শেখ হাসিনা সরকারের মারাত্মক ভ্রান্তিসমূহ ৩ নভেম্বরের জেলহত্যার মতো ঘৃণ্য অপরাধও তামাদি করে দিয়েছে। কোথাও কেউ চার নেতার নাম উচ্চারণ করেনি। আমাদের ঠিক বুঝে এল না মৃতের সন্তান বা উত্তরাধিকারদেরকে বনানী কবরস্থানে যেতে দিলে অন্তর্বর্তী সরকারের ঠিক কী কী ক্ষতি হতো? মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতাকে মানুষ স্মরণ করতে পারবে না কেন?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আমার এক বড় আপা বললেন, মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের একটি গেটে নাকি জুতা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
রাষ্ট্র, রাজনীতি ও ক্ষমতা এমন এক জটিল জিনিস যে, আজকে যারা সরকারে থেকে খুব শক্তিমত্তা চর্চা করছেন তাদের শেষ শয়ন কোথায় কীভাবে হবে আমরা তো কেউ জানি না। একজন তাজউদ্দীন আহমদ হয়ে দেখানোর সুযোগ আপনারা নাও পেতে পারেন। সবার কপালে কি দেশ বানিয়ে দেয়ার ভাগ্য জোটে?
জেলহত্যা দিবসকে সামনে রেখে ব্যাপক আলোচিত তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা গ্রন্থের লেখক বঙ্গতাজ কন্যা শারমিন আহমদ প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, 'যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী নিজে হাতে কাপড় কেচে, ধুয়ে শুকিয়ে পরের দিন সেটা পরেছেন। বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রী এটা করেছেন? যুদ্ধের সময়ে তিনি পারিবারিক জীবন যাপন করেননি। কারণ, তিনি বলতেন, আমি সব মুক্তিযোদ্ধার নেতা, তারা তো পরিবারের সঙ্গে নেই।
গেল ৫ আগস্ট পতন হওয়া সরকার প্রসঙ্গে মিজ শারমিন বলেন, সেটা আওয়ামী লীগের শাসন ছিল নাকি হাসিনা লীগের মাফিয়া স্টাইলের শাসন ছিল? প্রকৃতপক্ষে সেটা একটা পরিবার লীগের শাসন ছিল। কারণ, আওয়ামী লীগের কথা আমি যখন চিন্তা করি, তখন মাওলানা ভাসানীর কথা চিন্তা হয়, শামসুল হকের কথা চিন্তা হয়। আমার বাবা তাজউদ্দীনের কথা মনে হয়। এমনকি একাত্তর-পূর্ববর্তী বঙ্গবন্ধুর কথাও চিন্তা হয়। তাঁরা গণমানুষের প্রতিনিধি ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ হাইজ্যাক হয়ে যায় একটা পরিবারের কাছে। একটা পরিবারতন্ত্র হয়ে উঠেছিল, তাঁরা আওয়ামী লীগের ব্যানারটা ব্যবহার করেছিলেন।
সে জন্য আমার কাছে মনে হয়, আওয়ামী লীগের মধ্যে যেসব নেতা–কর্মীর বিবেক এখনো জাগ্রত আছে, তাঁরা যদি সবাই প্রতিবাদী হয়ে হাসিনা লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটা সুস্পষ্ট পার্থক্যরেখা টানতে পারেন, তাহলেই আওয়ামী লীগের একটা রাজনৈতিক সম্ভাবনা থাকবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এত এত দুর্নীতি হয়েছে, এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের থেকেই ডাকটা আসা উচিত। তাঁরা যদি বুদ্ধিমান হন, তাঁরা যদি সত্যিই আওয়ামী লীগকে ভালোবাসেন, তাহলে তাঁদের বলতে হবে যে তাঁদের দলে কোনো ক্রিমিনাল থাকবে না। শেখ হাসিনা ও তাঁর আশপাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সবাই ক্রিমিনাল। তাঁদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এই দাবিকে বাইরের লোক শুধু কেন করবে? বিচারের দাবি কেন আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে আসবে না?
আওয়ামী লীগের কৃতকর্ম প্রসঙ্গে শারমিন আহমদ জানান, অবশ্যই তাদের ক্ষমা চাইতে হবে। কোনো রাজনৈতিক কারণে নয়, অনুশোচনা ও আত্মোপলব্ধিটা সত্যিকারের মন থেকে আসতে হবে। মানুষ যখন দেখবে আচরণে, চিন্তায়, কথাবার্তায় পরিবর্তন এসেছে, তাহলে ধীরে ধীরে তাদের নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থাটা ফিরতে শুরু করবে। কারণ, তারা তো এই সমাজেরই সন্তান। আমি মনে করি, তারা যদি নিজের থেকে এগুলো করে, তাহলে ভবিষ্যতে তারা ভালো করবে।
আমরাও তাই মনে করি।
আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনাকে জাতির কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের হার্ডওয়্যার আর রিসেট হবে না। দেখেন আপনারা সবাই যা ভালো মনে করেন!
লেখক: সাংবাদিক
৩ নভেম্বর ২০২৪