পোস্টস

গল্প

হারিয়ে যাওয়া পথ

১ নভেম্বর ২০২৪

JossThe Boss

অভ্র অনেকদিন পর নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরেছে। ঢাকার ব্যস্ত শহরে চাকরি আর জীবনের ঝক্কি-ঝামেলায় ডুবে থাকার ফলে গ্রামের কথা মনে করাই ভুলে গিয়েছিল। মায়ের মৃত্যুর পর এই বাড়িতে তার পা পড়েনি। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো যেন মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজকের এই নিঃশব্দ রাতে, চারদিকে অন্ধকারের মধ্যে বসে মায়ের স্মৃতিচারণ করতে করতে নিজের শৈশবটা যেন ধীরে ধীরে ফিরে আসছে।

তখন অভ্র ছোট ছিল, মায়ের হাতে হাত ধরে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হাঁটতো। মা তাকে প্রকৃতির সৌন্দর্য বোঝাতো, মাটির গন্ধ শুঁকতে শেখাতো, পাখিদের গান শোনাতো। প্রতিটি বিকেল ছিল যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা। মায়ের সাথে নদীর পাড়ে বসে বুনো ফুলের গন্ধ নেওয়া, ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে দৌড়ানো আর গ্রামের মানুষের সাদামাটা জীবনের কাহিনি শুনে বড় হয়েছে সে।

এখন অভ্র সেই মায়ের শেষ চিঠি হাতে নিয়ে ভাবতে বসে, কতটা দূরে সরে গেছে সে মায়ের কাছ থেকে, গ্রাম থেকে। চিঠিতে মা লিখেছিলেন, “তুই যেখানে আছিস, ভালো থাকিস, সুখে থাকিস। জানি, তুই বড় হয়ে গেছিস, নিজের জীবনে ব্যস্ত। তোর সফলতা আমার জন্য সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তুই যেদিন শেষবার বাড়ি ছেড়েছিলি, মনে হয়েছিল আমার ছোট্ট অভ্রটা যেন পরিপূর্ণ পুরুষ হয়ে উঠেছে। কিন্তু মনে রাখিস, মায়ের হৃদয়ে তুই সেই ছোট্ট অভ্রই রয়ে গেছিস।”

মায়ের কথা পড়ে অভ্রের চোখে জল আসে। জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়ে সে কি আদৌ সুখে আছে? ঢাকার চাকরি, বিলাসবহুল জীবন আর আধুনিক জীবনযাত্রায় কি সত্যিই সে তৃপ্ত? মায়ের সেই সহজ, সরল জীবনটা আর মায়ের স্নেহমাখা আদর কি সে অনুভব করতে পারছে?

এমন সময় হঠাৎ করে অভ্রের মনে পড়ে গ্রামের সেই পুরোনো বটগাছের কথা, যেখানে মা তাকে নিয়ে বসে থাকতেন। সে স্থির করে, আজকে সে সেই জায়গায় যাবে। রাত গভীর হলেও মনে হলো যেন মায়ের স্মৃতি তাকে টানছে। নিজের পুরোনো মাটির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে অভ্র। গ্রামের শান্ত রাত, কেবল জোনাকির আলো আর দূর থেকে শোনা পেঁচার ডাক।

বটগাছের নিচে পৌঁছাতে তার মনে পড়ে মায়ের বলা অনেক গল্প। মা বলতেন, এই বটগাছ নাকি তাদের পূর্বপুরুষের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে। প্রত্যেক প্রজন্মের কেউ না কেউ এই বটগাছের নিচে এসে নিজের মনের কথা বলে যায়। অভ্র ভাবলো, আজ সে মায়ের কাছে তার জীবনের সবকিছু বলবে।

সে বটগাছের নিচে বসে, মনে মনে মায়ের সাথে কথা বলতে শুরু করলো, “মা, জানিস, ঢাকায় অনেক বড় চাকরি পেয়েছি। সবাই আমাকে সম্মান করে, আমার কাজের প্রশংসা করে। কিন্তু মা, তুই কি জানিস, এই চাকরি আমাকে সুখী করতে পারেনি। তুই যখন ছিলি, আমি কোন কিছুর অভাব অনুভব করতাম না। কিন্তু আজকের এই বিলাসবহুল জীবনে কত অশান্তি!”

মনে মনে মায়ের কাছে নিজের জীবনের কথা বলতে বলতে হঠাৎ তার মনে হলো, এই আধুনিক জীবনে সে হারিয়ে গেছে। প্রতিদিনকার অফিসের চাপ, মানসিক দুশ্চিন্তা আর কাজের ব্যস্ততার মধ্যে সে আসলে নিজের সত্তাকে ভুলে গেছে।

এক সময় মায়ের সাথে কাটানো ছোট ছোট মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়তে লাগলো। মায়ের হাতের তৈরি রান্না, সন্ধ্যায় মাটির ঘরের উঠোনে বসে গল্প করা, শীতের সকালে কাঁথার নিচে ঢুকে থাকতে ইচ্ছা করা—সবকিছু যেন মনের ভিতর এক একটা পর্দার মতো উঠে আসছে। মায়ের কণ্ঠে গ্রামের গল্পগুলো শোনা, কৃষ্ণচূড়ার নিচে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা, এবং তার শৈশবের সেই সাদামাটা দিনগুলো।

অভ্রের চোখে তখন জল, মনে হলো এই গ্রাম, এই মানুষগুলো, তার জীবনের আসল অংশ। সে এইসব ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। যে জীবন তাকে সবসময় সুরক্ষিত রেখেছে, ভালোবাসা দিয়েছে, সেই জীবনটা ভুলে সে কেবল অর্থ আর সাফল্যের পিছনে ছুটেছে।

এর মধ্যে গ্রামের এক বৃদ্ধ লোক অভ্রকে দেখে কাছে এসে বলে, “অভ্র বাবা, তুমি এখানে বসে আছো? তুমি তো সেই ছোট্ট অভ্র! অনেকদিন পর তো এলে।” অভ্র হাসিমুখে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, কাকু। অনেকদিন পর ফিরে এলাম। মনে হলো, গ্রামটা আমাকে ডাকছে।”

বৃদ্ধ লোকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তোমার মা কতবার বলেছে, তুমি যদি একবার আসো! মা তো জীবনটা তোমার জন্যই কাটিয়েছে। আমরা সবাই জানি, কত কষ্টে তোমাকে বড় করেছে। তুমি আজ অনেক বড় হয়ে গেছো। কিন্তু মনে রেখো, এই গ্রাম, এই মানুষ, এই স্মৃতি সবসময় তোমার সাথেই ছিল।”

অভ্র বুঝতে পারে, তার জীবনের সব চাওয়া-পাওয়ার পিছনে মায়ের সেই নির্লোভ ভালোবাসাই ছিল। সে জানতো, মা কখনো কিছু চায়নি, শুধু চেয়েছিল তার সুখ আর শান্তি।

রাতে ঘরে ফিরে এসে অভ্র স্থির করে, সে আর ঢাকায় ফিরে যাবে না। সে এখানেই থেকে যাবে। গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করবে। সেই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো, যা মায়ের সাথে কাটিয়েছে, সেই সবকিছুর মধ্যে সে খুঁজে পাবে জীবনের মানে।