শীতের বিকেল। সূর্যটা সবে পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। বাতাসে শীতলতার একটা হিমেল পরশ লেগে আছে। এই সময়েই রাসেলের মনটা একটু অস্থির হয়ে ওঠে। প্রতি শুক্রবারের মত আজকেও সে চলে এসেছে গ্রামের শেষ প্রান্তে, মাজারশরীফে।
মাজারশরীফ গ্রামের ছোট্ট একটা মাজার, তার ঐতিহ্য বহু প্রাচীন। এখানে স্থানীয় এক সাধকের কবর আছে। বলা হয়, এই সাধক খুবই পবিত্র ও পরোপকারী ছিলেন। গ্রামের মানুষদের মাঝে এই মাজার ঘিরে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। কেউ বলে, এখানে মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয়, আবার কেউ বলে মাজারের আশেপাশে একটা মায়াময় পরিবেশ থাকে যা একবার যার উপর পড়ে, সে আর ফিরতে চায় না।
রাসেল ছোটবেলা থেকেই তার দাদার মুখে মাজারশরীফের গল্প শুনেছে। প্রতি শুক্রবারই সে একবার এখানে এসে বসে। মাজারের পাশে একটা ছোট্ট আমগাছ আছে, সেখানেই সে গিয়ে বসে থাকে। তার মনে হয় এই মাজারের সাথে তার অদ্ভুত একটা সম্পর্ক রয়েছে।
আজও রাসেল মাজারের পাশে এসে বসল। আকাশে মৃদু মেঘের আনাগোনা, আর মাজারের চারপাশটা যেন এক আলোকিত সোনালি আভায় ভেসে যাচ্ছে। এক সময় রাসেল মনে মনে কিছু প্রার্থনা করল। হঠাৎই এক বৃদ্ধ এসে তার পাশে বসে পড়লেন। মুখে সাদা দাড়ি, পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর মাথায় সাদা টুপি। বৃদ্ধের মুখে এক অদ্ভুত শান্তির ছাপ।
বৃদ্ধ মৃদু হেসে রাসেলের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, "কেন এখানে বসে আছো বাবা?"
রাসেল মৃদু হাসল, "কিছু না দাদু, এই মাজারটা আমার খুব ভালো লাগে। এখানে এলে মনটা একটু হালকা হয়।"
বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ করে রাসেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মৃদু স্বরে বললেন, "জানো, এই মাজারে যার কবর, তিনি ছিলেন মানুষের মনের কষ্ট দূর করার জন্য। অনেকেই এখানে আসে, কিন্তু সবাই মনের সঠিক প্রার্থনাটা করতে পারে না।"
রাসেল অবাক হয়ে বৃদ্ধের কথা শুনল। "কীভাবে বুঝব দাদু, মনের সঠিক প্রার্থনা কী?"
বৃদ্ধ একটু মুচকি হেসে বললেন, "প্রার্থনা তো সেই, যা হৃদয়ের গভীর থেকে আসে। যখন নিজের খেয়ালের ঊর্ধ্বে গিয়ে নিজের মনকে বিশুদ্ধভাবে খুঁজবে, তখনই প্রার্থনা পূর্ণ হবে।"
রাসেল কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবল। এই বৃদ্ধের কথা যেন তার মনকে কিছুটা আলোড়িত করে তুলেছে।
বৃদ্ধ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন, মৃদু স্বরে বললেন, "কষ্ট মনের জন্য একটা পরীক্ষামাত্র, রাস্তা দেখার জন্য প্রার্থনা করো, মন থেকে। প্রার্থনা আসলেই শোনা হয়।" এরপর ধীরে ধীরে তিনি মাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।
রাসেল মুগ্ধ চোখে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরই মাজারের দিকে তাকাতেই দেখল, সেখানে আর কেউ নেই। বৃদ্ধ যেন কোথাও মিলিয়ে গেছেন।
রাসেল বুঝল, এই মাজার শুধু মনের ইচ্ছা পূরণের স্থান নয়, এটা একজন মানুষের আত্মার সঠিক পথ খুঁজে পাওয়ার স্থান। সে মন থেকে মাজারশরীফের সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে প্রার্থনা করল, যেন তার পথ সে সঠিকভাবে খুঁজে পায়।
গ্রামের মানুষ আজও বলে, মাজারশরীফের সেই বৃদ্ধ আসলে সেই সাধকের আত্মা, যে মাজারের পাশে এসে মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। আর রাসেলও এখন প্রতি শুক্রবার মাজারশরীফে এসে নতুন এক প্রার্থনা নিয়ে যায়।