পোস্টস

চিন্তা

বাতিল হতে যাওয়া কারিকুলাম: শিক্ষক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা

৩১ অক্টোবর ২০২৪

মাহমুদুল হক

নতুন কারিকুলামের গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা 

আমাদের সকলের জানা আছে, বিগত সরকার শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের পরিকল্পনা হাতে নেয় এবং  নতুন কারিকুলাম তৈরি করে এবং দীর্ঘ মেয়াদে এর বাস্তবায়ন শুরু করে। কারিকুলাম বাস্তবায়নের পূর্ব থেকে এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে আলাপ শুরু হয়। বিশেষ করে বাস্তবায়ন শুরু হলে সরকারী দল এবং সংশ্লিষ্ট কতিপয় বুদ্ধিজীবী ব্যতীত অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক দল, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ অভিভাবকগণ ও এর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে। সরকার এসবে পাত্তা না দিয়ে নতুন কারিকুলমের  পক্ষে প্রচারণা এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে শিক্ষা কর্মকর্তা এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। শিক্ষক হিসেবে বেসরকারিভাবে বহুবার এবং সরকারিভাবে দুই বার কারিকুলাম এবং নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সাথে কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত বিষয় ও পাঠদান করি। আজকে আমি আপনাদের সাথে আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো।

 

১. প্রশিক্ষণ:

 বেসরকারিভাবে, সরকারি দুই ভাবে অনেক গুলো প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। যার একটি ছিল সাতদিন, একটি চার দিন বাকিগুলো একদিন, অর্ধদিন ব্যাপী। প্রতিটি প্রশিক্ষণেই দেখেছি, প্রশিক্ষকগণ কারিকুলাম এর দিকগুলো ক্লিয়ার করতে পারেন নাই। বরং ভাসা ভাসা একটা ধারণা দিয়ে গেছেন। বিষয়ভিত্তিক গুলোতে প্রশিক্ষকগণ পাঠ্যইয়ের নির্দিষ্ট  অভিজ্ঞতায় যে বর্ণনা দেওয়া আছে তার বাহিরে প্রশ্ন করলে বলতে পারেন না। এক ঘন্টার কাজকে তিন ঘন্টায় দীর্ঘায়িত করেছেন। ভূমিকায় যে পরিমাণ সময় নিতেন মূল আলোচনায় সে হিসেবে সময় কম নিতেন না। অথচ আমরা জেনেছি, প্রশিক্ষকগণ আমাদের তিনগুণ ভাতা পেয়েছেন প্রতিদিনের জন্য। তবে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করা হয়েছে। এটা ভালো দিক এবং সময়োপযোগী। 

 

২. পাঠ্যবই:

পাঠ্যবই গুলো কভার পেজ এবং ভেতরের গ্রাফিক্স সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। অভিজ্ঞতার শিরোনামগুলো ও আকর্ষণীয় ছিল। সিলেবাস এবং টেক্সট এর ব্যাপারে আমি দুইটি বিষয় নিয়ে বলবো। ১. ডিজিটাল প্রযুক্তি ২. শিল্প ও সংস্কৃতি । অন্য বিষয় গুলো নিয়ে বলবো না। কারণ, অন্যগুলোর ব্যাপারে আমার পুরোপুরি ধারণা নেই। 

 

২.১: ডিজিটাল প্রযুক্তি 

ডিজিটাল প্রযুক্তি বইগুলো আমার দৃষ্টিতে উপযুক্ত ছিল। শ্রেণি অনুযায়ী পর্যায় এবং ধারাবাহিকতা ভালো ছিল। যথাযথ ব্যবহারিক সেশন নেওয়া সম্ভব হলে ডিজিটাল প্রযুক্তি বইগুলো আমাদের নতুন প্রজন্মকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতো। 

কিন্তু চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী বর্তমান এবং ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকার যদি বিষয়টি বাতিল করে অথবা বিষয় ঠিক রেখে পাঠ্যবই বাতিল করে - এটা অবিবেচক সিদ্ধান্ত হবে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে সংস্কার হতে পারে। 

 

২.২: শিল্প ও সংস্কৃতি 

আমাদের এই দেশ ধর্মপ্রাণ মানুষের দেশ। শিল্প ও সংস্কৃতিতে দেশ, অঞ্চল এবং সমাজের পাশাপাশি ধর্মের বিরাট প্রভাব এবং ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এই বইগুলো প্রণেতাগণ সেটা বিবেচনায় আনেন নি। যার ফলে ছোট এবং কম গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই বিষয়ের পাঠ্যবইগুলো ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

 শিল্প ও সংস্কৃতি কারিকুলামে নতুন সংযোজন। বর্তমান সামাজিক অবক্ষয় এবং ভিনদেশী সংস্কৃতি থেকে তরুণ সমাজকে ফেরাতে বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো। যদি প্রতিষ্ঠানের ভিন্নতা, ধর্মীয় আবহ এবং দেশের আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে বিবেচনায় রেখে পাঠ্যবই তৈরি করা হতো। বরং পাঠদানের সময় মনে হয়েছে, তারা বিশেষ কিছু বিষয় চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। 

এক্ষেত্রে পাঠদান অভিজ্ঞতা থেকে বলবো, প্রথমেই মাদ্রাসা এবং ইশকুলের জন্য এ বিষয়ের আলাদা বই তৈরি করতে হবে। মাদরাসার শিক্ষার্থীদের যেমন নাচের অংক শিখানো ভুল, ইশকুলের শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে অমুসলিম শিক্ষার্থীদের ক্বেরাত, গজল শিখানো ও ভুল। দ্বিতীয়ত, একজন শিক্ষার্থী সমানভাবে অংকণ, নাচ, গান, ক্বেরাত, গজল, লেখালেখি সব বিষয়ে আগ্রহী হবে না। উপভোগের ক্ষেত্রে সবাইকে সমান বিবেচনা করা হলে ও চর্চায় যার যার রুচি, আগ্রহের উপর ছেড়ে দিতে হবে।

এ বিষয়ের ক্ষেত্রে ও আমি বলবো, বাতিল না করে সংস্কার করুন।

 

৩. শ্রেণি কার্যক্রম 

এই কারিকুলাম বাস্তবায়নে প্রতিটি ক্লাস পিরিয়ড কমপক্ষে ৪৫ মিনিট, শিক্ষার্থী সংখ্যা সর্বোচ্চ চল্লিশ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমার এলাকার অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এবং নিজ প্রতিষ্ঠানে ও এই দুইটি বিষয় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল। ফলে দলগত কাজ, একক কাজ  অর্ধেক ও আদায় সম্ভব হয় নি।

 

৪. নৈপুণ্য এপ

এই কারিকুলামের সবচেয়ে বিরক্তিকর এবং সময়খেকো অংশ ছিল নৈপুণ্য এপ। এক কথায়, এর নামটাই শুধু চমৎকার ছিল।

 

৫. পরিভাষা 

পরীক্ষার পরিবর্তে মূল্যায়ন, অধ্যায়ের পরিবর্তে অভিজ্ঞতা, বিমূর্ত ধারণায়ন এরকম অনেক নতুন পরিভাষায় সাথে আমরা পরিচিত হয়েছি যেগুলো পুরো বিষয়টাকে ভারি করে তুলেছিল।

 

পরিশেষে একটি কথাই বলবো, বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদেরকে ও এগিয়ে যেতে হবে। অতএব বিগত আওয়ামী লীগ সরকার গৃহীত নতুন কারিকুলাম এক কলমে বাতিল করে না দিয়ে  পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় জাতিকে শক্তিশালী এবং যোগ্য করে গড়ে তোলার লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে।