পোস্টস

ভ্রমণ

"রোড টু কাজীসা"

১ নভেম্বর ২০২৪

Abdullah Rony

চৈত্র মাস। মাথার উপর সূর্য গনগন করছে। আজ মনে হয় গরম একটু বেশিই পড়েছে। তীব্র খরতাপ শরীরের সবটুকু জল শুষে নিতে চায়। মাঝে মাঝে একদল সাদা মেঘ ভেসে এসে একটুখানি ছায়া দিয়ে আবার পালিয়ে যায়। সূর্য কখন তার সমস্ত কিরন হারিয়ে নিস্তেজ হবে, কখন সে পশ্চিমাকাশে মিলিয়ে যাবে, সে অপেক্ষায় বসে থাকলে চলবে না। যেতে হবে নানা বাড়ী, কাজীসা, ফরাজী বাড়ী। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার অর্ন্তগত জল্লা ইউনিয়নের একটি বাড়ি। আমাদের খাটিয়ালপাড়া থেকে সোজা পশ্চিম দিকে। আমরা যাকে পশ্চিম কোলা বলি, সেই কোলা ছাড়িয়ে আরো কিছুদূর পশ্চিমে গেলে অনেক বড়সর একটা বিলের মধ‍্যে এক টুকরো দ্বীপের মতো ভেসে রয়েছে আমাদের নানা বাড়ি। খাটিয়ালপাড়া টু কাজীসা। দীর্ঘ দুস্তর পথ। গ্রামীণ মাটির রাস্তা, কিছুটা আবার ইটের সলিং দেয়া। পুরোটা পথ হেটে যেতে হবে। রিক্সা, ভ‍্যান বা অন্য কোন বাহনের ব‍্যবস্থা নাই। পথিমধ‍্যে পাড়ি  দিতে হবে খাল, বিল, নদী, সাকো। কোথাও কোথাও আবার রাস্তা কেটে ধান ক্ষেতে পানি দেবার ব‍্যাবস্থা করা হয়েছে। কাটা অংশে গাছের গুড়ি ফেলা হয়েছে পথচারী পারাপারের জন্য। কি নেই এই পথে! নানান চড়াই উৎড়াই পার হয়ে গন্তব্যস্থল। অলিম্পিকের ট্রায়াথালন জাতীয় একটি ইভেন্ট আরকি!! তবু যেতে হবে। নানা বাড়ি বলে কথা। সাত আট বছর বয়সের এক বালকের অদম্য মনোবলের কাছে হার মানে রোদ, ঝড়, বৃষ্টির পায়তারা। ইংলিশ প‍্যান্ট, হাফ হাতা শার্ট আর হাওয়াই চপ্পল পায়ে চাপিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে নানা বাড়ির উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু। 

ঘর থেকে বের হয়ে কয়েকটি বাড়ি পার হয়ে আকাবাকা মেঠো পথ ধরে কিছুদূর গিয়ে থামতে হলো। সামনে ছোট আকারের একটি খাল পার হতে হবে। চৈত্র মাসের খরার কারণে খাল প্রায় শুকিয়ে গেছে। নালা দিয়ে অল্প অল্প পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বড়জোর হাটু সমান পানি। ভাবতে অবাক লাগে, ভরা বর্ষায় এই শুকনো খালই জোয়ারের পানিতে টইটুম্বুর হয়ে দু'কুল উপচে পড়ে!! তখন খালে গড়া বসিয়ে চাই পেতে মাছ ধরার উৎসব চলে পুরো মৌসুম জুড়ে। দুটি সরু বাঁশ দড়ি দিয়ে বেধে খালের উপর ফেলে রাখা হয়েছে দুই পারের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করার জন্য। যাকে আমরা 'চার' বলি। এগুলোকে বাঁশ না বলে কন্চি বলাই ভাল! পা ফেলতেই মরমর শব্দ। যেন এক্ষুনি ভেঙ্গে পড়বে। ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসলাম। কি মুসিবত! কেমনে যাব ওপাড়ে।  তবে কি নানা বাড়ি যাওয়া হবে না! বড়োরা এসে এক লাফ দুই লাফ দিয়ে চার পেড়িয়ে যাচ্ছে। আহা! কবে বড় হবো! কবে চার পার হতে পারবো!! অবশেষে আল্লাহ্কে স্মরণ করে দুরুদুরু বুকে পা বাড়ালাম। এবং কিভাবে যেন ওপারে পৌঁছে গেলাম। শুরু হলো পূনরায় পথচলা। পথের দুই ধারে ঘন জংলা মতন জায়গার অভাব নেই। নানান ধরনের বুনো লতাগুম্ল আনমনা হয়ে হাওয়ায় দুলছে। লাল, নীল, সাদা হরেক রকম বুনো ফুল ফুটে আছে সেখানে। নাম না জানা সেসব ফুলের মধু খেতে খেতে পথ চলতে ভীষন আনন্দ! ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে দোয়েল, শালিক আর তিতির পাখির দল নাচানাচি করছে। রাস্তার পাশের লজ্জাবতী গাছগুলোয় হাত ছোঁয়াতেই পাতাগুলো লজ্জা পেয়ে ঘোমটা তুলে কোথায় গিয়ে যেন লুকালো। রঙ বেরঙের ঘাসফুলে ছেয়ে আছে পথের দুই পাশ। অগনিত ঘাসফড়িং সেখানে লাফালাফি করছে আপনমনে। একটু দুষ্টুমি মাথায় চাপলো আমার। পেছন থেকে চুপটি মেরে দু আঙ্গুলের চিমটি দিয়ে একটা ঘাসফড়িং ধরে ফেলে সেকি উল্লাস! কিন্তু নিজেকে মুক্ত করার ফড়িংটির আপ্রান চেষ্টা আর আকুল আবেদন আমার হৃদয়ে মায়া জন্মালো। ওকে মুক্ত করে দিলাম। ঘাসফড়িং ঘাসফুলেই সুন্দর!! সবচেয়ে উচুঁ গাছটির মগডালে বসে একটা কোকিল সেই কখন থেকে কুহু কুহু করে কাকে যেন ডেকেই যাচ্ছে। আর তা দেখে নিঃসঙ্গ পেচা ভেংচি কাটছে। কোকিলের গান বোধহয় ওর ভাল লাগছে না! নানা বাড়ি যাবার আনন্দ আর এই নয়নাভিরাম গ্রামীন প্রকৃতির মধ‍্যে পথ চলতে চলতে মনে হচ্ছিলো গলা ছেড়ে গান ধরি,
"আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। শাখে শাখে পাখি ডাকে।
কত শোভা চারিপাশে!"
কিছুটা হেটে সামনের বাকটি পেরুলেই কাজী বাড়ি। তারপর সোজা গিয়ে কাঠের পোল পেড়িয়ে আরিন্দা বাড়ির পাশ ঘেঁষে পশ্চিম দিকে খানিকটা গিয়ে ওটরার নদী পার হতে হবে। হনহন করে পা চালালাম। এদিকটা খুব নিরিবিলি, সুনসান। রাস্তায় খুব একটা লোকজন নেই। ইতিউতি তাকিয়েও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আশপাশের নির্জনতা ভেদ করে শুধু "পিউ কাহা" "পিউ কাহা" পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। গাছের পাতায় পাতায় দক্ষিণা হাওয়ার চঞ্চলতা। চারিদিকের নিঃশ্তব্দতায় ঝরা পাতার উড়ে বেড়ানোর শব্দ কানে অনুরণন তোলে। বাঁশবাগানে ম‍্যারম‍্যার শব্দে একটার সাথে আর একটা বাঁশের ঘষায় ঘষায় যেন ঘুনসুটি চলছে। কেমন গা ছমঁছম করা পরিবেশ। আশেপাশে কোথাও ঘোৎ ঘোৎ শব্দ শুনলাম। ভয়ে শিউরে উঠলাম! গায়ের পশম সব দাঁড়িয়ে গেল। চমকে পিছনে ফিরে দেখি একটি কাল বিড়াল ছুটে পালাচ্ছে। কিসে যেন বিড়ালটিকে তাড়া করছে। সবাই বলে এখানে নাকি জ্বীনের আড্ডাখানা। মাঝেমাঝে তারা দেখা দেয় বালকের বেশে। একজন কাল জ্বীন আর একজন শাদা জ্বীন। দুজনের উচ্চতা ও শরীরের গড়ন একই রকম। তারা হাসি হাসি মুখে বাচ্চাদের ডাকতে থাকে তাদের দেশে নিয়ে যাবার জন্য। ভয়ে, আতঙ্কে বলতে গেলে দৌড়ে চললাম ওটরার দিকে। আমি যাব নানা বাড়ি, জ্বীনেদের বাড়ি নয়!! হাপাতে হাপাতে নদীর কাছে পৌঁছে গেলাম। এবার খেয়া পার হতে হবে। ছোট্ট একটি নৌকায় করে লোকজন নদী পার হচ্ছে। অনেক ভীড়। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে গাদাগাদি করে। এপাশ ওপাশ দুলতে দুলতে নৌকাটি প্রমত্তা নদী পার হচ্ছে।
কবির ভাষায়-"ঠাই নাই ঠাই নাই ছোট সে তরী"।
আমি তখনও সাতার জানি না। নদীতে কুমির আছে কিনা তাও জানি না। খেয়া যদি ডুবে যায়। আতঙ্কিত হয়ে বসে আছি। এদিক সেদিক তাকাচ্ছি। হঠাৎ মনে হল, ইস্ যদি আর একটু আগে আসতাম! রাজমুকুট লঞ্চটি হয়তো দেখতে পেতাম। সফেদ রঙের দোতলা স্টীলবডি লঞ্চটি পু পু সাইরেন বাজিয়ে যখন নদীর বুক চিরে বিশাল ঢেউ তুলে সামনে এগিয়ে যায়; মনে হয় স্বপ্নলোক থেকে এসে কোন মুকুট পরিহিত রাজার স্বপ্নযাত্রা চলছে। আহা! যদি এ স্বপ্নযাত্রায় সঙ্গী হতে পারতাম! যা হোক ভীড় কিছুটা কমলে আল্লাহর নাম নিয়ে খেয়ায় চড়ে বসলাম। খেয়া পারাপারে কোনরুপ টাকা পয়সা খরচের বালাই নেই। খাজনা হিসেবে নির্ধারিত পরিমান ধান দেবার কারণে পুরো বছর খেয়া পারাপার একদম ফ্রি!! এদিকে নৌকার তলদেশ দিয়ে ছোট ছোট ছিদ্রের মাধ্যমে অনবরত পানি ঢুকছে। একটি ছোট পাত্র দিয়ে মাঝির সহকারী পানি সেচে সেচে নৌকাটিকে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করছে। অবশেষে ভালোয় ভালোয় খেয়া পাড় হলাম। এবার অনেকটা পথ হাটতে হবে। আহারে! নানা বাড়ি যদি মিস্রীপাড়ায় রাজীবদের বাড়ি বা নলশ্রীর সুমন ভাইয়াদের বাড়ির কাছাকাছি হতো কতো সহজেই লঞ্চে করে চলে যাওয়া যেত! তাও আমার স্বপ্নের 'রাজমুকুট' লঞ্চে। কেন যে কাজীসা বিলের মধ্যে হতে গেল। শুধু হাটা আর হাটা! মনে বড় আক্ষেপ নিয়ে নদী পার হয়ে সোজা পশ্চিম দিকে হাটা শুরু করলাম। ওটরা বাজার ছাড়িয়ে পশ্চিম দিকে কিছুটা  গেলেই ওয়াবদার বড় রাস্তা। সেখান থেকে উত্তর দিকে খানিকটা পথ পেরুলে চুনপোড়া এলাকা। চুনপোড়া গিয়ে আবার পশ্চিম দিকে বেশ খানিকটা পথ পেরুলে তবেই দেখা মিলবে কাজীসার। বহু কাঙ্খিত ফরাজী বাড়ি। আমার নানা বাড়ি। 

ওটরা বাজার ধরে ওয়াবদা বড় রাস্তা পযর্ন্ত পথটি কিছুটা রহস্যময়। এই ভরা শুস্ক মৌসুমেও পথের কোথাও কোথাও কোনো এক আশ্চর্য কারনে কর্দমক্ত! অনেক কসরত করে পা বাঁচিয়ে চলতে হচ্ছে। পথের পাশেই অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে ঘন জঙ্গল। কিছু জংলি লতা অনেকটা বড় হয়ে রাস্তার উপরে এসে মাথা ছুই ছুই দূরত্বে ঝুকে রয়েছে। হাত বাড়ালেই ধরা যায়। রাস্তার পাশেই জঙ্গলের মধ্যে বেত গাছের বড় একটা ঝার। একটার সাথে আর একটা বেতের লতা পেচিয়ে পেচিয়ে নাছোয়া উপরে উঠে গেছে। লতার খাজে খাজে থোকায় থোকায় ডোরাকাটা ছোট ছোট গোলাকার  অসংখ্য বেতফল ধরেছে। আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন ফলগুলো দেখে লোভ সামলানো দায়! জঙ্গল লাগোয়া একটি পরিত্যক্ত কালি মন্দির কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুনেছি, এখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা তাদের দেবতাদের সন্তুষ্টির জন‍্য অমাবস‍্যার নিকস কালো রাতে জীব বলি দিতেন। মুহূর্তেই ভুতের গল্পের সমস্ত চরিত্রগুলো একের পর এক মনে ভেসে উঠছিল,-মামদো ভুত, পেতনী, ডাইনী, শাকচুন্নীসহ অন‍্যান‍্য স্বনামধন্য ভুত সমূহ! তীব্র ভয় আর আতঙ্কের এক শীতল স্রোত শিরদাড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছিল। নিজেকে ভুতের খোরাক করতে কেইবা চায়! ভয়ে পা আর চলছে না। হঠাৎ চলে আসা কোনো এক ছত্রধর অচেনা পথিকের পেছন পেছন নীরবে অনুসরণ করে ভয় কাটিয়ে সামনে এগুনোর ভরসা পেলাম। মনে হচ্ছিলো, এই পথটুকু পাড়ি দিতেই যেন কয়েক জনম কেটে গেছে!! ওয়াবদায় উঠে ভুতের ভয় অনেকটাই কেটে গেল। সেখানে একটি ছোট দোকান খোলা দেখলাম। দোকানে পলিথিনের ব‍্যাগে ঝুলানো বনরুডি এবং বৈয়মে ভরা বাতাসা আর টোবা দেখে লোভাতুর চোখে তাকালাম। সাথে কোন পয়সা নেই যে অন্তত একটা নাবিস্কো লজেন্স কিনে খাব-বাটারবন, টোবা সে না হয় বাদই দিলাম। যা হোক বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে সোজা পশ্চিম দিকে তাকালাম। সামনে চকমান, মোল্লা বাড়ি। শাহীন দাদাদের বাড়ি। কাজীসা থেকে কিছুটা কাছে। কিন্তু আমি যাব নানাবাড়ি। দেরি না করে তাড়াতাড়ি হেঁটে চুনপোড়া পৌছাঁলাম। মনে হল অর্ধেকটা পথ শেষ করলাম। কিছুটা শান্তি অনুভব করলাম। 
গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ জিরিয়ে নতুন উদ‍্যমে পথ চলা শুরু করলাম।   হঠাৎ ধুতি পরিহিত এবং গলায় পৈইতা পরা এক হিন্দু মহাশয়কে দেখলাম  একটি ডালায় কতগুলো মোয়া সাজিয়ে হাটে বেঁচতে নিয়ে যাচ্ছেন। উকি দিয়ে দেখলাম ডালায় সাজানো আছে জিভে জল আনা অপরূপ মজার 'চিচরা'র মোয়া। মোয়ার আকর্ষনে পা আর সামনে যেতে চাইছিল না! যা হোক, দুই তিনটি হিন্দু বাড়ি পেড়িয়ে অনেকটা পথ এগুলাম। ভর দুপুর। তীব্র রোদ সোজা মাথায় উপর টগবগ করছে। গা থেকে দরদর করে ঘাম বের হচ্ছে। পরনের কাপড়চোপড় সব ভিজে চুপচুপ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে এক পশলা বাতাস এসে গায়ে পরশ বুলিয়ে যায়। তীব্র রোদে বাতাস ও উত্তপ্ত হয়ে আছে। তাতে গরম অনুভূতি আর গা জ্বালা ভাব আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। পা আর চলছে না। হাটতে গিয়ে হঠাৎ উসঠা খেয়ে সেন্ডেলের ফিতা গেছে ছিরে। মেজাজটা কেমন লাগে! প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ছেরা সেন্ডেল বগলদাবা করে এগুচ্ছি। ক্ল‍্যান্ত, অবসন্ন শরীর ভেঙ্গে পড়ছে। না, এই শেষ বার। আর যাব না নানা বাড়ি। কখনো না। এত হাটা যায়। পথের শুরু আছে কোন শেষ নেই। হেমন্ত বাবু এই পথে হাটলে তার গানের ভাষাই হয়তো উল্টে যেত এভাবে-
"এই পথ যদি শেষ হয়, তবে কেমন হত, তুমি বলতো"!!
আমি বলতাম-আসলে ভালই হত। খুবই ভাল হত। আর হাটা যাচ্ছে না। এদিকে ক্ষুধা তৃষ্ণায় প্রান ওষ্ঠাগত। তৃষ্ণা মেটাতে রাস্তার পাশের এক বাড়ির কল চেপে কয়েক আজলা স্বচ্ছ শীতল পানি মুখে দিতেই কলিজা ঠান্ডা হল।  বরফ শীতল পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ক্ল‍্যান্তি অনেকটাই কমলো। বাড়ির পুকুরে দেখলাম দুষ্ট ছেলের দল ডুবাডুবিতে ভীষণ ব‍্যাস্ত। গরমকে তাড়াতে এর চেয়ে ভাল উপায় আর কিইবা হতে পারে!! মন চায় আমিও এই লেন্ডীপেন্ডি বাহিনীর সাথে পুকুরে নাইতে নামি আর এক একটাকে ধরে ধরে পানিতে চুবাই। ওদের আনন্দ ফূর্তি আর মজা করে নাওয়া সহ‍্য করা যাচ্ছে না! আমি যে গরমে মরি! এই রাস্তায় মানুষের চলাচল বেশি। স্বাভাবিক ভাবেই ভয় কিছুটা কম কাজ করছে। রাস্তার পাশে ধানক্ষেতে কৃষকরা কাজ করছে। তাদের পোশাক বলতে শুধু লুঙ্গি, নেংটির মতো করে কাছা দেয়া, অনেকটা জংলীদের ড্রেসের মতো। পশ্চাৎদেশসহ পুরো শরীরই বলতে গেলে অনাবৃত! মনে হচ্ছিলো, তারা ধানক্ষেতে নয়, পশ্চিমা কোনো দেশের সী বীচে জলকেলিতে মত্ত! কেউ কেউ আবার ধামুড়ার দিকে যাচ্ছে। আজ মনে হয় ধামুড়ার হাটবার দিন। অধিকাংশ লোকেরই  চকচকে, তেলতেলে উদোম গা যেন ৫৭০ সাবান দিয়ে ঘষেমেজে গোসল করে বের হয়েছে। তাদের জামা কাধে ঝোলানো। লুঙ্গি পরা, খালি পায়ে হাটছে। কারো কারো কাধে ঝুলছে গামছা। হাতে তিন ব‍‍্যাটারীর টর্চ লাইট। কারো মাথায় সাজিতে নিজেদের ক্ষেতে লাগানো  তাজা তাজা শাক সবজি। হাটে বেঁচে ট‍্যাঁকে যদি কিছু পয়সা কড়ি আসে, ক্ষতি কি। ভাল তেল দেয়া সযত্নে আচরানো চুলগুলো মাথায় লেপ্টে রয়েছে। কারো কারো মাথার তেল কপাল বেয়ে কানের লতি হয়ে গাল গড়িয়ে নীচের দিকে পড়ছে। তেল মনে হয় মাথায় একটু বেশীই দিয়ে ফেলেছে!! কেউ কেউ আবার মুখে এক খিলকি পান দিয়ে জাবর কাটছে আর হাটছে। পানের পিক দুই ঠোটের কিনারা চুইয়ে নীচে পড়তে না পড়তেই আবার সুরুৎ করে মুখের ভিতর টেনে নিচ্ছে। সবার চেহারার মধ্যে কেমন যেন সুখী সুখী ভাব!! কেউ কেউ জিজ্ঞেস করছে, 'ও মনু কোই যাও? বাড়ি কোই?' উত্তরে বলছি, 'নানা বাড়ি। কাজীসা, ফরাজী বাড়ি যামু, মোগো বাড়ি খাইড্ডালপাড়া'। আবার প্রশ্ম, বাফের নাম কি? উত্তর দিই-ইছুব আলী সিকদার। ফরাজী বাড়ি, বিখ্যাত বাড়ি। অনেকেরই চেনা। পরিচয় পেয়ে তারা খুশী হয়। আচমকা প্রচন্ড শব্দ করে মাথার উপর দিয়ে কি যেন উড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ উপরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম একটি সাদা সরলরেখা আকাশের বুক চিড়ে বহুদূর গিয়ে আকাশেই মিলিয়ে গেছে। হয়তো একটা রকেট উড়ে গিয়েছে। আহা!! রকেটটা যদি দেখতে পেতাম! রকেট দেখতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে বারবার সামনে তাকাচ্ছি নানা বাড়ির নিদর্শন উচু উচু রেইনট্রি গাছগুলো চোখে পড়ে কিনা। না কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবুও হাটছি। যেতে তো হবে। থেমে থাকলে চলবে না। 

রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার ভাষায় বলা যায়, "মাইলস্ টু গো বিফোর আই সিলিপ"। 

তাই এতো কষ্টের মাঝেও দমে না গিয়ে হেটে যাচ্ছি আমার প্রিয় নানা বাড়ি, ফরাজী বাড়ির উদ্দেশ্যে । আসলে নানা বাড়ির ভাবসাবই আলাদা। বিশাল বাড়ি। সারি সারি দোতলা টিনের ঘর। বাড়ি ভর্তি নানান কিসিমের লোকজন। তাদের আতিথিয়েতা এবং রসবোধ ছিল অতুলনীয়। দিলদার, টেলিসামাদ মার্কা কমেডিয়ানে ভরপুর ছিল বাড়িটা। বাড়িতে ছিল একাধিক উঠান যা সাইজে অনেকটা মাঠের মতো। জমজমাট ফুটবল বা ক্রিকেট ম‍্যাচ অনুষ্ঠিত হতো সেখানে। অংশ নিত ফরাজী বাড়ির দল বনাম আমাদের মামা ভাইগ্না দল। খেলায় ছিল টানটান উত্তেজনা। ছিল হৈ হুল্লোড় আর অবিরাম ফূর্তি। নানা বাড়ির পরতে পরতে রোমান্স। বেড়ানোর দিনগুলো নানা রঙে রাঙ্গানো শুধুই রঙ্গিন। ডানা মেলে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়ানো আর জীবনকে নবরূপে আবিস্কার করে কাটিয়ে দেয়া এক একটি সোনালী লগন। বাড়িটা বিশাল একটি দ্বীপের মতো। চারপাশে অসীম জলরাশি। যেদিকে চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। দিগন্তজোড়া জলভূবন। লাল, সাদা অগনিত শাপলা ফুল ফুটে আছে সেখানে। এ যেন শাপলা ফুলের রাজ‍্য। ছোট ছোট দ্বীপের মতো এক একটা বাড়ি যেন পানিতে ভেসে আছে। এই জলরাশি, শাপলা, শালুক আর দ্বীপমালা নানা বাড়িকে ঘিরে এক নৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই নানা ভাইয়ের ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে আনারি হাতে বৈঠা বেয়ে এলোমেলো ভাবে বিলের টলটলে স্নিগ্ধ জলে শাপলা রাজ‍্যে ঘোরাঘুরি করা আর হাত দিয়ে নৌকার এক দিকে ঝুকে শাপলা, শালুক কুড়ানোর নির্মল আনন্দ কখনো ভোলার নয়। চলন্ত নৌকায় বিলের ঠান্ডা পানিতে হাত দিয়ে স্পর্শ করে কখনোবা আঙ্গুল পানিতে ডুবিয়ে ধরে রেখে শিহরিত হতাম ক্ষনে ক্ষনে। দক্ষিণা বাতাসের তোড়ে বিলের পানি আন্দোলিত হয়ে যে মৃদু ঢেউ তুলতো, তাতেই হৃদয়ে কাপন ধরে যেত-নৌকা ডুবে যাবে নাতো! মাছ ধরার জন্য বিলের পানিতে কৈয়া জাল সহ নানান ধরনের জাল পাতা থাকত। পানি থেকে জাল তুলতেই দেখা যেত কই মাছ, শিং মাছ, বাইম মাছ সহ আরো অনেক জাতের মাছ জালে ধরা পড়েছে। জালে আটকে থাকা জীবন্ত মাছেদের মোচড়া মুচড়ি দেখতে কি ভালই না লাগতো!! মাছের সাথে সাথে দু একটি সাপ ও আটকা পড়তো জালে। সাপের ভয়ে জালের মাছ ধরতে সাহস পেতাম না। যেখানে যেখানে পানি একটু কমে এসেছে, বৈঠা বেয়ে নৌকা চালানো যায় না; অনেক কষ্ট করে চইর দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে নৌকাটিকে চালাতে হতো। শ‍্যাওলা, কচুরী পানা, ট‍্যাপ পানা, গুড়ি পানা সহ নানান রকমের জলজ ঘাসের আড়ালে হাটু সমান কাদা পানিতে অগনিত বুইচা, চান্দাকাটা আর বুইত্তা মাছের ছড়াছড়ি। পুটি মাছের লাফালাফিই বা কম ছিল কিসে!! বাধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে মেতে উঠে পানিতে নেমে পড়তাম মাছ ধরতে। যখন পানির পরিমাণ খুব বেশী থাকত, নৌকায় চড়ে বিলের গভীরে যেতে ভয় পেতাম তখন পশ্চিম ধারের পুকুরের ঘাটে বা দক্ষিণ ধারে পাঞ্জেগানা মসজিদের পাশের পুকুরে দু হাত দিয়ে করকিনা মাছ আর ছোট থুইররা মাছ ধরে সময় কাটাতাম। মাঝে মাঝে বিলের মধ্যে কচুরীপানার ঢিবিতে হাসের ডিম পাওয়া যেত। হাস গুলো হয়তো নানা বাড়ির মেহমানদের জন্য গোপনে উপহার হিসেবে ডিম গুলো দিয়ে যেত! সেই কুড়িয়ে পাওয়া 'উপহার' পোচ করে খেতে কি স্বাদই না তখন পাওয়া যেত, আহা!! 

নানা ভাইর বিশাল ঘরের মাচায় খোজাখুজি করে পুরোনো কিছু আবিষ্কার করার মজাই ছিল অন‍্যরকম। নাতি নাতনি অন্তপ্রান নানা ভাই ও বড় খুশী হতেন সবাইকে কাছে পেলে। তার গলায় আদরের ডাক আজো প্রতিধ্বনি তোলে মানসপটে। সহজ, সরল আর নিপাট এক ভালমানুষ ছিলেন আমাদের নানা ভাই। তাকে কখনো কেউ রাগতে দেখেনি। আর নানুকে এতগুলো মানুষের লোড দক্ষ হাতে সামলাতে গিয়ে সারাক্ষণ রাগী রাগী চেহারায় হেসেলে ব‍্যাস্ত থাকতে হত। চুলার চার পাশে গোল হয়ে বসে সবাই মিলে নানুর হাতে বানানো চডা পিঠা খেতে ছিল কতইনা আনন্দ! একটি পিঠা খাওয়া শেষ করেই শুরু হয়ে যেত অধীর অপেক্ষা, সবার হাত ঘুরে ঘুরে আবার কখন পাওয়া যাবে পরবর্তী পিঠা। কখনো কখনো ধৈর্য্যচূত হয়ে নানান রকমের ফন্দি ফিকির করে পাশের জনের পিঠায় ভাগ বসাতাম। পুরো ঘর র্ভতি লোকজন। ঢালা বিছানায় ও ঘুমানোর জায়গা পাওয়া দায়। নানা, নানু, মামা, খালাম্মা, একগাদা খালাতো ভাই বোনের সাথে কাটানো অম্ল মধুর সময় চাইলে ও ভোলা যায় না। বাড়িতে কে মা, কে খালা তার কোনো বালাই নাই। কিছু লাগবে, সামনে যাকে পাও, বলে দাও। কাজ হয়ে যাবে। এ যেন এক অদ্ভুত বন্ধন, ভালোবাসাময় স্নেহের সম্পর্ক। এ যেন এক মায়েদের মেলা। শুধু ভালোবাসার বিকিকিনি। এই ভালোবাসার টানই হয়তো অবচেতন মনে সবাইকে টেনে নিয়ে যেত নানা বাড়ি। নানা বাড়িতে পৌঁছে প্রথম কাজই ছিল কখন সেই বিখ্যাত পেয়ারা গাছে উঠব আর পেট ভরে পেয়ারা খাব। নানুর বকুনির তোয়াক্কা না করে পেয়ারা পারার জ‍্ন‍্য রান্নাঘরের মাটির চারার চালার উপর উঠে পড়তাম। নানু হায় হায় করে উঠত, চাল ভেঙ্গে যাবে যে। লম্বা কুইড্ডা দিয়ে সবচেয়ে উচু ডালের পেয়ারা পারার স্মৃতি এখনো সজীব হয়ে আছে। কি অমৃত! সেই কচকচে পেয়ারার স্বাদ! 

আরও ছিল কিছু রোমহর্ষক কিন্তু মজার অভিজ্ঞতা। যেমন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়া। বাড়ির কোন এক কর্নারে ময়লা পানির উপর অসংখ্য ফুটা যুক্ত টিন দিয়ে ঘেরা দুইটি কক্ষ। যাকে বলত "টাট্রি"। নামটি বিদেশী বিদেশী মনে হলেও তার কাজের ধরন ছিল একেবারে সেকেলে! ভীষন পিচ্ছিল একটা গাছের গুড়ির উপর দিয়ে হেঁটে মুল কক্ষে গিয়ে 'কাজ' সারতে হবে। পদে পদে ছিল ময়লার মধ্যে পড়ে যাবার আশংকা। সকাল সকাল সিরিয়াল পড়ে যেত। সিরিয়াল দিয়ে হাতে বদনা হাতে একেকজনের পায়ে পা লাগিয়ে অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে প্রানপন সংগ্রাম এই ছোট হৃদয়ে ভয়ের কাপন ধরিয়ে দিত। মনে মনে বলতাম, আমি পারব তো, ধৈর্যের এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে। একেত নির্ঝঞ্চাট প্রবেশ আবার সময়মতো সিরিয়াল পাওয়া। ভাবতেই অজানা আতঙ্কে দম বন্ধ হয়ে যেত। না জানি কি কেলেঙ্কারি ঘটে যায়। অনেক সময় সিরিয়াল আসতে না আসতেই বদনার ফুটা দিয়ে পানি সব বেড় হয়ে যেত! কি জ্বালা!! আবার পুকুর ঘাটে যাও বদনায় পানি ভরতে। ফিরে এসে হয়তো দেখতাম সিরিয়াল ব্রেক করে পিছনের জন ইতিমধ্যে টাট্রির ভিতরে! শুরু হত নতুন করে ভীতিকর অপেক্ষা!! মনে হত আল্লাহ্ এই সিস্টেমটা না দিলেই ভাল হত। বা এমন কোন ঔষধ থাকত যা খেলে কিছুদিন ওমুখো আর হতে হবে না। তবে একবার ভিতরে ডুকতে পারলে সময়টা ভালই কাটত। নানান ধরনের মাছের বিচরণ, সাতার কাটা, আর "ভেরী ভেরী স্পেশাল খাবার" নিয়ে মাছেদের কাড়াকাড়ি দেখতে দেখতে কাজ হয়ে যেত। আর যদি পাশের কক্ষে পরিচিত কাউকে পেয়ে যেতাম, দু একটি সুখ দুঃখের কথাও সেরে নিতাম! এই টক, ঝাল, মিষ্টি স্বাদ নিতে নানা বাড়ি ছিল সত্যিই অতুলনীয়। এতসব ভাবতে ভাবতে কখন যে নানা বাড়ির কাছাকাছি  এসে পৌঁছেছি বলতে পারব না। ঐতো বাড়িটি দেখা যাচ্ছে। হুররে!হুররে! এবার নৌকায় করে জলপথ পার হয়ে বাড়িতে ঢুকতে হবে। পেরোতে হবে এই সর্বশেষ "হার্ডল"। এদিকটায় কোন নৌকা নেই যে তাতে চেপে বাড়িতে পৌছাব। যথারীতি মামাদের ডাকা শুরু হলো। মামা আ...আ.... মামা আ...আ.... ওপারে কোন সাড়াশব্দ নেই। মামা মামা চি‍ৎকার দিতে দিতে গলা ব‍্যথা হয়ে গেল। কেউ আসছে না। নৌকা না আসলে বাড়িতে পৌছা যাবে না। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি চলল। এত কষ্টের পরে ধৈর্যর বাধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। বসে থাকতে না পেরে বিলের পান‍িতে নেমে পড়লাম। ভাবলাম কোমর অব্দি পরিমাণ পানি। কিছুটা গিয়েই বুঝতে পারলাম এভাবে যাওয়া যাবে না-ডুবতে হবে। হঠাৎ দেখলাম প্রিয় শামীম মামা নৌকা নিয়ে আসছে। আহ! কি আনন্দ!! কি আনন্দ!! আনন্দে মনটা ভরে গেল। এ আনন্দ, আগামী কয়েকটা দিন স্বপ্নের মতো কাটাতে পারার আনন্দ! এ আনন্দ, শিকড়ের কাছে ফেরার আনন্দ! এ আনন্দ, কাছের মানুষদের সাহচর্য পাবার আনন্দ! তাই, খুশীর জোয়ারে ভেসে ভেসে অবশেষে পৌছলাম প্রিয় নানা বাড়ি। আর সমাপ্তি হলো এবারের মত আমার নানা বাড়ি যাবার অভিযান-"রোড টু কাজীসা"।
"এভাবে প্রত‍্যেকটি নানা বাড়ি যাত্রা ছিল এক একটি ইতিহাস। ফেলে আসা জীবনের সেই মধুর দিনগুলো ক্ষনে ক্ষনে হৃদয়ে নাড়া দেয়, হাহাকার করে ওঠে মন নষ্টালজিয়ায়। জীবনের এই প্রান্তে এসে হারানো সেই দিনগুলোর কথা ভেবে বিশ্ব কবির ভাষায় শুধু এ কথাই বলতে পারি,
'দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না--সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি'......"

 

শাপলা বিল