এটা আপনারা কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন করে আজকে যারা একটি আধিপত্যবাদী সরকারকে পরাজিত করে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে চলে এসেছে, তারাও দেশের সব লোকের কাছে সমান পছন্দের হয়ে উঠবেন? যত গুণপনাই থাকুক, সব মানুষ সবার কাছে সমান পছন্দের হয় না। কাউকে যদি পছন্দ না হয়, আপনি নিজেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মনে করলে ওই অপছন্দের লোকটিকে কী করবেন? টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নামিয়ে এনে প্রাণ সংহার করে ফেলবেন? এটা হয়? বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি দিয়ে কিছু নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করে নিয়েছে। এবং ওই আইনেই প্রথম শর্ত হিসেবে বলে রেখেছে, 'আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না'!
'মবোক্রিসি' কায়েম করে আইন হাতে তুলে নিলে কী হয়? সভ্যতা, সংস্কৃতি, কানুন, সামাজিক চুক্তি, সহনশীলতা, ঔদার্য ও মহানুভবতা বলে কিছু আর থাকে না। রাষ্ট্র অকার্যকর হয়। অমন মবের মুল্লুকের চেয়ে পশুদের জঙ্গলের আইন ঢের ভালো। সেখানে ক্ষুধায় জর্জরিত হয়ে নিতান্ত নিরুপায় না হলে শক্তিশালী কেউ অসহায় প্রাণ বধ করে না। আমরা কি তাহলে পশুরও অধম হতে চাইছি? মানবিকতাকে পাশবিকতার নিচে স্থান দিতে চাইছি? মানুষ হিসেবে তেমনটা করা কি আমাদের ঔচিত্যের মধ্যে পড়ে?
কারো রাজনৈতিক দর্শন পছন্দ নয় বলে একজন নিবিষ্ট থিয়েটারকর্মীকে অপসারণের জন্য কেউ এসে নাটক বন্ধ করে দিবে- এটা কি ঠিক হলো? থিয়েটার প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুত হতে একজন মঞ্চকর্মীকে কয়েকদিন মাস নয় কেবল, বছরব্যাপী কী পরিমাণ শ্রম দিতে হয় কেউ জানেন? নাটকের সংলাপ আত্মস্থ করে মঞ্চের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে এবং নির্দেশকের ডিজাইন অনুসারে একজন শিল্পীকে হলভর্তি প্রাজ্ঞ দর্শকের সামনে উপস্থিত হতে কত ত্যাগ স্বীকার করতে হয় -এটা শিল্পপথের পথিক ছাড়া কারো পক্ষেই ভাবা সম্ভব না। মন চাইল একজন ব্যক্তিকে পছন্দ না, দিলাম ওই থিয়েটার বন্ধ করে! এটা যে চরম সভ্যতাবিরোধী আধিপত্যবাদ এটা মাথায় রাখলাম না। কোনো ব্যক্তিবিশেষ অপরাধী হলে এখনো তার বিচার করতে দেশে আইন আদালত থানা পুলিশ মিলিটারি ম্যাজিস্ট্রেসি আছে। কারো প্রতি কোনো বিষয়ে সংক্ষুব্ধ হলে মামলা ঠুকে দেয়াই আধুনিক সভ্যতার রেওয়াজ। এটাতো প্রাগৈতিহাসিক কাল না যে, লাঠি বল্লম নিয়ে এসে হুমকি ধামকি আর জোরজবরদস্তি দিয়ে মন চাইল যা তা করে ফেললাম।
ব্যক্তিগত দুর্মতির বশবর্তী হয়ে আজ আপনি যেটা জাস্টিফিকেশন দিচ্ছেন কাল ওই জঙ্গলের আইন আপনার ওপরও প্রযুক্ত হবে না এটা বলতে পারেন?
আজকের প্রজন্ম বলতে পারে, নাটক কেন করা লাগবে? আর কিছু নয়, উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, হেনরিক ইবসেন, অস্কার ওয়াইল্ড, আর্থার মিলার বা জর্জ বার্নার্ড শ'র নাম জানতেই নাটকের সাথে পরিচিত হতে হবে।
কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, নৃত্য, সংগীত, চারুকলা এবং হালের চলচ্চিত্রের মতো শিল্পকলা চর্চা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। প্রকৃতি প্রদত্ত এইসব আবেগ অনুভূতির বিরোধিতা চলে না। শিল্পচর্চায় মানসিক উৎকর্ষ সাধিত হয় বলেই মানুষকে শিল্পচর্চায় উদ্বুদ্ধ করলে সমাজ থেকে অনাচার, অবক্ষয়, অমানবিকতা দূর হওয়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রও সমৃদ্ধ হয়। একজন মহত্তম শিল্পী সমাজকে আলোকিত করে। কাজেই সুকুমারবৃত্তি চর্চায় বাধা দিলে মানুষের মন তথা প্রকারন্তরে সমাজেই বিকৃতি বাসা বাঁধে। এর নমুনা কি এইসময় চারিধারে দেখা যাচ্ছে না?
গণমাধ্যম জানাচ্ছে, হুমকির মুখে শিল্পকলা একাডেমিতে বন্ধ হলো নাটকের প্রদর্শনী। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় চলছিল দেশ নাটকের ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকটি। প্রদর্শনী চলাকালে দর্শকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রদর্শনী বন্ধের নির্দেশ দেন একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ। শনিবার (২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালার মঞ্চে এহেন ঘটনা ঘটে।
একাডেমির মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, উত্তেজিত জনতা জাতীয় নাট্যশালার গেট ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। তাদের সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু তারা এ নাটক বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
নাটক বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার পর দর্শক সারি থেকে সৈয়দ জামিল আহমেদকে প্রশ্ন করা হয়, এভাবে কারও কথা বলার অধিকার হরণ করা যায়? জবাবে সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন, আমি তাদের বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছি। এতক্ষণ তাদের সাথে রীতিমতো বাকযুদ্ধ করেছি। যদি তারা আগুন ধরিয়ে দেয়, এই আশঙ্কা থেকে প্রদর্শনী বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দেশ নাটকের প্রদর্শনী বন্ধের দাবিতে বিকেল থেকেই নাট্যশালার মূল ফটকের বাইরে অবস্থান নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের বেশ কয়েজন কর্মী। নাটকের মাঝামাঝি পর্যায়ে শিল্পকলার মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ নাটক বন্ধ করে দিতে বলেন। সে সময় ডিজি জানান বাইরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়।
সমস্যাটা আসলে কোথায়? বলা হচ্ছে, দেশ নাটকের জ্যেষ্ঠ সদস্য এহসানুল আজিজ বাবু গেল জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলনের সময় ফেসবুকে ছাত্র আন্দোলনবিরোধী পোস্ট দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে তারা এ কাজ করেছেন। বর্তমান সরকার বিরোধী প্রচারণাও তার রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। নাটক শুরু হওয়ার সময় ২০ থেকে ২৫ জন আন্দোলনকারী গেটের বাইরে স্লোগান দিচ্ছিলেন, এক দফা এক দাবি এজাজ বাবুকে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। ওই একই দাবিতে তারা একটি ব্যানারও বহন করছিলেন।
এই পরিস্থিতি হট্টগোল তৈরি হলে দর্শকরা মিলনায়তন ছেড়ে বের হয়ে যান। পরে সেনাসদস্যরা এসে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে আনেন।
এ ব্যাপারে নিত্যপুরাণ নাটকের রচয়িতা ও নির্দেশক মাসুম রেজা এই লেখককে বলেন, 'জামিল ভাই তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন নাটকটি যাতে বন্ধ না হয়.. কিন্তু বাইরের কিছু মানুষের এমনই পরিস্থিতি দাঁড়ায় যে জামিল ভাই নিজেও নিরুপায় হয়ে গিয়েছিলেন.. আমাদের পাশে সবাই ছিলেন কামাল বায়েজিদ, শাহ আলম, তপন হাফেজসহ আরো অনেকে.. বিষয়টা দুঃখজনক এ ছাড়া আর কিছুই বলার নেই...!'
চলচ্চিত্রকার শাহজাহান শামীম বলেন, 'বাংলাদেশের মানুষ খুব গণতন্ত্র চায় এবং নিজেকে খুব গণতান্ত্রিক মনে করে কিন্তু ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না। কোন যৌক্তিক আলাপ নিতে পারে না, করতেও পারে না। গালাগালি করতে পারে। বিরোধী দল সহ্য করতে পারে না, বিরোধী দলকে মারা রাজনৈতিক কর্মসূচি মনে করে কিন্তু খুব ভালো করে কড়া লিকারের গণতন্ত্র চায়। এই জন্যই গণতন্ত্র পায় না। বহু দল ছাড়া কি একলা একলা গণতন্ত্র হয়?'
১৯৮৭ সালের জুলাইয়ে প্রতিষ্ঠিত দেশ নাটকের প্রযোজনায় 'নিত্যপুরাণ' নাটকটির প্রথম প্রদর্শনী হয় ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মঞ্চে। পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে অস্ত্রবিদ্যা শেখার জন্য গুরু দ্রোণাচার্যের কাছে যান একলব্য। নীচু জাত বলে তাঁকে শেখাতে চান না দ্রোণাচার্য। যদিও একপর্যায়ে তাঁর কাছে ধনুর্বিদ্যা শেখার সুযোগ পান একলব্য। অথচ আরেক শিষ্য পঞ্চপাণ্ডবের এক পাণ্ডব অর্জুন একলব্যের কাছে পরাজিত হন ধনুর্বিদ্যায়। এর পরিণতিতে গুরু দ্রোণাচার্য একলব্যকে আঙুল কেটে গুরুদক্ষিণা দিতে নির্দেশ দেন। মহাভারতে বর্ণিত নিম্নবর্গের এক বীরযোদ্ধা একলব্য'র করুণ কাহিনিই নাটকের উপজীব্য।
আমাদের কালের মননশীল নাট্যব্যক্তিত্ব মাসুম রেজার 'নিত্যপুরাণ' নাটকটি এই দেশেই সোয়া শ' প্রদর্শনীর রেকর্ড স্পর্শ করেছে। হঠাৎ এখন কেন এই নাটকের প্রদর্শনী বন্ধ করতে হলো -কোনো কার্যকরণ দিয়েই এর ন্যায্যতা প্রতিপাদন করা যায় না। আমরা 'নিত্যপুরাণ' প্রদর্শনী বন্ধের প্রতিবাদ জানাই। অবিলম্বে সবখানে জমে যাওয়া সকল কলুষ দূরীভূত করে নাটকটির স্বাভাবিক প্রবহমানতা নিশ্চিত করবার দাবি রাখি।
শিল্পের ভাষা বন্ধ করে দেয়া কাজের কথা না। মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলা ফেরাতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ফার্স্ট প্রায়োরিটি বেসিসে করতে হবে। 'মব ভায়োলেন্স' সভ্যতার কোনো মাত্রার প্রতীক না যে, শিল্পকলার মহাপরিচালকে তাদের পক্ষ হয়ে থিয়েটার বন্ধ করে দিতে হবে! তিনি প্রারম্ভেই শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে পারতেন।
মানুষ আগে শিল্পের ভাষাকে সমীহ করত, মর্যাদা দিত। এখন ঘটছে পুরোদস্তুর উল্টো ঘটনা। ফ্যা'সিস্টকে ফ্যা'সিস্ট বলা যাবে, মু্ক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা এবং একাত্তরের কোলাবোরেটরকেও অতি অবশ্যই তাই। সব মানুষকে সমানভাবে কথা বলতে দিতে হবে। সবাই সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। তা নাহলে যা ঘটে চলেছে, পৃথিবীর সভ্য সমাজে আমাদের আর জায়গা হবে না। কেমন যেন ব্যক্তিগত পছন্দ আর অপছন্দের নিষেধাজ্ঞায় নাস্তি হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। এমন অসহনশীল আচরণ করলে অচিরেই জাতি হিসেবে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব আমরা।
লেখক: সাংবাদিক
৩ নভেম্বর ২০২৪