আমরা যেকোনো মানুষকেই যদি জিজ্ঞেস করি তাদের মতে দুনিয়ার সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ কোনটি, নিঃসন্দেহে ‘ধর্ষন’ তাদের উত্তরে সামিল থাকবে। আমাদের রোজকার আলাপ-আলোচনা, আড্ডায় যদিওবা ধর্ষনের জন্য ধর্ষিতা/ধর্ষিতদের ওপর দোষারোপ করা নেহায়েতই সাধারন বিষয় তবুও ধর্ষন যে জঘন্য অপরাধ এ নিয়ে মতভেদ দেখার অবকাশ কম। ধর্ষকের প্রতি ক্ষোভ আর ঘৃণাও আমাদের অসামান্য। থাকাই উচিৎ। বিশেষ করে যখনই কোনো ধর্ষনের ঘটনা জাতীয় হেডলাইনে উঠে আসে, সবার প্রথম প্রতিক্রিয়াই হয়- ধর্ষকের ফাঁসির দাবি তোলা। ধর্ষন বিরোধী যেকোনো প্রতিবাদ কর্মসূচিতেও এই দাবি উঠে আসে। আজকের লেখাটা সে বিষয়ক নয়, ধর্ষকদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানোও এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরঞ্চ ধর্ষন যে নিঃসন্দেহে মানবসমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট অপরাধগুলোর একটি- এই সত্যটুকু মেনে এবং ধর্ষনের যেই সংসস্কৃতি আমাদের সমাজে বিরাজমান সেটি প্রতিরোধের উদ্দেশ্য নিয়েই আমি লিখছি।
প্রথমেই দুইটি বিষয়ের বিবরণ দেওয়া একান্ত প্রয়োজনীয়- প্রথমটি হলো “ধর্ষনের সংস্কৃতি” এবং দ্বিতীয়টি হলো “ধর্ষকের অমানবীকরন” ইঙ্গরেজিতে যাকে বলে "ডিহিউম্যানাইজেসন"
"রেপ কালচার" বা ধর্ষনের সংস্কৃতি
সমাজে যখন কোনো রীতি বা ঘটনা এতটাই স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে যে মানুষ সেটাকে মেনে নেয়, পরবর্তী প্রজন্মকেও শিক্ষা দেয় এবং সেই রীতির প্রতি সংরক্ষণশীল আচরণ করে, তখন সেটিকে উক্ত সমাজের সংস্কৃতির অংশই বলা চলে। তো স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে ধর্ষন কিভাবে আবার সংস্কৃতির অংশ হলো। ‘রেপ কালচার’ শুধু এদেশেই নয় সারা দুনিয়ায় বিরাজমান। ‘রেপ কালচার’ বলতে কেবল ধর্ষন করা বা ধর্ষকের জন্য সাফাই গাওয়াকে বোঝায় না বরং এমন যেকোনো কাজ যা যৌন নির্যাতনে অনুপ্রেরণা যোগায়, পীড়িতের কাঁধে দোষ চাপিয়ে দেয় কিংবা সরাসরি যৌন নির্যাতনের পক্ষ নেয়- এসকলই ‘রেপ কালচারের’ নিয়ামক। যেমনঃ এমন সিনেমা যা নারীদেরকে উত্তক্ত করা কিংবা নারীর মর্জির খেলাফে তার পিছু নেয়াকে “নায়কীয়” হিসেবে দেখায় বা মহিমান্বিত করে, এমন বক্তব্য যে,“ওমন পোষাক পরে এত রাতে একা বাড়ি ফিরতে গেলে তো ধর্ষন করবেই!” কিংবা তিল থেকে তাল খসলেই নারীর চরিত্র সম্পর্কে রায় শুনিয়ে দেওয়া- এসবই ‘রেপ কালচারের’ অংশ। সমাজের চিরায়ত এই অপরাধমূলক মনোভাব ও আচরণগুলো এই ধারনাকেই ছোট্টবেলা থেকে শিশুদের প্রবল করে গেঁথে দেয় যে নারীদের নিরাপত্তার দায় নারীদের নিজেদের এবং কোনো নারীর পোষাকে, চাল-চলনে কিংবা ব্যবহারে যদি কোনো পুরুষের মনে এই চিন্তার বিন্দুমাত্র সঞ্চারণ ঘটে যে উক্ত নারীর চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ সেক্ষেত্রে নারীটিকে হয়রানি করা জায়েজ হয়ে যায়। (এখানে মূলত যৌন অপরাধের নারী নিপীড়িতদের প্রসঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। পুরুষরাও যে যৌন নিপীড়নের শিকার এটি অনস্বীকার্য।)
তবে শুধু নারীকে দোষারোপ করেই আসনে ক্ষান্তি নেই, একই সঙ্গে জোর দেওয়া হয় “টক্সিক মাসকিউলিনিটি” বা “বিষাক্ত পুরুষত্ব” এর ধারণায়। ধারণাটি কেমন? “পুরুষরা তো একটু অমনই হয়,” “অমন নারীকে দেখেও যে উত্তেজিত হবে না সে পুরুষই না” কিংবা স্বঘোষিত দার্শনিক আসিফ মাহতাব উতস প্রদত্ত ধারণা যা দুনিয়ার তাবত ‘'রেপ এপলজিস্ট'দের কাছে বাইবেলের বাণীর ন্যায় প্রিয়- ”পুরুষদের সহজাত প্রবৃত্তিই হলো ধর্ষন করা। ভাইকিংরা ধর্ষন করেছে, অমুক সম্প্রদায়-তমুক সম্প্রদায় ধর্ষন করেছে। আমরা আসলে অনেক কষ্টে নারী দেখলেও ধর্ষন করা থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখি। এমন পরিস্থিতিতে এই যে মেয়েরা সাজগোজ করে বের-টের হয়, তাদের কারণে নিজেদের পাষবিক প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা আমাদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে,” - এই সকল ধরণের ধারণাই সোজা বাংলায় পুরুষ শাসিত সমাজের “টক্সিক ম্যাসকিউলিনিটির” অংশ। এর ফলে ধর্ষকের কাজ সমাজে আরেকটু গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়। মানুষকে বলতে শোনা যায়, “হ্যাঁ ধর্ষক তো অপরাধ করেছেই কিন্তু মেয়েরা এইভাবে ওড়না ছাড়া চললে অমন যুবক ছেলে-পেলেরা নিজেদের সামলাবে কি করে বলুন দেখি?”
রেপ কালচার নিয়ে আলাপ তবে ফুরোলো, কিন্তু রেপ কালচার যদি থেকেই থাকে তবে ধর্ষকের অমানবীকরনটা হচ্ছে কোথায়? অমানবীকরন দু'ভাবে হচ্ছে।
এক, এই যে এই ধারণাটা যে পুরুষ মানুষের সহজাত বা পাষবিক প্রবৃত্তি ধর্ষন করা- এইটা আমাদের তথা পুরুষদের মানুষের স্তর থেকে নামিয়ে পশুর স্তরেই নিয়ে যায়। সমাজে এই ধারণা স্থাপন করা হয় যে, “পুরুষদের ন্যায়-অন্যায়বোধ থাকা তো দূরের কথা ন্যূনতম আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাটুকুও নেই। এইজন্য হাজার শাস্তির ভয় থাকার পরেও ধর্ষন বা যৌন নিপীড়ন করা থেকে তাদের কেউ থামাতে পারবে না।” কিন্তু এটি যে কি ভয়ংকর অপবাদ তা আমরা টেরও পাই না। এর ফলে সমাজের নারী-পুরুষ সকলেই, এমনকি ছেলে শিশুরাও এটি বিশ্বাস করেই বেড়ে উঠে যে ছেলেরা “অমন-ই”। আর যৌন নিপীড়নের ক্ষেত্রে যদি পীড়িতের দায়-ই বেশি হয়, তাহলে অপরাধ করলে অপরাধটা কোথায়?
কিন্তু আরও ভয়ংকর হলো ধর্ষকদের সরাসরি পশু ভাবতে শুরু করা। এই ধারণাটাও আমাদের সবারই পরিচিত। দিল্লির নির্ভয়া গ্যাং রেপ কেস কিংবা কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ৫ বছরের শিশুকে গ্যাংরেপ করার কেসটির কথা মনে করলে দেখতে পাব যে- আমরা এমন অপরাধের কথা শুনলেই বলে দেই- “এটা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব হতে পারে না। ওরা তো “পশু”, “ অমানুষ”,“শয়তান” অথবা “জানোয়ার।"
কারণ কি? কারণ হলো আমরা মানতে চাই না যে, প্রতিটি ধর্ষনের জন্য আমরা সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ। কেননা, যদি সব ধর্ষকদেরকে “অমানুষ” বলে চালিয়ে দেওয়া যায় সেক্ষেত্রে আমাদের আর সমাজ সংস্কারের ঝক্কি পোহাতে হবে না। যে জানোয়ার তাকে আপনি যতই শেখান, সে তো জানোয়ারই থাকবে। তাকে তো আর মানুষ করা যাবে না। সে অপরাধী কেবলই তার নিজের দোষেই। সুতরাং সমাজের আর কি দায়?
কিন্তু ধর্ষক কখনো ধর্ষন করে অপরাধের হাতেখড়ি করে না। সে যৌন নিপীড়ক হয়ে উঠে হয়ত ইভটিজিং করে, অবাঞ্চিতভাবে কাউকে স্পর্শ করে, কারো মর্জির বিরুদ্ধে তার পিছু নিয়ে অথবা কাউকে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করার মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিবার সে বেঁচে যায়। এমনকি বন্ধু মহলের প্রসংশাও পায়। তার ‘'ভিক্টিমকে” বলা হয় চুপ করে যেতে নয়তো বদনাম হবে। অপরাধীর সাহস বাড়তে থাকে এবং সেই সাথে তার অপরাধের পরিধিও।
এই অমানবীকরনের আরেকটা পুরুষতান্ত্রিক উপযোগ হচ্ছে নারীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ধর্ষক যদি জানোয়ার বা শয়তানই হয়- তাকে আটকানোর তো কোনো উপায় নাই। সে তো আইনের তোয়াক্কাও করে না আর নৈতিকতারও বালাই নাই তার কাছে। তবে মেয়েদের বাঁচাবেন কি করে? বাইরে বের হতে না দিয়ে। ওড়না ছাড়া তো একদমই না। চাকরি করলে রাত হয় বাড়ি ফিরতে? চাকরি করতে দেওয়া যাবে না।
অনেকে আসলেই তাদের পরিবারের মেয়েদেরকে সুরক্ষার উদ্দেশ্যেই এমন শর্ত চাপিয়ে দেয়। কারণ যতদিন পর্যন্ত না ধর্ষকদের আমরা মানুষ হিসেবে মেনে নিয়ে ধর্ষনকে কোনো নির্দিষ্ট অপরাধীর একক অপরাধ নয়, বরং সমাজের সামষ্টিক ব্যর্থতা বা কদর্যতা হিসেবে স্বীকার করব- ততদিন অব্দি ‘'রেপ কালচারের” অস্তিত্ব সমুন্নত রয়ে যাবে। আত্মরক্ষার জিম্মা দিয়ে নারীদের আটক করে রাখা যাবে।
আর যদি আমরা এই অমানবীকরন বন্ধ করে ধর্ষকদের মানুষ, অনেক জঘন্য মানুষ কিন্তু মানুষ, হিসেবে মেনে নিতে পারি সেক্ষেত্রে আমরা জোর দিতে পারব নারীদের কাঠামোবদ্ধভাবে নিয়মতান্ত্রিক সুরক্ষা প্রদান করার উপর। সেটা সামাজিক, পারিবারিক, দাপ্তরিক এবং রাষ্ট্রীয়- সকল ক্ষেত্রেই নারীর অর্থনৈতিক, গণতান্ত্রিক এবং মানবিক অধিকার সমূহ রক্ষা করার মাধ্যমেই কেবল সম্ভব। একই সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতা স্বীকার করে নিয়ে এগিয়ে গেলে আমরা “রেপ কালচার” দূরীকরণেও মন দিতে পারব। প্রতিটি ধর্ষনের পর ধর্ষিতার উপরে দোষ চাপানো যেমন সুফল বয়ে আনবে না তেমনই হুটহাট রাস্তায় ধর্ষকের ফাঁসি চেয়ে ক'দিন মিছিল করেও লাভ নেই।
আমি ধর্ষকের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে বলছি না বরং যেই ক্ষোভ এবং ঘৃণা আমাদের ধর্ষকের প্রতি রয়েছে, ঠিক ততটা ঘৃণাই এই নারী বিদ্বেষী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ধারন করার আর্জি জানাচ্ছি।