২৬ বছর ধরে নিজে সংগ্রহ করে প্রথম আলো পড়ি। কার্তিকের নবান্ন আর হেমন্ত এইদেশে হাত ধরাধরি করে আসে। এমন একটা সময় ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বরে গালে প্রভাত সূর্যের কোমল আলো ছুঁইয়ে, পায়ে কুয়াশা মেখে, হিম হিম বাতাসে গ্রাম থেকে উপজেলা শহরে গিয়ে পত্রিকা কিনেছিলাম। সেদিন ছিল শুক্রবার। দিন বদলেছে। আজ ভোরে প্রিয় পেপারবাহক এসে দরজায় গুজে দিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র 'আন্দোলনের মুখ'সহ ৪০ পৃষ্ঠার প্রথম আলো। এতদিনের নিরবিচ্ছিন্ন ঘরসংসার। প্রথম আলো আমাদের পরিবারেরই একজন। বড় আপন, বিরাট অভিভাবক।
কেন প্রথম আলো পড়ি? পেপারটির তথ্যের সত্যতায় শতভাগ বিশ্বাস রাখি। ক্ষমতাকে জবাবদিহি করবার একমাত্র প্রতীতি প্রথম আলোরই আছে। এইজন্য সব সরকারের আমলেই প্রথম আলো ক্ষমতাকেন্দ্রিক মানুষদের কাছে ব্রাত্য ও অচ্ছুত হয়ে থাকে। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাপা, জামায়াত, অন্তর্বর্তী কেউ প্রথম আলোর সাথে সই পাতাতে পারে না। ঠিক এইখানটাতেই আমদের মতো আমজনতার মিত্র হয়ে থাকে প্রথম আলো।
প্রথম আলোর ব্রতচারিতা, ওরা সমাজের জন্য কী কী করে, শুদ্ধাচার বিনির্মানে কেমন ভূমিকা রাখে, দেশের সত্যিকারে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে কতটা ধারণ করে, রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা বা পক্ষপাতমুক্ততার প্যারামিটার কী, সার্কুলেশন কতটা, নিজেদের কর্মীদের কতটা আগলে রাখে, বিশ্বের কতসংখ্যক পাঠক রোজ প্রথম আলো পড়ে, তারা সবার চেয়ে এগিয়ে থাকে কেন, অন্যরা প্রথম আলোর ধারেকাছেও কেন আসতে পারে না; এসব অ্যানালাইসিস ও পরিসংখ্যান আজকাল গুগল করলেই জেনে নেয়া যায়।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে সরকারের শীর্ষমহল থেকে শুরু করে, গোয়েন্দা সংস্থা ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ব্যক্তিবিশেষের রোষানলে পড়েও প্রথম আলো দুঃসাহস নিয়েই মুক্ত সাংবাদিকতা করে গেছে। আওয়ামী রেজিমের শেষের দিকে এসে দেশের কোনো গণমাধ্যম যখন ক্ষমতাসীনদের দিকে চোখ তুলে কথা বলবার সাহস করত না, তখনও প্রথম আলো নষ্ট রাজনীতিবিদ, অর্থগৃধ্নু আমলা, দেশ ধ্বংসকারী লুটেরা, দুর্নীতিবাজ, চাটুকার, চামচাদের বিরুদ্ধে অসঙ্কোচ ও অকপটে মসি চালিয়ে গেছে।
কোনো মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নয়। প্রথম আলোও আটেপক্ষে বেখেয়ালে ভুল করে। তবে ভুল স্বীকার করবার মতো ধীশক্তি তার আছে। কারওয়ান বাজারে আলাদা ধরনের তেলের ভাণ্ড রাখা নাই যা দিয়ে সমাজে চটুকারিতার পথ পিচ্ছিল ও মসৃণ করে দেয়া যায়। প্রথম আলোর গায়ে কাঁটা আছে বলেই ওদের কর্মধারা থেকে গোলাপের সৌরভ পাই। ওরা নিজেরা খসখসে বলেই দেশের বন্ধুর পথে সাবলীলভাবে হেঁটে যেতে বেগ পায় না।
তাহলে এমন প্রথম আলোকে
সবার ভালো লাগবে কেন?
২০২৩ সালের মার্চে প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত একজন দিনমজুরের মন্তব্য ‘আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’ সংবলিত ফটোকার্ডে ‘দেশকে অস্থিতিশীল’ করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগের তীর ছুড়ে শেখ হাসিনা সরকার। তাদের অভিযোগ ছিল, ওই এক ফটোকার্ডের মাধ্যমে দেশের সম্মানহানি করা হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ওই খবরের সঙ্গে একটি শিশুর ছবি প্রকাশে অসঙ্গতিকে কেন্দ্র করে পত্রিকাটির সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে গ্রেপ্তারও করা হয়। আমার অনুজ শামস এখনো সেই মামলার জের টানছে।
ঘটনা ওখানেই শেষ হলো না। ১১ এপ্রিল ২০২৩ তারিখ সোমবার বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করলেন, ‘’প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু, প্রথম আলো দেশের মানুষের শত্রু। আমি এটা অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলি যে, এরা এই দেশে কখনোই স্থিতিশীলতা থাকতে দিতে চায় না।‘’
বিবিসি বাংলা এই বিষয়টি অ্যানালাইসিস করে লিখে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের বড় একটি অভিযোগ, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার যে চেষ্টা করা হয়েছিল, তাতে প্রথম আলোসহ কয়েকটি দৈনিকের ভূমিকা রয়েছে।
সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে সেই কথাও বলেছেন, ‘’২০০৭ সালে যখন ইমার্জেন্সি হয়, তখন তারা উৎফুল্ল। দুটি পত্রিকা আদাজল খেয়ে নেমে গেল।‘’
২০০৭ সালের ১১ই জুন প্রথম আলো পত্রিকায় ‘দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে’ শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলেন সম্পাদক মতিউর রহমান।
সেই ক্ষোভ এখনো রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে।
এরপর গণভবন থেকে সংসদ সুযোগ পেলেই প্রথম আলোর বিরুদ্ধে এক হাত নিতেন ওই সময়ের প্রধানমন্ত্রী। এখন অবশ্য আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে প্রতিবাদের রেফারেন্স হিসেবে ওই প্রথম আলোর খবরেরই ছড়াছড়ি। কী বিস্ময়কর আইরনি!
মোটের ওপর এই হলো আওয়ামী রেজিমের সাথে প্রথম আলোর সম্পর্ক। অথচ আমেরিকা ও ফ্রান্সে বসে এক সাংবাদিক ও আরেক অ্যানালিটিক প্রথম আলোকে স্বৈরাচারের দোসর প্রমাণ করতে ঘন্টার পর ঘন্টা ভিডিও বানিয়ে চলেছেন। মওকা পেয়ে তাদের অনুসারীরাও প্রথম আলোর নিবন্ধন বাতিলের দাবি তুলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় পত্রিকা পোড়ানোও হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রথম আলোর সামনে সেনাটহল রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
আমরা এই টোটাল বিষয়কেই অ্যাপ্রিশিয়েট করি। একটা প্রতিষ্ঠানকে সবসময় ভালো বলতে হবে কেন? কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনা যখন মিথ্যাচারে গুলিয়ে যায় তাতে সমালোচক নিজেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যান। আচ্ছা প্রথম আলো বাতিল করে আপনারা কোন মিডিয়া প্রতিষ্ঠা করতে চান? তাদের কার্যাবলী দেখান আমরাও বিবেচনা করি। এখনো বাংলাদেশে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার ছাড়া আর কাউকে হক কথা বলতে দেখি না। সবাই ব্যক্তিগত লাভের কথা চিন্তা করে লঙ্কার রাবণদের অনুবর্তী থেকে গণ বিচ্ছিন্নতা লালন করে। ওরা আপনাদের সুহৃদ হতে পারে, আমাদের মন কাড়তে পারবে না।
প্রথম আলো বিষয়ে সরকারি প্রেসনোটের প্রয়োজনীয়তা এখনো পড়েনি। তবে প্রথম আলো নিয়ে সাম্প্রতিক আলাপের প্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম শফি নিজের সোশ্যাল হ্যান্ডেলে ব্যক্তিগত মত দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন,
'Prothom Alo is my most favourite newspaper. I know it has many critics. On many occasions, its journalism was appalling. But I think Prothom Alo is a force for good in our society. Over the years, it has also emerged as our only newspaper of record. It means many years later when researchers and historians would look at events in Bangladesh over the past two and a half decades their biggest source would be Prothom Alo.
Ittefaq was the largest circulated newspaper in the 1970s and 80s. Janakantha grabbed Ittefaq’s place in much of the 1990s. Since early 2000s, Prothom Alo has been the most influential newspaper. Bangladesh rightists, centre rights and the Islamists have accused Prothom Alo of unfairly treating them for many years. In my reading, since 2018, Prothom Alo has been the most centrist newspaper in the country.
It is tough to dislodge it from its perch —unless you really can bring out a much better newspaper in terms of diversity of contents, resourceful opinions, better and more accurate sourcing and depth in story telling. And that needs millions of dollars. To match Prothom Alo’s journalism, you need sustained efforts, top talents and years of investment. Jugantor, Kalerkantha and Samakal have tried to do that. But they failed miserably.'
আমরা সাংবাদিক শফিকুল আলমের সাথে একমত। আপনারা নিজেদের কর্মকুশলতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে প্রথম আলোকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। একটি স্বীকৃত গণমাধ্যমকে বাতিলের দাবি তুলেন কোন মুখে? তাহলে আপনারা কি Hegemony'র নতুন সংজ্ঞা শেখাতে চান সবাইকে?
জুলাই আন্দোলনে একটা জাত গণমাধ্যমের ভূমিকা পালন করেছে প্রথম আলো। যেসময় 'শেখ হাসিনা কী মনে করবেন' -এই বিবেচনায় একটি ন্যায্য আন্দোলনের সংবাদ গোপন করবার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত ছিল সবাই, সেসময় গণ-আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতা, মুটেমজুর, রিকশাওয়ালা, দোকানদার, পেশাজীবী ও কৃষকের মুখপাত্র ছিল প্রথম আলো। আর এভাবেই প্রথম আলো সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রথম আলো একাত্তর, ১৫ আগস্ট, ৩ নভেম্বর, ৭ নভেম্বর, নব্বইয়ের গণ আন্দোলন, ২১ আগস্ট এবং সর্বশেষ জুলাই বিপ্লবকে আলাদা চোখে না দেখে মানবাধিকারের 'রক্ষাকবচ' হিসেবে সঠিক তথ্য তুলে ধরেছে। এতে কোনো না কোনো পক্ষ সংক্ষুদ্ধ হবেই, তাতে প্রথম আলোর অনুসন্ধানের আলোকিত আয়নায় সামান্য চিড়ও ধরে না। সেখান থেকে ক্রমাগত আলোই বের হয়। যেন খোদ রবিঠাকুর এসে বলে যান
বঁধু, কোন আলো লাগল চোখে! /বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে।
প্রথম আলোর কন্ট্রিবিউশন মনে রাখবে আগামীর ইতিহাস। তথ্য ও উপাত্তে অনাগত সেই ইতিহাস গবেষকের সত্যনিষ্ঠ রেফারেন্স বুক হয়ে উঠবে আজকের প্রথম আলো।
২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রথম আলো স্লোগান দিয়েছে, 'জেগেছে বাংলাদেশ'! আজ তাদের প্রথম পাতায় 'জেগেছে বাংলাদেশ, জয়ী হবে বাংলাদেশ' -শীর্ষক মন্তব্য প্রতিবেদনে সম্পাদক মতিউর রহমান লিখেছেন, "আজকের সকালটা একটা নতুন সকাল, আজকের সূর্য আমাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এক আলোকিত ভবিষ্যতের। গত বছর এই দিনে আমরা বলেছিলাম, 'পথ হারাবে না বাংলাদেশ'। বাংলাদেশ পথ হারায়নি। আমাদের আশা ছিল দেশের মানুষের ওপর, আমাদের চির-অপরাজেয় ছাত্র-তরুণ সমাজের ওপর। তারা জেগে উঠেছে। জেগে উঠেছে বাংলাদেশ। আবার নতুন স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ।"
বাংলাদেশের নবতর শুভযাত্রায় জনপরিসরে প্রভাববিস্তারি পত্রিকা প্রথম আলো বরাবরের মতোই অনন্য সারথি হয়ে উঠবে, পাঠক হিসেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। আজকের শুভ দিনে প্রথম আলোর জন্য রাবীন্দ্রিক নৈবেদ্যটুকু যত্ন করে রেখে দিলাম।
আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও।
আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও॥
যে জন আমার মাঝে জড়িয়ে আছে ঘুমের জালে
আজ এই সকালে ধীরে ধীরে তার কপালে
এই অরুণ আলোর সোনার-কাঠি ছুঁইয়ে দাও।
বিশ্বহৃদয়-হতে-ধাওয়া আলোয়-পাগল প্রভাত হাওয়া,
সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার নুইয়ে দাও॥
লেখক: সাংবাদিক
৪ নভেম্বর ২০২৪