চশমার ইতিহাসের গভীরে ঢুকলে দেখা যায়, এর অনেক বিস্ময়কর গল্প ও উদ্ভাবনী প্রচেষ্টার পেছনে রোমাঞ্চকর ঘটনা রয়েছে।
# প্রাচীন যুগের চশমার পূর্বসূরি:
প্রাচীন রোমানরা প্রথম দিকে পড়ার জন্য পানি ভরা কাঁচের গ্লোব বা গ্লাস ব্যবহার করতেন। ১ম শতাব্দীর রোমান দার্শনিক সেনেকা সম্ভবত এই কাঁচের সাহায্যে বিভিন্ন লেখা বড় করে দেখতেন, যা আধুনিক ম্যাগনিফাইং গ্লাসের প্রথম উদাহরণ হতে পারে। এছাড়া, চীনের হান রাজবংশের সময়কালেও বিভিন্ন ধরণের কাঁচের লেন্স ব্যবহারের প্রচলন ছিল। তবে তখনকার লেন্সগুলোর ব্যবহার শুধুমাত্র দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর জন্য ছিল না; অনেক সময় তারা এগুলোকে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যও ব্যবহার করতেন।
# ইবনে আল-হাইথাম এবং অপটিক্সের আবিষ্কার:
১০ম শতাব্দীর আরব বিজ্ঞানী ইবনে আল-হাইথাম অপটিক্স নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন এবং চশমার উন্নয়নে অবদান রাখেন। তার গবেষণাগ্রন্থ *"কিতাব আল মানাজির"* (The Book of Optics) আলো, লেন্স এবং দৃষ্টির তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে রচিত, যা পরবর্তীকালে ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের চশমার প্রযুক্তি উন্নত করতে সহায়তা করেছিল। তার কাজের মাধ্যমে আলো কীভাবে চোখে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন রঙের প্রতিফলন ঘটে সে সম্পর্কে প্রথম সঠিক ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়।
# ইতালিতে প্রথম চশমার আবির্ভাব:
প্রথম চশমার পরিচিত উদাহরণটি ১২৮৬ সালে ইতালির পিসা শহরে তৈরি হয়েছিল। এটি ছিল দুটি উত্তল কাচের টুকরো যা কাঠ বা ধাতুর ফ্রেমে বসানো ছিল। এই চশমা চোখে ধরতে হতো এবং এতে দূরের বা কাছের বস্তু বড় দেখাতো। তবে এটিকে পরিধান করা বেশ অস্বস্তিকর ছিল। এরপর, ১৩০০-এর দশকে এটি সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। এই চশমার আসল উদ্ভাবক কে ছিলেন, তা নিয়ে দ্বিমত আছে, তবে অনেকেই মনে করেন ভিনসেন্তে বোভির মতো কিছু ফ্রিয়ার্স বা সন্ন্যাসীর দল এই ধরনের চশমার প্রথম সংস্করণ তৈরি করেছিলেন।
# এক মজার ঘটনা:
১৪০০ শতকের দিকে চশমার জনপ্রিয়তা বাড়লেও অনেকেই তখনও এটিকে এক প্রকার জাদুকরী বস্তু বলে ভাবতেন। তাই সমাজে উচ্চ শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে চশমা পরা ছিল এক ধরণের সম্মানের ব্যাপার। চশমা তখন ধনী মানুষদের মাঝে শুধুমাত্র ফ্যাশনের জন্য পরা হতো, এমনকি যাদের দৃষ্টির কোনো সমস্যা ছিল না তারাও চোখের নিচে চশমা ঝুলিয়ে রাখতেন!
# বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের দ্বি-ফোকাল চশমা:
বিখ্যাত মার্কিন বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তার নিজের চোখের জন্য ১৭৮৪ সালে একটি বিশেষ ধরণের চশমা তৈরি করেন। তার দৃষ্টি দুর্বল হয়ে পড়েছিল এবং তিনি কাছের ও দূরের জিনিস দেখতে দুটি ভিন্ন চশমার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। তিনি একটি দ্বি-ফোকাল লেন্স তৈরি করলেন, যার উপরের অংশ দিয়ে দূরের বস্তু এবং নিচের অংশ দিয়ে কাছের বস্তু দেখা যেত। এই দ্বি-ফোকাল চশমা পরবর্তী সময়ে মানুষের জীবনকে অনেক সহজ করে তুলেছিল।
# এক দারুণ কাহিনি: নেপোলিয়নের স্পাই গ্লাস
নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সময়েও একটি ছোট আকারের বিশেষ চশমা, যা এখন আমরা স্পাই গ্লাস নামে জানি, প্রচলিত ছিল। বলা হয় যে, নেপোলিয়ন তার বিভিন্ন যুদ্ধে এই গ্লাস ব্যবহার করতেন এবং প্রয়োজনীয় স্থানে চোখের দৃষ্টি বাড়াতে এটি নিয়ে তিনি অনেক পরিকল্পনা করতেন। আবার তিনি তার সেনাদেরও দূরের শত্রু পর্যবেক্ষণের জন্য এই ধরণের ছোট চশমা সরবরাহ করতেন।
# আধুনিক যুগের চশমা এবং ফ্যাশন স্টেটমেন্ট:
১৮শ ও ১৯শ শতাব্দীতে চশমা ফ্যাশনের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাঝে চশমা পরার বিশেষ রীতি তৈরি হয়। প্রথম দিকে, রঙিন ফ্রেম ও ডিজাইনের চশমা ব্যবহার করা হতো কেবল সমাজের উচ্চবিত্তদের মধ্যে। এমনকি প্রখ্যাত রাজা-রানীরাও বিভিন্ন রঙের চশমা পরতেন যা পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের মাঝে ফ্যাশন হিসেবে প্রচলিত হয়। ১৯শ শতাব্দীতে লর্ড বাইরন তার আয়না-ফ্রেমের চশমা নিয়ে খুবই পরিচিত ছিলেন।
আজকের দিনে চশমার প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে। স্মার্ট গ্লাস প্রযুক্তি চশমায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে যেখানে আমাদের স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের কাজগুলোও চশমার মাধ্যমে করা সম্ভব। অতএব, চশমার ইতিহাস কেবল চোখের দৃষ্টি বাড়ানোর যন্ত্র থেকে শুরু হয়ে আজ এক উচ্চ প্রযুক্তির ফ্যাশন ও যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।