পোস্টস

চিন্তা

সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী ও জামায়াত

১ নভেম্বর ২০২৪

ফারদিন ফেরদৌস

পাকিস্তানি রাজনীতি নয় কেবল ভারতবর্ষের জনপরিসরে মাওলানা মওদূদীর ফিলোসফির প্রভাব ব্যাপক এবং দীর্ঘস্থায়ী। ইসলামিজমের র‌্যাডিক্যাল অংশ ব্যাপকভাবে হার্ড লাইনার মওদূদী ন্যারেটিভ মেনে চলে। 
বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেল কলেজ ও দেশের অপরাপর উচ্চতর বিদ্যাপীঠগুলোর প্রেক্ষিত বিবেচনায় আমরা দেখি, সমাজের সবচেয়ে মেধাবী অংশ জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত। এবং এই মেধাবী অংশটিই আসলে বাংলাদেশের প্রশাসনযন্ত্রের চালিকাশক্তি। বাংলাদেশে ২০২৪ বিপ্লবে সেক্যুলার আওয়ামী লীগের পতনের পর মওদূদী অনুসারীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ভারতবর্ষে জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে ওয়াবিজম, সৌদি আরব এবং মার্কিনীদের সম্পর্কের দারুণ রসায়ন সর্বজনবিদিত।

বাংলাদেশে অনেক ধর্মগুরুই অবশ্য মওদূদী দর্শনকে ভ্রান্ত আকিদা বলে নানামুখী বাহাস করে। বিশেষকরে পীরপন্থীদের সাথে জামায়াত ঘরাণা একেবারেই মেলে না। সাম্প্রতিক সময়ে বিমভাজনের এমনতর আলোচনা আবার উঠেছে। যদিও জুলাই বিপ্লবের পর জামায়াতের আমির সজ্জন ডা. শফিকুর রহমান দলমত নির্বিশেষে ওলামা-মাশায়েখদের সম্মিলনীর ডাক দিয়েছিলেন সেটি যে হয়ে ওঠেনি এর প্রমাণ মেলে হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের আমির আল্লামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর সাম্প্রতিক বক্তব্যে। গেল ২৬ অক্টোবরে তিনি ফেনীতে আয়োজিত রিসালাত সম্মেলনে পূর্বসূরী আলেম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী(রহ.) এর উদ্ধৃতি অনুসারে বলেন, 'জামায়াতে ইসলাম সকল ভ্রান্ত ফেরকাসমূহের মধ্যে নিকৃষ্ট দল'! ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে হেফাজতের শক্তিমত্তা ও জনসমর্থন কেমন সেটা শাপলা চত্বর ট্রাজেডি থেকে বুঝে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ।

বড় বিস্ময়কর সত্য হলো বাংলাদেশে সেক্যুলার রাজনীতির পুরোধা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও রাজনৈতিক আন্দোলনে খোদ আবুল আ'লা মওদূদীর সাথে বহুবার এক টেবিল শেয়ার করতে দেখা গেছে। পরবর্তীতে অবশ্য রাজনৈতিক বৈরিতায় বাংলাদেশ আন্দোলনে মওদূদী ও তাঁর ভাবশিষ্যদেরকে বঙ্গবন্ধু সাথে পাননি। এর মৌল কারণ পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হোক এটা জামায়াত চায়নি। মাওলানা মওদূদী প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী হিন্দের কালানুক্রমিক শাখা অধ্যাপক গোলাম আজমের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। সেটি ভিন্ন পরিসরের আলাপ। আমার কৌতুহলের উদ্দীষ্ট একাত্তর নয়, জামায়াত।

জুলাই বিপ্লবে গেল ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার মারাত্মকভাবে ধরাশায়ী হয়েছে। তাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ লজ্জাজনকভাবে রীতিমতো দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এখন ধীরে ধীরে প্রমাণ হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে কার্যত জামায়াত-শিবিরের কাছে আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়েছে। ওই কৌশলের অংশ হিসেবে গেল দশক ধরে অনেক শিবির সদস্যকে ছাত্রলীগের ছদ্মাবরণে রাজনীতি করতে হয়েছে এবং বেশিসংখ্যক শিবির সদস্যই গণ-আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন। এর পেছনে বড় কোনো চক্র বা শক্তি আছে কিনা সেটি বের করতে পারে জাঁদরেল অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা।

সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই গেল ১৫ বছর প্রায় নিষিদ্ধ থাকা জামায়াতের আমার ড. শফিকুর রহমানের কথকতা শুনছি। তাঁর কথাবার্তায় আমরা প্রতিহিংসা বা ঘৃণার রাজনীতি দেখিনি। এমনকি তারা যে দলগত ও ব্যক্তি পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কাছে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, সেই ব্যাপারটিও ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণা দেন। এবং নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশনা দেন তারা যেন আওয়ামী লীগের মতো আধিপত্যবাদ চর্চা বা লালন না করে। মূলত এই ব্যাপারটিই তাদের প্রতি আগ্রহান্বিত করেছে। তাহলে জামায়াত কি মানবতাবাদী আধুনিক বিশ্বসভ্যতার সাথে নিজেদেরকে তাল মেলানো বা খাপ খাইয়ে চলতে চাইছে?

আবুল আ'লা মওদূদীর ফিলোসফির সাথে পরিচয় আছে অনেকদিন ধরে। বিজ্ঞান, সাহিত্য, রাজনীতি ও ধর্মদর্শনের প্রতি আগ্রহ থেকেই পারতপক্ষে সবার মতাদর্শ সম্পর্কেই আমার জানার আগ্রহ। মওদূদী দর্শন এর বাইরে নয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ করতে চাইলে অবধারিতভাবেই মওদূদী তত্ত্ব পাঠও অবারিত রাখতে হবে।

সাধারণ আলেমরা যেখানে ধর্মীয় রিচুয়াল পালনকে আল্লাহ্কে পাওয়ার মকসুদ হিসেবে বর্ণনা করেন সেখানে মওদূদী বলেন ধর্মকর্মের মূল মকসুদ হলো ইসলামী হুকুমত কায়েম করা। মওদূদীবাদে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের অনুষঙ্গ হিসেবে বর্ণনা‌ করা হয়েছে। যারা জামায়াত-শিবির করেন না, তারা মওদূদীর এহেন মতাদর্শকে ভয় পান কেন?

মওদূদী রচিত তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ তাফহিমুল কুরআনের একটি অভিভাষণ আমরা কোট করতে পারি। মিস্টার মওদূদী বলেছেন, 'অবিশ্বাসীদের আল্লাহর পৃথিবীর কোন অংশে ক্ষমতা দখল করার বা তাদের নিজস্ব ভ্রান্ত মতবাদ অনুসারে মানুষের সামষ্টিক বিষয়গুলি পরিচালনা করার অধিকার নেই। কেননা তাদের যদি এমন সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে দুর্নীতি ও ফ্যাসাদ ঘটবে। এমতাবস্থায় ঈমানদারদের দায়িত্ব হবে তাদেরকে রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা এবং ইসলামী জীবন বিধানের আনুগত্যে জীবন যাপন করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা।' (মওদূদী, III, ২০২. সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদুদী, কুরআন বোঝার দিকে (তাফহিমুল কুরআন), ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৯৯৫)।

বিংশ শতাব্দীর এই সময় জনাব মওদূদীর এই বয়ানকে মান্যতা দিতে গেলে কারো সাথে কারোরই সম্পর্ক টিকবে না। সহনশীলতা ও উদারনৈতিক আন্তধর্মীয় সম্পর্কও ভেঙে পড়বে। এখনো বিশ্বে অমুসলিমরাই বহুগুণে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এমন বাস্তবতায় ভিন্নধর্মীদেরকে তাদের মতাদর্শ পরিচালনায় বাধা দেয়ার কথা কল্পনা করা মানেও যুদ্ধাবস্থা কোনোদিনই কাটবে না।

ইসলামিজমে নিজের নফসের বিরুদ্ধে জিহাদকে বড় যুদ্ধ বলা হয়েছে। কিন্তু জনাব মওদূদীর বয়ান হলো 'ইসলামী হুকুমত কায়েমের উদ্দেশে ইসলামিক বিপ্লব পরিচালিত করতে হবে।' এইখানেই অপেক্ষাকৃত লিবারেল ধর্মগুরুদের সাথে মওদূদীবাদের প্রধান মতপার্থক্য।

আমরা ৩ আগস্ট ২০২২ তারিখের বিবিসি বাংলার একটি খবরে নজরে দিতে পারি:
"ইসলামিক বিশ্বের সুপরিচিত দু'জন দার্শনিক, পাকিস্তানের আবুল আ'লা মওদূদী ও মিশরের সাইয়িদ কুতবের যাবতীয় শিক্ষা তাদের সিলেবাস থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি বা এএমইউ।

ভারতের বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে যৌথভাবে খোলা চিঠি লিখে দাবি জানায় যে, ভারতের বেশ কয়েকটি প্রথম সারির পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে 'ইসলামিক স্টাডিজে'র নামে কার্যত জিহাদি কার্যক্রমের পাঠ দেওয়া হচ্ছে - এগুলো অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এরপরই আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি তাদের পাঠক্রম সংশোধন করার কথা জানায়।

প্রধানমন্ত্রী মোদীকে লেখা ওই চিঠিতে মোট ২২জন শিক্ষাবিদ অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন নির্দিষ্টভাবে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি - আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ও জামিয়া হামদর্দ।
চিঠিটি লেখার মূল উদ্যোগ নিয়েছিলেন যিনি, সেই 'মানুষী' ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও অধ্যাপিকা মধু পূর্ণিমা কিশওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন - মাওলানা মওদূদীর লেখা পড়ে ও তার প্রচন্ড প্রভাবের কথা জেনেই তিনি ওই চিঠিটি লেখার উদ্যোগ নেন।
তাঁর কথায়, 'এখানে তিনটি আপত্তিকর বিষয় রয়েছে। এক, মওদূদী সব বিধর্মী বা কাফেরের গণহত্যার ডাক দিয়েছেন - যা ভারতের মতো একটি হিন্দুপ্রধান দেশে কিছুতেই মানা যায় না।'

দ্বিতীয়ত, তিনি মুসলিমদের বলছেন কোনও রাষ্ট্র বা নেশন স্টেটের আইন না-মেনে শুধু শরিয়াকে অনুসরণ করতে - এটাও দেশের সংবিধানবিরোধিতার সামিল।"

তিন নম্বর, ভারতে লস্কর-ই-তৈয়বা, হুরিয়ত বা পিএফআই, এবং ভারতের বাইরে মুসলিম ব্রাদারহুডের এর মতো বহু জিহাদি ভাবধারার গোষ্ঠী মওদূদীর দ্বারা অনুপ্রাণিত। এমন কী, ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠার সময় আল-বাগদাদী পর্যন্ত মওদূদীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন।"

তবে আলিগড়েই ধর্মশিক্ষা বা থিওলজির ছাত্র এবং চার দশক ধরে জামিয়া মিলিয়াতে ইসলামিক স্টাডিজ পড়ানো প্রবীণ অধ্যাপক আখতারুল ওয়াসি বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, "তার পুরনো প্রতিষ্ঠানের এই সিদ্ধান্তে তিনি অত্যন্ত হতাশ। বিশ্ববিদ্যালয় হল মুক্তচিন্তার কেন্দ্র, যেখানে কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ তা নিয়ে নিরন্তর তর্কবিতর্ক হবে।"

আখতারুল ওয়াসি আরও জানান, "ব্যক্তিগতভাবে তিনি মওদূদী বা সাইয়িদ কুতবের বহু বক্তব্যের সঙ্গেই একমত নন, কিন্তু আলিগড় বা জামিয়ার সঙ্গে বহু বছর যুক্ত থাকার সুবাদে দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারেন ওখানে কিন্তু তাদের বক্তব্যের 'ক্রিটিকাল অ্যানালিসিস'ই পড়ানো হয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, মওদূদী বা কুতব তো কোরান-হাদিস নন, তাদের সব কথা মানতে হবে এমনও কোনও বাধ্যবাধকতা নেই"।

১৯০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ভারতের হায়দ্রাবাদ (বর্তমানে মহারাষ্ট্র) রাজ্যের আওরঙ্গাবাদে আবুল আ'লা মওদূদী জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২০ সালে তাঁর পিতা আহমদ হাসানের মৃত্যুর পর তিনি ভুপাল হতে দিল্লি চলে যান। জীবিকার প্রয়োজনে পড়াশোনায় বিরতি দিয়ে অল্প বয়সেই সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি পুনরায় জ্ঞানার্জনে মনোযোগ দেন আবুল আ’লা। এসময় তিনি সমাজবিজ্ঞান, পশ্চিমা দর্শন এবং ইতিহাস অধ্যয়ন করার জন্য ইংরেজি ও জার্মান ভাষা শিখেন। কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি না হলেও খ্যাতনামা আলেমদের কাছ থেকে ইলম হাসিল করেন এবং আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেন।

অল্প বয়স থেকে শুরু করে মদিনা, তাজ, মুসলিম, আল-জমিয়ত, তরজমানুল কুরআন নামীয় পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করবার সুযোগ পান তিনি।

মওদূদীর পিতা সাইয়্যেদ আহমদ হাসান পেশায় ছিলেন আইনজীবী। বংশীয় দিক দিয়ে সাইয়্যিদুনা হুসাইন শহীদের ৩৬তম উত্তর পুরুষ। তাঁর ২৩তম পূর্বপুরুষ খাজা কুতুব উদ্দীন মওদূদ চিশতি (মৃ. ৫২৭ হিজরি) ভারতে চিশতিয়া তরিকার আদি পীর হিসেবে পরিচিত। তাঁর নামানুসারেই এ বংশের লোকজন ‘মওদূদী’ নামে পরিচিত। মওদূদী খান্দানের কয়েক প্রজন্ম বংশ পরম্পরায় দাওয়াত-তাবলীগ ও পীর-মুরশিদির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। সাইয়্যেদ মওদূদীর মাতার নাম রুকাইয়া বেগম। মায়ের দিক দিয়ে তিনি তুর্কি বংশোদ্ভূত।

১৯৩৭ সালের ১৫ই মার্চ দিল্লির এক শরিফ পরিবারের সাইয়্যিদ নাসির উদ্দিন শামসির কন্যা মাহমুদা বেগমের সাথে মওদূদী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সেসময় দিল্লির ধনী পরিবারগুলোর বিয়েতে লক্ষাধিক টাকার মোহরানা ধার্য করা হতো, কিন্তু তা পরিশোধ করা হতো না। মওদূদী এ অনৈসলামিক রীতি প্রত্যাখ্যান করেন। মাত্র দুই হাজার টাকা মোহরানায় নিতান্ত অনাড়ম্বরভাবে তাঁর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এবং তিনি সংসার যাত্রার শুরুতেই সেই মোহরানা পরিশোধ করেন। এখনো মাওলান মওদূদীর ভাবশিষ্যরা ওই রীতিটি অনুসরণ করে চলেন।

ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা, সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং, ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন, ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ, ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্দ্ব, ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা, পর্দা, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুসলমান প্রভৃতি বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন মওদূদী। তাঁর জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ কাজ হচ্ছে তাফসীরে তাফহিমুল কুরআন (Toward understanding the Qur'an).

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা ও শিয়া ইসলামের পণ্ডিত আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ্ খোমেনী ১৯৬৩ সালে মাওলানা মওদূদীর সাথে সাক্ষাত করেন, পরবর্তীতে ইমাম খোমেনী মওদূদীর বইগুলো ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন। সুন্নি মুসলিমদের শিয়াদের শাস্ত্রগত ও মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব থাকলেও মাওলানা মওদূদীর সাথে শিয়াদের বিভেদ-বিভাজন সহনশীল ছিল।

১৯৪১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের লাহোরে 'জামায়াতে ইসলামী হিন্দ' নামে একটি ইসলামী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে এর আমির হন মওদূদী। ১৯৫৩ সালে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা সংক্রান্ত আন্দোলনে ব্যাপক প্রাণহানির দায়ে তৎকালীন সামরিক আদালত তাঁর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। যদিও ওই দণ্ড কার্যকর করতে পারেনি সামরিক সরকার।

১৯৭৯ সালে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান মওদূদী। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। পরে লাহোরের ইছরায় সমাধিস্থ হন তিনি।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো মাওলানা মওদূদীর পূর্বপুরুষ চিশতিয়া তরিকার পীর হলেও 'পীরবাদী' দর্শনের ঘোর বিরোধী জামায়াতের অনুসারীরা। সোফিজমকে কোনো ছাড় বা মান্যতা দেন না তারা। কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার আন্দোলন করে মওদূদীর জীবন বিপন্ন হয়ে গিয়েছিল প্রায়, সেই মওদূদীর আকিদাকে কাদিয়ানিদের চেয়েও নিম্নতর বলে আখ্যা দিচ্ছেন বাংলাদেশের হেজাজতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ।

মাওলানা মওদূদীর রাষ্ট্রচিন্তা একটি পর্যালোচনা গ্রন্থের ভূমিকায় ‌গবেষক আলতাফ পারভেজ লিখেছেন, 'ইসলামি পুনরুজ্জীবনবাদ বলতে সাধারণভাবে বোঝানো হচ্ছে যাঁরা এরকম উপলব্ধির কথা বলছেন যে- ইসলামের চলতি ধারার চর্চার কারণে এর অনুসারীরা বিশ্বজুড়ে পিছিয়ে পড়ছে। এ অবস্থা বদলাতে মুসলমানদের ধর্মীয় বিধি-বিধানের সঠিক প্রতিপালনের মাধ্যমে পুনরায় 'সঠিক পথে' আসতে হবে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার (১২৬৩-১৩২৮) চিন্তার প্রভাব দেখা যায় মাওলানা মওদূদীর আলোচনায়। তাইমিয়াও মনে করতেন ধর্মচর্চার জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা লাগবে; রাষ্ট্র ও ধর্মের মাঝে একটা অনিবার্য সম্পর্ক আছে; তাদের পরস্পরকে দরকার। (Roy Jackson, Mawlana Mawdudi and Political Islam, Routhledge, 2011, p.96). মওদূদীর

পুনরুজ্জীবনবাদ অবশ্য অন্ধ 'ঐতিহ্যবাদ' নয়। তবে ভিন্ন এক বিশ্লেষণে তাঁকে 'পুনরুজ্জীবনবাদী' বলা কিছুটা ভিন্নমতও তৈরি করে। বিশেষ করে ইসলামি রাষ্ট্রের অর্থনীতি হিসেবে তিনি যেসব বিবরণ দেন তা পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এত কাছাকাছি যে তাকে ভিন্ন কোনো 'মডেলে'র পুনরুজ্জীবন বলা সমস্যাপূর্ণ মনে হতে পারে।'

অপরদিকে সম্প্রতি প্রকাশিত জামায়াতে ইসলামী উত্থান বিপর্যয় পুনরুত্থান গ্রন্থে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, 'জামায়াত সম্বন্ধে যে কয়েকটি ধারণা বা বয়ান প্রচলিত আছে, সেগুলো হলো-এ দলটি মৌলবাদী, নারীবিদ্বেষী, উদারনৈতিক চিন্তাভাবনার ঘোর বিরোধী এবং ফ্যাসিস্ট। অবশ্য এ ধরনের তকমা প্রায় সব দলের কপালেই জোটে অল্পবিস্তর।

প্রশ্ন হলো, জামায়াতে ইসলামীকে কীভাবে দেখব, কীভাবে ব্যাখ্যা করব? জামায়াতকে নিয়ে আওয়ামী লীগের একটা ভাষ্য ও প্রচার আছে। বিএনপিরও আছে একটি ভাষ্য। সহজভাবে বলা যায়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের দ্বন্দ্ব বৈরী, বিএনপির সঙ্গে দ্বন্দ্ব অবৈরী। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির বৈরী সম্পর্ক। এই আন্তঃসম্পর্ক বিএনপি ও জামায়াতকে এক মঞ্চে এনেছে, রাজনীতির মাঠে তৈরি হয়েছে নতুন সমীকরণ।
একটি রাজনৈতিক দলকে সেই দলের লোকেরা যে চোখে দেখেন, ভিন্ন বা প্রতিপক্ষ দলের লোকেরা সেভাবে দেখেন না। এখানে রাজনীতি কাজ করে। সেখানে নানান হিসাবনিকাশ। এক দলের লোকেরা নিজ দলকে মনে করেন অভ্রান্ত, অন্যান্য দলকে মনে করেন ভ্রান্ত বা বিভ্রান্ত। সব দলের মধ্যেই এই মনস্তত্ত্ব কাজ করে।'

জামায়াতের সিলসিলা সবার আগে বহন করবার কথা কার? নিশ্চিতই মওদূদীর উত্তরাধিকারদের? কিন্তু তা হয়নি। ভারতীয় সমাজে জামায়াত যতটা প্রভাব বিস্তার করেছে তাঁর পরিবার পুরাই এর বিপরীত।
আবুল আ'লা তাঁর নয় সন্তানের মধ্যে একজনকেও জামায়াত কিংবা এর ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করেননি। মওদূদীর সন্তানরা পড়েছেন পশ্চিমা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায়। মওদূদীপুত্র হায়দার ফারুক বিভিন্ন গণমাধ্যমে  বিষয়টি নিশ্চায়ন করে বলেছেন , 'আমরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েছি। আমাদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনের কোনো সময় জামায়াত অথবা তার ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। যদি আমার বাবা জামায়াতের কোনো সভার আশপাশে আমাদের দেখতেন তখন- 'তোমরা এখানে এসেছ কেন?' বলে তাড়িয়ে দিতেন। তিনি সব সময় আমাদেরকে জামায়াত থেকে দূরে রাখতেন।' এটা হতে পারে সন্তানদেরকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইতেন তিনি।

শুরুতে নাপাক আখ্যা দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করলেও ৪৭-এ দেশটি গঠিত হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেন মওদূদী। কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রসঙ্গে মিস্টার মওদূদী ইতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন না। জিন্নাহ সম্পর্কে তিনি বলতেন, 'যে তার ছয় ফুটের শরীরে ইসলাম কায়েম করতে পারেন না, তিনি কি করে সারা দেশে ইসলাম কায়েম করবেন?'

মানবতাবাদী দর্শন লালন করি বলেই কোনো থিয়োলজিস্ট ও ধর্মগুরুর প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট কিংবা বিরূপ সমালোচনা করা আমার কাজ নয়। এইসময়ের বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আরেকবার মওদূদীবাদের পাঠ নেয়া গেল। মুসলিম ধর্মগুরুদের অন্যতম একটি প্রধান বাতিক হলো প্রত্যেক তাফসিরকারকই নিজের আলোচনাকে সর্বৈব সত্যাধর্মী বলে প্রচার করেন। মানবচরিত্রের জন্য এটা খুব স্বাভাবিক যে, নিজের সন্তান তার নিজের কাছে কখনোই খারাপ হয় না। তবে আমরা যারা বিলিভার তারা মূল শাস্ত্রের অনুগামী থাকাটাকে বাঞ্ছনীয় বলে জ্ঞান করছি। এরপর কারো যদি মওদূদীবাদ, তায়েমিয়া কিংবা হেফাজতি ফিলোসফি ভালো লাগে তিনি সজ্ঞানে তা করতে পারেন। শুধু খেয়াল রাখতে হবে আমার আচার আচরণ, আমার ব্যক্তিগত ধর্মপালন কিংবা রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি যেন অন্যের বিপদ বা কষ্টের কারণ না হয়।

ধর্মের অনুবর্তী থেকে মওদূদীবাদ আসলে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ। অবশ্যই এটি কোনো আলাদা ধর্ম নয়। পরিবর্তিত সমাজবাস্তবতার নিরিখে গুরু আবুল আ'লা যা বলেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারবে উত্তরসূরীরা এমনটা নাও হতে পারে। তাই যদি হতো জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরকে তাদের দলে অঙ্গীভূত করতে পারত না।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে নিজেদের মধ্যে সবচেয়ে গণতন্ত্র চর্চাকারী দল জামায়াত। তারা দলে কোনো পরিবারতন্ত্র কায়েম, আত্মীয়করণ করা ও অর্থের বিনিময়ে পদপদবি বিক্রিতে নেই। কষ্টিপাথরে যাচাই হওয়ার পর তাদের সদস্যপদ পাওয়া যেতে পারে। সংঘবদ্ধ গোছানো দল তারা।

দেশে চরমোনাই, হেফাজতি কিংবা জামায়াত ইসলামী হুকুমত কায়েম হবে কিনা তা ঠিক করবে দেশের জনগণ।আমরা ভাবছি মূলানুগ না থেকেও জামায়াতে ইসলামী সর্বজনে স্থান করে নিতে পারে। ইজমা ও কিয়াস ইজলামিজমে স্বীকৃত পন্থা। অতীত পেছনে ফেলে সবার সেবায় নিয়োজিত থেকে জনতার ভালোবাসা কাড়তে পারে জামায়াত। সেটি যদি হয় তবে বড় ইসলামী দল জামায়াতও বিশ্বসমাজের প্রশংসা পাবে। কোনো মতাদর্শ বাতিল করে দেয়া বা নিষিদ্ধ করে রাখা কাজের কথা নয়, বরং জামায়াতকে মনে না নেয়া যেমন আপনার অধিকার, তেমনি মেনে নেয়াটায় দোষ খোঁজাও বৃথা।

লেখক: সাংবাদিক
০১ নভেম্বর ২০২৪

তথ্যসূত্র:
তাফহিমুল কুরআন -সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী
মাওলানা মওদূদীর রাষ্ট্রচিন্তা একটি পর্যালোচনা -আলতাফ পারভেজ
জামায়াতে ইসলামী উত্থান বিপর্যয় পুনরুত্থান -মহিউদ্দিন আহমদ
The Vanguard of the Islamic Revolution: The Jama'at-i Islami of Pakistan -Seyyed Vali Reza Nasr
দৈনিক ইনকিলাব 
বিবিসি বাংলা
দ্য ডেইলি‌ স্টার