পোস্টস

পোস্ট

পকেট ব্যবহার করেন না এমন এমন লোকদের আমি অবশ্য চিনি

১৮ মে ২০২৩

শোয়েব সর্বনাম

মূল লেখক শোয়েব সর্বনাম

বড়লোকের দোকান থেকে জামা কিনতে গিয়ে ধরা খাইছি। জামা আছে, পকেট নাই। বড়লোক হয়ে গেলে মনে হয় পকেট ব্যবহারের কোন দরকার নাই। 

পকেট ব্যবহার করেন না এমন এমন লোকদের আমি অবশ্য চিনি। সৈয়দ আবুল মকসুদ ও ফরহাদ মজহার দামি গাড়িতে চলেন ফিরেন। অথচ তাদের কোন পকেট নাই। লুঙ্গি পরে ঘোরেন। পকেট নাই বলে পকেটমারের চিন্তাও তাদের নাই।   

তবে আমরা ঢাকার লোকেরা  একটা সময় পকেটমারের কথা ভাবতাম। শার্টের সামনে পকেটের উপর ঢাকনা লাগানো থাকতো। ঢাকনার উপর বোতাম। কিন্তু দক্ষ পকেটমারের বিপরীতে সেটাও কোন সেইফটি না। ফলে, আমাদের শার্টের ভিতরের দিকে নিখুঁত সেলাই করে আরো একটা ফলস পকেট থাকতে হবে। বাইরের ঢাকনাওয়ালা বোতাম লাগানো পকেট আসলে খুচরা দুই একটাকা ছাড়া আর কিছুই রাখা যাবে না। কলারের বোতাম খুলে ভিতরের গোপন সেই পকেটের ভিতর হাত ঢুকায়ে নিরাপদে রক্ষিত টাকা পয়সা সব বের করতে হইতো। 

অবশ্য তাতেও রক্ষা পান নাই অনেকে। তখনকার সময় লোকেরা বাসে উঠলেই ঘুমায়ে যেতো এবং সেই সুযোগে পকেটমারেরা শার্টের বুকের দিকে নিখুঁতভাবে কেটে ফেলতো। তখন গুলিস্তানের দিকে রাস্তাঘাটে এইরকম ব্লেডে কাটা শার্ট পরা বিভ্রান্ত অবস্থায় ঘুরতে থাকা লোকেদের মাঝেমধ্যেই দেখা যেতো।  

এখন আর সেই সিস্টেম নাই। পকেটমার ব্যাপারটা তখন শিল্পের পর্যায়ে ছিল। এখন সেটা জবরদস্তি বা ছিনতাই। চোখে মিল্লাত বাম ডলে সবকিছু নিয়ে যাবে এখনকার ছিঁচকারা। 

এইরকম ব্যাপারগুলা বেশিরভাগই ঘটতো লোকাল বাসগুলাতে। একটু রাত হলে দূরে যাওয়া বাসগুলাতে তেমন যাত্রী থাকেনা। ফলে, আট দশজন ছিনতাইকারি এইখানে যাত্রীবেশে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। দু চার জন নিরীহ যাত্রী উঠলেই তারা দ্রুত বাসের সব লাইট নিভায়ে দরজা লাগায়ে দিবে। তারপরে সবকিছু নিয়ে চোখে মিল্লাত বাম ডলে রাস্তার পাশে যাত্রীদের নামায়া দেয়া হয়। 

আমার বন্ধু ডেভিড নব্বই দশকের কবি, রাত দশটার দিকে শাহবাগে আড্ডা দিতে আসেন এবং দুইটার দিকে বাড়িতে ফিরত যান। আমারে দেখতে পেলেই তিনি ডেকে বলেন, শোয়েব, একটা জরুরি আলাপ আছে। পাঁচ মিনিটের ব্যাপার। পাঁচ মিনিটের ব্যপারটা কখনই ১ ঘন্টার আগে সমাধান করা যায় না। 

আমাদের এই ডেভিডের বাসাবাড়ি মিরপুর এলাকায়। ফলে, কয়েকজনের সাথে পাঁচ মিনিটের আড্ডা শেষে গভীর রাতে লোকাল বাসে করে ফিরতে গিয়ে প্রায়শই তার ছিনতাইজনিত অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হতে হয়। বেশিরভাগ ছিনতাইয়ের পর তার চোখে বাম ঘষে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের আশেপাশে কোথাও না কোথাও নামায়ে দেয়া হতো। ছিনতাইকারীদের জন্য ওইটা সেইফ স্পট মনে হয়। ফলে, সেখানে তিনি এক স্থানীয় দোকানদারের লগে বন্ধুত্ব করছেন। বিপদে বন্ধুর পরিচয়। বামডলা খেয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেয়ার দরকারে প্রায়ই তিনি সেই দোকানদার বন্ধুর শরণাপন্ন হন।   

কোন সন্দেহ নাই, ডেভিড রাতবিরাতে বাসে ওঠা বিষয়ে এক বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন। যত রাতই হোক, যে কোন বাসেই তিনি উঠতে রাজি থাকেন না। তো গত পরশু, এইরকম তারে শাহবাগের মোড়ে দাঁড়ায়া থাকতে দেখলাম, তখন প্রায় রাত বারোটা। উনি আমারে পাঁচ মিনিটের একটা জরুরি আলাপের প্রস্তাব দিলেন। ফাইনালি সেই আলাপ দেড় ঘন্টায় গড়ায়।  

আলাপ শেষ হলে আমরা বাসের জন্য দাঁড়াইলাম। একটা মিরপুরগামি বাস আসলো। ডেভিড জানালেন, এইটায় ওঠা ঠিক হবে না। এই বাসে একই বয়সি ৬/৭ জন লোক। এরা নির্ঘাত ছিনতাই করতে আসছে। সেই বাস মাত্র দুইজন যাত্রী নিয়ে চলে গেল, আরেকটু পরে আরেক বাস আসলো। 

এই বাসটা মোটামুটি খালি। দুই একজন যাত্রি। ডেভিড বললো, খেয়াল করে দেখেন, সারাদিনের ট্রিপ শেষে এতরাতে বাসের কন্টাকটারের হাতে একতোড়া টাকা থাকার কথা। এই কন্টাকটারের হাতে টাকা নাই। সমস্যা আছে। এই বাসে ওঠা যাবে না। এইরকম আরো দুই তিনটা বাস যাওয়ার পর সবশেষে রাত আড়াইটার দিকে তার মনমতো একটা বাস পাওয়া গেল। আমি তারে বিদায় জানায়ে নিশ্চিন্তে রিকশায় উঠলাম।   

পরের দিন ফার্স্ট আওয়ারে আননোউন নাম্বার থেকে একটা ফোন আসলো। রিসিভ করে জানা গেল আমাদের ডেভিড! ফোন রিসিভ করতেই আমারে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই শুরু করছেন, আর বইলেন না, বাসটায় যে ঝামেলা ছিল, সেটা আমি বসার পরপর টের পাইছি। ছিনতাইকারীরা আমারে চিনতে পারছে, ফলে এইবার অল্পের উপর দিয়ে গেছে। 

আমি জানতে চাইলাম, মোবাইল? টেকাটুকা? তিনি রিপ্লাই করলেন, ফোনটার কল রিসিভ করার বাটনটা কাজ করতেছে না। ওদের তেমন লাভ হবে না এইটা দিয়ে। বাট এইবার ওরা চোখে অল্প করে বাম লাগাইছে। জাস্ট একটা ডলা দিছে। আমি তো পানির ঝাপটা দিয়াই চোখ পরিস্কার করে ফেলছি। তিনি আরও জানালেন, পাসপোর্ট অফিসের সামনে আমার এক বন্ধু আছে জানেন তো। সে খুব হেল্প করলো। এখন সিমটা তুলতে পারলে রাত্রে আইসা ফোন দিবোনে। শাহবাগে থাইকেন, একটা জরুরি আলাপ আছে।  

তো, আজকে পকেট ছাড়া জামা পরে রাত্রে শাহবাগ যাইতে হবে। জরুরি আলাপ বলে কথা। ততক্ষন আপনারা ডেভিডের একটি কবিতা পড়তে পারেন।

বে-তালে নইড়ে যায়
ভুঁই--আকাশ--পাতালে
 ঘটনামা--
 ততোসব ঘেন্না
--আর মর্দের কাহিনী
তাগো'র পেশীর শব্দ-প্রেম
ঢুক্যা থাক--পেত্যেকের কানে
 ঈমানে ঈমানে--
'জ্যান্ত মানুষজন কও'


#সর্বনাম