সুপ্ত জিয়ন কাঠি আছে। যেই জিয়ন কাঠি ওই প্যাশনকে পরবর্তিত করে কোন ধ্রপদি রুপায়নে। ইন্ডাস্ট্রির সবার রাকিবের সুপ্ত জিয়ন কাঠি নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল। কৌতূহল তাদেরই কিছুটা মেটে যারা তার সাথে কাজ করে। দিনশেষে সাফল্য ব্যার্থতার যে ফলাফলই হোক না কেন, রাকিব তাই এই পছন্দের মানুষগুলোর তাড়নায় আক্রান্ত মুখ দেখে ভীষন তৃপ্তি পায়।        

 

আগামী একটা বছর এদেরই আজন্ম চেষ্টায় জন্ম হতে যাচ্ছে একটা বিশেষ শিশুর। তাল্‌গোল পাকিয়ে ফেলা কোন অভিশপ্ত শিশু না, যার নিজের কথা বলার অধিকার নেই। সম্ভবত তার কণ্ঠস্বর হবে একটু অপরিচিত। তাতে কেউ হয়তোবা নিজের ভাষা বিবেক বিসর্জন দিবে আর কেউ হয়তোবা তার রঙের ঢঙ্গের পরিবর্তন খেয়াল করবে খুব আস্তে ধীরে। আমরা যারা অভ্যস্ত অনভ্যস্ত দর্শক, তাদের কাছে  এই প্রিয়, পরিচিত কাজগুলোর বিভিন্ন অধ্যায় সম্পর্কে ধারণা খুব স্বল্প । অধ্যায়গুলোর কোন পুর্ণাঙ্গ চিত্রায়ন করলে দেখা যাবে একটা অবিশ্বাস্য শক্তির কোত্থেকে কিভাবে যেন আবির্ভাব হয়, তার নিজের অসাধারণত্ব ছড়িয়ে দেবার প্রয়োজনীয়তার জন্য। এই শক্তিটাই আমরা সর্বত্র অনুভব করি, আর এর কাঙ্ক্ষিত চিত্রায়ন আমাদের প্রিয় হয়ে উঠে এসমস্ত মানুষদের দ্বারা। রাকিবরা সাধারণের এ অন্তের ডাকটা শুনতে পায়, তাই তাদের চেষ্টার মাত্রাও থাকে অসাধারণ। 


মিটিং শেষ হতে চলেছিল প্রায়। এর মাঝখানে এডি সায়রা লাস্ট অডিশনের ক্লিপিংস দেখতে চাইল রাকিবের কাছে। বলে ” বস, ওই টিচারের রোলটা কে করতেছে জানাইলেন নাতো! ঐ ক্যারেক্টারের কস্টিউম গুলো এখনো ডিজাইন করা বাকি। পরে কমপ্লেইন করবেন আর পচাবেন, একটু তাড়াতাড়ি ভিডিওটা হোয়াটস্‌এ্যাপ করবেন?”


রাকিব বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল তার যে জানানোর কথা ছিল ত্রিধার সিলেকশনের ব্যাপারটা। ভিডিও খুঁজে প্লে করে দেখল ভুল ভিডিও। না… অইত রাকিবের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। তাহলে ত্রিধা কোথায়? এরকম তো হওয়ার কথা না। 

“বস কি প্লে করছেন? কাউরে তো দেখি না। আজকাল কি অদৃশ্য আত্না কাস্ট করা শুরু করছেন নাকি?”

সায়রার কথায় আশেপাশের কয়েকজন হোহো করে হেসে উঠল। রাকিবের কানে কোন রসিকতাই ঢুকল না। সে কোনভাবেই স্বাভাবিক চিন্তা করতে পারছে না। এত স্পষ্ট খেয়াল আছে সবকিছু, কিন্তু এমনটা হবে কেন? মেয়েটার পরনে ছিল একটা গাড় নীল কামিজ। ওড়না ছিল বেগুনি, একি? ঠিক অডিশন রুমের সেই ছবিটার মত। ছবিতে লাশের গায়ে কাপড়ের বদলে জড়ান ছিল রং, ঠিক একই রং যা ত্রিধার পরনে ছিল! মাথা ওপরে তুলতেই সে দেখে পিয়ন কাম্রুল ঠিক ওই ছবিটাই এখন এনে তার সামনে কেবিনেটের ফাঁকা যায়গাটায় রেখে চলে গেল। রাকিবের পুরো মাথাটা যেন সাথেসাথে ফেটে হাতে আসতে চাইল। সমস্ত উত্তেজনা প্রাণপণ অস্বাভাবিক নড়চড়ে একত্র হয়ে ঢেউয়ের মতো আঁছড়ে এসে হৃৎপিণ্ডে বিধছিল। কান্ডারি রাকিবের মনে হল, সে আমৃত্যু চেষ্টা করতে পারবে পরবর্তী প্রতিটি নিঃশ্বাসের জন্য। তার চোখজোড়া সইতে চাইছিল না এই যুদ্ধ। মণি দুটো এ মুহূর্তে মৃত্যু রাজার হাতে কব্জা। তিনি সেখানে বসে আছেন। উন্মত্তভাবে উপভোগ করছেন আতঙ্কিত বোবা চোখগুলোর মিছিল।   


(অ,ক্ষ,য়)

 

‘অ’

“কাল রং। পবিত্র কাল রং। জড় কাল রং। ভঙ্গুর আলর রং। নষ্ট জং। অদ্ভুত সাদা রং। রং-দৃষ্টি-বেরং, সাদা। বাস্তব-অতিবাস্তব-অসাড়বাস্তব, সাদাজন্ম। ছুটছে সাদা, বেরুচ্ছে সাদা, জানাচ্ছে সাদা, ধ্বনিত হচ্ছে সাদা । শরীর কি সাদা? যেখানে যাচ্ছে তা কি সাদা? থামছি যখন তখন কি?

অনাহুত উষ্ণকালর চোখ ছিটিয়ে মাখন নতুন আবাস।”


“কি অনুভুতিহীন অদ্ভুত অবস্থা! কিছু স্পর্শ করা যায় না, মুখে কোন ঘ্রান মেখে থাকার স্বাদ নেই। আমার মনে হওয়া আছে খুব অবাস্তব কোন শক্তির গর্ভের ভেতর। ওই গর্ভের চারদেয়ালি চোখ আর তার হিমদৃষ্টি আমার সাদা নগ্ন রুপ এ নিজুত কোটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে। কেউ হাসছেও না, কেউ কাঁদছেও না, এমনকি কেউ নিঃশ্বাস ও নিচ্ছে না, আমি নিজেও না। সব গাড়, অসহ্য………”


“অন্ধত্ব কি? সব জড়, জীবনের এলোমেলো সৃষ্টি? জোগাড় করা তথ্য ভাগাড় এর কল্পিত রূপ, দৃশ্য বা পথিক? যা সত্যের রূপ খোঁজে? যা স্পর্শের বোধ তীব্রভাবে জানায় তার নিজ না দেখা অবয়বে এবং যা কৌতুহোলী হয় মুক্তি কি তা জানতে? অন্ধত্ব বা গাড় অন্ধকার কি তবে কৌতুহল? দৃষ্টি থাকতে দৃষ্টি মেলে কি তবে সব স্বপ্ন দেখি? ‘আমি’ যে সৃষ্টি তা কি কারও অন্ধত্ব না কারও দৃষ্টি মেলা কল্পনা? ‘ বাস্তব’ এভাবে বুঝছি কেন? বাস্তব কি টুকরো ধারন করে না?’অস্তিত্ব’ কেন এত প্রশ্ন?” 


আমি প্রশ্ন হচ্ছি এ অবাস্তবে। আমি স্বয়ং জানছি এমন অবাস্তবে।


‘ক্ষ’

 

“রাকিব জামান। জেগে ওঠায় অভিনন্দন!”

”কে?”

“চারদেয়ালি চোখ।”

”কবর?”

হাহা। না স্মৃতি-বিস্মৃতির প্রশ্ন গর্ভ। তবে আমি উত্তরও জানি, যা তুমি জান না।”

”অবচেতন?”

“না, বাস্তব- অবাস্তবের সেতু।”

”সে কীরূপ?”

“যেখানে তোমার জানা পৃথিবী নেই, যেখানে তোমার দেহত্যাগ নেই। ভেঙ্গে বললাম কথাটা কারন, এ অবস্থায় তোমার কোন দেহধারন নেই, তুমি পুরোপুরি একটা শূন্য অস্তিত্বের অন্ধ অনুভুতি।”

“এখন কিছু মনে পড়ছে না, তবে এমন কিছু আগে কোথাও শুনেছিলাম বোধয়।”

“বোধয় না, তুমি একটু আগেই জানছিলে এসব কাল রং থেকে। সব প্রশ্নের সাথে আমার গর্ভের ভ্রূণ হয়ে।”

 “মা? তোমার কণ্ঠ তো কানে বাজছে না? তুমি কি ওই শুভ্র সাদায় কথা বলছ? আমার কি হচ্ছে? বলতে পার?”

“তোমার কিছু হচ্ছে না। ভাল খারাপ যা এখানে নেই, তা আবার হবার কি? ভাগ্যের রূপ এমনই রাকিব।”

“ মা আমি চাইলেই কি কিছু দেখতে পাব না? আমি কি তোমাকে কল্পনা করতে পারব না? ইচ্ছের অস্তিত্ব কি আছে এখানে?”

“আমি সামলেই আসছিলাম এতদিন। তোমার ইচ্ছে, তোমার অস্তিত্ব। আমি প্রচণ্ড ভালবাসতাম এ সবকিছু। এটা যদি কোন গল্প হতো এর শেষ তুমি কোনদিন জানতে পারতে না। এ শূন্যতাই এখানে বাবা, ইচ্ছে থাকলেও তোমার প্রতি মুহূর্তে পাশে থেকে তোমাকে ভালবাসতে পারিনি, তোমার প্রতিটি রক্তের কথা জানতে পারিনি, এখন এখানে এই মায়াভ্রমে তোমাকে ইচ্ছে করতে দেবার ক্ষমতাও আমার নেই।”

” আমি আর কিছুই জানতে চাব না, মা। আমি কাঁদছি, কিন্তু কিছু ভিজে উঠছে না। খালি মনে হচ্ছে একটু পরেই উঠে দেখব আমার চোখ নাক ভেজা। এমন অসহায় কেন হতে হবে? কখনও কল্পনাও করিনি এমন অস্তিত্ব দেখব। কাউকে জড়িয়েও ধরতে পারব না? অন্তত আরাবকে যদি………”



“ বাবা। তোমাকে তো কখনও কষ্ট পেতে দেখি নি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হতো তুমি কষ্ট পেলে কেমন কর?” 

“আরাব। বাবা আমি কিছুই দেখছি না। তুমি কাছে থাকতে কখনও শক্ত করে জরিয়ে ধরতে পারিনি এখন খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু কিছুই পারব না।”

“তুমি কি আমাকে চেয়েছিলে বাবা? মাতো জানে তুমি তার সাথে শুধু রাত কাটাতে চেয়েছিলে। তোমার তো ইন্ডাস্ট্রিই সব।”

”আরাব, বাবার কথা একটু শুনবে? তোমাকে প্রথম দেখার পর নিজের উপর প্রচণ্ড ঘৃণা কি পরিমাণ ভালবাসায় রূপ নিয়েছিল, তা কাউকে বোঝান সম্ভব না। আমি একটা অপরাধবোধে ভুগতাম বাবা। বিদ্ঘুটে কমপ্লেক্স কাজ করত সবসময়। দিনরাত এক করে এসে যখন ভাবতাম তোমাকে কোলে জরিয়ে ঘুমব, দেখতাম তুমি মাকে তার রাজপুত্রের মতো জরিয়ে ধরে খুব ঘুমচ্ছ। আমি অতটুক ভাললাগাতেই আচ্ছন্ন থাকতাম। জানতাম তুমি খুব ভালটি আছ।। সকাল আমাকে তোমার মুখ দেখতে দিত খুব কমই। মাসের পর মাস আমাকে ঘরের বাইরে থাকতে হত। আমি এখন কি জানলাম আরাব জান? তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে খুব। তোমাকে আমার কখনও জানাই হয়নি বাবা। I’m sorry, কিন্তু তুমি জেনে রাখ, আমি তোমাকে সবসময়ই চেয়েছিলাম।”

“বাবা, তুমি চেয়েছিলে যা তাই করেছো, তাই পেয়েছ। তোমাকে কে নিয়ে প্রায়দিন জঘন্য সব খবর বেরুত। স্কুলে বন্ধুরা সব বিশ্রীভাবে ইন্সাল্ট করত আমাকে। তোমার কি কোন আইডিয়া আছে, একসাথে সাত-আটজনের মার খেতে কেমন লাগে? আমি তোমাকে ডিফেন্ড করতাম বাবা, আর তুমি খালি একদিন হাসপাতালে বিশ মিনিট দেখে চলে গেলে? ঐসময়টা আমি একই ভাবে শুধু তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চেয়েছিলাম, এমনকি মাকেও না। আমার এরপর আর কোনোদিনও মনে হয়নি তুমি আমাকে চেয়েছিলে।” 

“আরাব, আমি পৃথিবীর নিকৃষ্টতম বাবা। জানি না এখন কিছু চাইলেই হবে কিনা, তারপরও আমার শেষ ইচ্ছা…… আমাকে মনে করে তুমি যাতে আর কনদিন কষ্ট না পাও।”

“বাবা, আমি কি এখানে তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারব?”



‘য়’

 

শ্মশানপুরের ধেড়ে ইঁদুরটা ক্রমশ লেজ নাচিয়েই যাচ্ছিল। সাঙ্গ-পাঙ্গদের সাথে বেশ জমিয়েই চলছে তার আড্ডা। এখানে সবাই শোনে তার কথা। মাংসের পচনের খবরটা সবার আগে সেই তো শুঁকে বের করে। তার দাঁতগুলো দেখতে ছোট হলে কি হবে, এর পরিশ্রমে খুঁড়ে তৈরি করা গর্তেই কিন্তু সবার আহার। তার সঙ্গি গুবরে পোকাদের উষ্ণতার উৎসও এই গর্ত। বাস্তুসংস্থানের এ মিলিত প্রক্রিয়ায় হেসে খেলে দিব্যি চলে যাচ্ছে তাদের জীবন। তবে লাশ না পেলে গুবরে বন্ধুরা বাঁচে না। ওরা বাঁচে পঁচে গলে যাওয়া মাংসপিণ্ডে লার্ভা জন্মিয়ে। শালাদের ভোজনপর্ব কখনও শেষ হবার নামই যেন নিতে চায় না। পেটুক লাশখেকোর দল লাশ ঘরে ছোপ ছোপ রক্তের উপর অনন্তকাল ধরে খাবার খেয়ে কাটায়। গলে শুকিয়ে মরে থাকা রক্তের গন্ধে এদের তীব্র গর্ভ যন্ত্রণার আসক্তি বাড়ে। পেটুকগুল খেতে খেতে টের না পেয়ে বমি করে দেয়, সেই বমিতে ভিজে চুপসে তারা স্নান করে। এতে কি হয়? তাদের সুগন্ধের স্নানঘরে দূর থেকে আসা বড় চারপেয়ে দুর্গন্ধগুলো নিজেদের ভাগ বসাতে হিমশিম খায়। লাশঘরের মজার স্তরগুলোর অধিকার শুধু তাদেরই থাকে। চারপেয়েগুল চোখ চাটতে পারে না, নির্গন্ধ নাকে শ্বাস নিয়ে তাদের করালের ধার সমৃদ্ধ চোয়ালের জোর খাটাতে পারে না। ক্রমশই লার্ভাবাসে রূপ নিতে থাকা করুনার দেহ দেখে তারাও মুখ ফিরিয়ে নেয়। করুনা অগ্রাহ্য করে তারা খুঁজতে থাকে নিজেদের সাধগ্রহ। সেখানে তাজা মরা দেহের কামাকর্ষণের কাম যোগাযোগ বুঝতে চায় তাদের লালাসিক্ত চোখ। একজনমে কারও ভাগ্যে এই তৃষ্ণাসুধা লেখা থাকে কি না, তারা এর খোঁজ জানতে চায়। কিছু কিছু চারপেয়েদের গা থেকে এই সৌভাগ্যের গন্ধ বের হয়। দুর্ভাগা চারপেয়েগুলো করুনার স্বরে তাদেরক গ্রহনের আর্তি জানায়, বিঘল চোখে, পৌরাবৃত্তির সুরে। মৌনব্রতী চারপেয়েগুলো কিছুটা দিশেহারা হয়। তাদের সৌভাগ্য ধেয়ে আসা দুর্ভাগ্যগুলোকে আলিঙ্গন করে, চুমু দেয়, জট বাঁধে, নতুন রক্ত তৈরি করে। জন্ম নেয় একদল তৈরি শিকারি। আর সেই সাথে জন্ম নেয় সব নতুন রহস্য। 


রহস্যের একচোখ একদিন হঠাৎ বন্ধ হয়েছিল। কোন বদ্ধঘরে আবদ্ধ সেই শিশু, দেখতে হাজির হয়েছিল সাদা-কাল অবাস্তবতা। অবাস্তবতা বুঝেছিল কারও ক্ষীয় সাধের অপূর্ণতা, আরও জানতে চেয়েছিল সে নিজে কেন এত ক্ষমতা রাখে এত অপুর্ণ পৃথিবীতে? মোহ কাটার পর সে নিজে জীবন নেয় কোন শ্মশানপুরে, জঘন্য বিস্মৃত অবস্থায়। তার শেষমেশ মনে হতে থাকে, আছে হয়তোবা অদুরে কোন জীবনপুর। সে সাথে সাথেই ঠিক করল রাকিবকে সেই জীবনপুরে ফের পাঠাতে হবে।

 

রাকিবের অবাস্তব অদৃশ্যতা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে লাগল শরীরের ধীর স্পন্দনে। অনুকোষ প্রতিকোষ সব ব্যাস্ত হয়ে খবর পাঠাচ্ছে নিজেদের। তারা একে অপরকে জানাচ্ছে একটি সাদা কাক খুঁজে পাওয়ার গল্প। সাদাকাকটি চোখ খুলে তাদেরক ফিরতি খবর পাঠাল, কে যেন কয়েকশ বছর ধরে ঘষে মেজে তার সব কাল পালক খুলে নিয়ে গেছে। তাকে তাই পুরাপুরি সাদা দেখাচ্ছে।  



 

জীবনপুর

 

ছেলেবেলার খেলার বারান্দাটা। ডানপাশে রেলিং ঘেঁষে রাখা ওই ভাঙা সাইকেলটায় স্বপ্নের চাকা ঘুরাতাম। সাইকেলের ব্রেক ছিল ভাঙা  কিন্তু ক্রিং ক্রিং বেল বাজত ঠিকই। জং ধরা হেড টিউব ফুটো ফুটো হয়ে গিয়েছিল আমার নিত্যনতুন বাহারি ইচ্ছাস্বপ্নগুলোকে স্মৃতিবন্দি করতে যেয়ে। বেচারার দোষ কি, যান্ত্রিক আক্কেলের যা বোঝার কথা না, সে তো তাই বুঝে আসছিল। ব্যাটা প্রায়দিন দেখত একটা ছোট সাইজের অত্যাচার তার ভাইবন্ধু স্যাডেলের উপর জমে বসে উঠতি কবি হবার তীব্র অপচেষ্টায় নিয়োজিত হয়ে উদাস উদাস ভাব করে বেহায়া মনে তার চারপাশটা আঁকছে। তাঁর বিরাশি বছরের জীবনের সমস্যা সেটা না, সে দেখেই আসছে, ছোটবেলায় সবাই নিজেদের বড় ভাবতে আনন্দ পায়। ব্যাপারটা দেখতেও বেশ মিষ্টি। কিন্ত মিষ্টতাতে আর বুড়ো বাচে না, বিশেষ করে আমি তার সামনে থাকলে।  বেচারার রাতের বেলাও শান্তির জো ছিল না। আমি স্যারবাবু বিচিত্র সব তালবাহানা নিয়ে তাঁর সামনে হাজির হতাম। মশাই একদিন না পেরে আমাকে তার গায়ের উপর থেকে ফেলে দিয়ে বললেন ”শালা রাকিব তুই আপাদমস্তক একটা আনমনা ইডিয়ট। তুই চটুল কবি হবি ভাল কথা, কিন্তু তোর  ছোট্ট সরস অঙ্গটার যে এখন ঘুমানোর বয়স তা আমার ক্যান বুঝতে হবে? শালা খুব তো জোরে প্যাডেল ঘুরাস আর আইরিন বান্ধবী মারাস,তোমার খোলা জানালার পোঁতার বারি তো আমার খাওয়া লাগে! আজকে জুলেখা বুয়া এই নিয়ে হাসাহাসি কইরা আমার ইজ্জত খাইছে, আমি ভাইঙ্গা যায়া তোর পোঁতা একদিন গুরা গুরা করুম, তুই দেখিছ।” আমি ইবলিশ, আকামের জাত ইজ্জত সব ধুয়ে দিতাম ওই বুড়োটার গায়ে। বাবার কাছ থেকে চুরির সিগারেট এনে টেনে ধোঁয়ার কুয়াশা বানায়ে রাখতাম আর ছাই ফেলতাম বুড়োর ফুটো দেহে। আরও ছোট থাকতে দুঃসাহসের তো অভাব ছিল না, বুড়োকে রীতিমত কেয়ামতের দিন দেখান হতো কিছু সময়। ইঞ্জিনিয়ার সেজে হাতুড়ি নিয়ে বসতাম পিটিয়ে বুড়োকে শেপ এ আনতে। মশাই পারলে পা ধরে একদিন ক্ষমাই চাইতেন, “ কুত্তা আর পিটাইছ না। দ্যাখ টবের ক্যাকটাসটার কাঁটাও কাঁপতেছে। আমার জান থাকলে আমগাছের কাকগুলার সাথে উইরা যাইতাম। খ্যামা দে এবার।” অবশেষে একদিন বাবা ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হলেন এবং বুড়োকে বাঁচালেন। দেখলাম বুড়োর সুখের দিনগুলো। বাবার শখের বুড়ো বাবাকে কিছুক্ষণের জন্য পেলেই সুখে থাকতেন, আমার অত্যাচার আর গায়ে মাখাতেন না। প্রায়সময় তাদের দেখতাম ছেলেবেলার গল্প করতে। বড় মধুর ছিল সেসব দিন।


বুড়ো বাবা এখন গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার। বয়স তাঁর একশত্রিশ ছুঁই ছুঁই। তাঁর পুরো শরীরে বার্ধক্যের জং আর অনেক বছরের ময়লা লেপটান। কাছে গিয়ে স্পর্শ করলাম বুড়োকে আর অমনি খটমট শব্দে গান ছেড়ে দিলেন। গান না অভিযোগ তা বুড়োই ভাল জানে। আমি চেষ্টা করেছি সবার স্মৃতিগুলো ধরে রাখতে। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর পা জোড়া সরাসরি এখানে টানছিল, আমাদের পুরনো বাড়িটার চৌকাঠে। নিমা, আরাবও সঙ্গে এসেছে। আর আমরা সবাই এখন প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। 



 

রহস্য                                                            

 

রহস্য সদাহাস্য একটা চরিত্র। যার নিয়মনীতি বাঁকা স্বভাবের কিন্তু ভাবনা পরিষ্কার। তাঁর মজার দেনা তা যে করেই হোক সে ধার্য করেই ছাড়বে। আমরা এতক্ষন ধরে জেনে আসছিলাম তাঁর সুসময়- দুঃসময়ের উপস্থিতি ও তার তীব্র প্রভাব। দেখলাম তিনি নতুন পরিবেশ তৈরি করেন এবং ধ্বংস করেন। তাঁর অনেকদিনের শখ ধ্বংসের আনন্দটা কাউকে সাথে নিয়ে উপভোগ করবেন। আজ অনেকদিন পর, নিয়মের বাইরে তিনি একজন সঙ্গী পেতে চলেছেন। ঘটনাটা কিভাবে ঘটবে তা তিনি নিজেও জানেন না।



চরিত্রেরা নিজেদের সাথে কথা বলে


“মানুষের জীবনকালের মত তাদের আত্নারও সম্ভবত তিনটি পর্যায় থাকে। শিশু আত্না, তরুন আত্না ও বৃদ্ধ আত্না। তাই নয় কি? শরীর ছাড়ার পড়ে সব নিয়ম কানুনের সাথে পরিচিত হতে থাকে খুব সম্ভবত শিশু আত্না। নিয়মকানুনের মাঝে বেড়ে উঠবাঁর পর যার সব বেদরকারি আর অসহ্য লাগে সেটা মেবি তরুন আত্না। আর এ সব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ঋদ্ধ যে আত্না তিনি বৃদ্ধ আত্না।”


নিজের মনে কথা আওড়াচ্ছিল রাকিব। শ্যুট শেষ করে এসে প্রতিদিন সে পরেরদিনের শটগুলোর রিহার্সেল করে। আজকে তা করছে না। কদিন ধরেই কিছু এলোমেলো ঘটনা দেখছে চারপাশে। নিজেও এক্সপেরিয়েন্স করছিল কিছু সমস্যার। সারা শরীর ধুপ করে অবশ হয়ে পড়ে, হঠাৎ কোন কারন ছাড়াই কেঁপে ওঠে। ডাক্তার বলেছে সব ওকে,কোন সমস্যা নেই, শুধু কাজের প্রেশারটা একটু কম নিতে। কিন্তু অস্পষ্টভাবে প্রায়দিনই একজনকে আশপাশে দেখা যাচ্ছে এবং তার জোড়ালো মনে হচ্ছে শুধু সেই দেখছে এই অবয়ব আর কেউ না। ডাক্তার চেক করে দেখেছিল ঠিক স্ট্রোকের আগের কিছু স্মৃতি তার একেবারেই মনে নেই। রাকিবের তা মনে হয় না। এই অস্পষ্ট অবয়ব তার পূর্বপরিচিত। কিন্তু তাকে দেখে তার শরীর খারাপ করছে না, কিংবা অস্বস্তিও হচ্ছে না। দেখবার কিচ্ছুক্ষন পর ওসব উপসর্গ দেখা দেয়। এখন হোটেল রুমে ইন্টিমেট একাকীত্বে কিছু অদ্ভুত চিন্তায় একটা সমীকরন মেলানোর চেষ্টা করছে। যার উৎস এ জগৎ সংশ্লিষ্ট না। অবচেতনে পরকাল কেন ধেয়ে আসছে, তা বিভিন্ন প্রশ্ন উত্তরে জানতে চাওয়াটাই উদ্দেশ্য ওর।

“ভুল ভাবলে যারিফ। আরেকজন বিশেষ আত্নাকে তুমি লিস্টে রাখনি। মৃত আত্না।”

”যারা মানুষ হিসেবে এ দুনিয়ায় বাস করছে তারা?”

“ তারাতো অদম্য আত্না। মৃত আত্নাদের সাথে যাদের উঠাবসা।”

”খায়ে দায়ে কাজ নাই কারও। মৃত কি আবার? সব তো জীবিত! আমার তো যোগাযোগের জন্য শারিরিক সংস্পর্শের দরকার হয় না। মৃতদের এনার্জি এমনেই ফিল করি। কই কেউ মৃত?” 

“তুমি মৃত না জীবিত বলতে পারবে যারিফ?”

”তোমার ভাষায় যারা মৃত তারা আমাকে কি বলে?”

“এখনও কিছুই বলে না। তবে অনেক কিছুই বলবে। অনেক নামই দিবে। আমাকে প্রথমে ডাকত প্রান্ত…… সবশেষে কি নাম আসল জান যারিফ? ত্রিধা ! আমিতো অলরেডি তোমাকে যারিফ নামে ডাকা শুরু করে দিয়েছি। সো তোমার নাম নিয়ে এত ভাবতে হবে না।”

“আরে বাহ্‌, তোমার কোল থেকে দেখি খুব সুন্দর ঘ্রাণ আসছে। কি কড়া ঘ্রাণ রে বাবা!!! শেষমেশ ঘুম নামিয়েই দিলে…………………………………...