পৃথিবীতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে কিছুই নাই
আসল কথা হইল এই আছি এই নাই।
তিপ্পান্ন বছর আগে দেশের প্রথম সংবিধান এসেছিল বিপুল শক্তিধর পাকিস্তানকে পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ বন্দোবস্তের ভিতর দিয়া।
১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল গণপরিষদের অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে সংবিধানের যে খসড়া প্রণয়ন কমিটি করা হয় ড. কামাল হোসেনের সভাপতিত্বে সেখানে সদস্য ছিল ৩৫ জন। ওই সদস্যরা সবাই সারাদেশ থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন।
সবাই মিলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লিডারশিপে পাওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল স্তম্ভ গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে রেখেছিলেন।
অর্ধশত বছরের অধিককাল পেরিয়ে এসে ওই সংবিধানও বাতিলের খাতায় ফেলতে হচ্ছে।
আর আপনারা মার্কিন প্রফেসর আলী রীয়াজের নেতৃত্বে ৯ সদস্যবিশিষ্ট সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। সেখানে বাকি সদস্যরা হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের ও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইকরামুল হক, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার এম মঈন আলম ফিরোজী, লেখক ফিরোজ আহমেদ, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী মো. মুস্তাইন বিল্লাহ এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হিসেবে আছেন মো. মাহফুজ আলম।
কমিশনের সদস্যরা গেল ২ নভেম্বর সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেনের মতিঝিলের কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতের সময় সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা হয়। বৈঠকে ড. কামাল হোসেন কমিশন সদস্যদের স্বাগত জানান তাদের কথা শুনেন।
তবে ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত একটি সভায় বাহাত্তরের সংবিধান কমিটির প্রধান ড. কামাল হোসেন বলেন, কোনো ব্যক্তির কলমের খোঁচায় সংবিধান বদলাবে না।
ড. হোসেন বলেন, 'কোনো ব্যক্তি কলমের খোঁচা দিয়ে এটাকে (সংবিধান) বদলাতে পারবে না। একজন ব্যক্তি যদি মনে করেন, প্রেসিডেন্টও যদি মনে করেন এটা ভুল হচ্ছে, এটা ওনার উচিত হবে না যে কলমের খোঁচায় এটাকে চেঞ্জ করে দেবেন। জনগণের মতামত ওনাকে রাখতে হবে, নিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, '১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি হিসেবে এই সংবিধান গৃহীত হয়েছিল। এই সংবিধানের ভিত্তি ছিল আমাদের ত্যাগ ও সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা; কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের সংবিধান পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। এই সংবিধান যাতে কোনোভাবেই অত্যাচারের সুযোগ না দেয়, তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক, ন্যায়সংগত ও সাম্যভিত্তিক দেশ গড়ার আহ্বান জানিয়ে কামাল হোসেনের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়—লিঙ্গ, ধর্ম, জাতিসত্তা, রাজনৈতিক বা অন্য যেকোনো পরিচয়ের কারণে বৈষম্য হতে দেওয়া যাবে না। এই লক্ষ্য সামনে রেখে সব সাংবিধানিক সংস্কার আমাদের করতে হবে।'
কামাল হোসেনের কথায় এটা স্পষ্ট যে, শাসকের অত্যাচারের সুযোগ বারিত করতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংবিধান পুনর্বিচনায় তাঁর আপত্তি নেই তবে সেটা হতে হবে সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে। অর্থাৎ সংবিধান সংস্কারের ভিত্তি হতে হবে জনগণের মতামত।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনের হলরুমে '৪ঠা নভেম্বর ১৯৭২ সংবিধান দিবস’ উপলক্ষে ওই আলোচনা সভায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, 'শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল চাকরিতে বৈষম্য দূর করা, সেটা হয়েছে। রাষ্ট্রের সংস্কার করা তাদের (শিক্ষার্থীদের) ম্যান্ডেট ছিল না। এটা সংসদের কাজ। সংবিধান সংশোধন করলে কতকগুলো জটিলতার সৃষ্টি হবে।'
এদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সর্বকণিষ্ঠ সদস্য মাহফুজ আলম সবাইকে ভুলে না যাওয়ার দাবি জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেছেন, সংবিধান বিষয়ে যে প্রশ্নটা সেটা এক দফা ঘোষণার দিনই বাতিল হয়েছে। কারণ, সেখানে বলা হয়েছিল, ‘পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আমরা খারিজ করছি, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চাই।’ নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত মানেই নতুন সংবিধান।
অনেকেই হাসিনার পতন আর রেজিম পরিবর্তন মোক্ষ ধরে বসে আছেন। অথচ, আন্দোলনের মঞ্চ থেকে যে এক দফা দাবিতে অসহযোগ ও লংমার্চের ঘোষণা এসেছিল- তা ছিল, "ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নূতন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত"।
কেমন হলো ব্যাপারটা? মুখে বলছেন নতুন সংবিধানের কথা। আর গঠন করলেন কিনা সংবিধান সংস্কার কমিশন। নতুনকে শূন্য থেকে গঠিত হতে হয়, যাকে বলে আনকোরা। ওই নতুনের আবার সংস্কার কী?
গোড়ায় কোনো গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলছেন না তো? খুব খেয়াল কইরা। বিএনপির মতো অন্যতম বড় দল কিন্তু সংবিধান বাতিল, সংযোজন-বিয়োজন বা পুনর্গঠন; কোনোটাতেই এখনো সায় দেয়নি।
কোটি মানুষের বহুমাত্রিক ত্যাগে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নতুন এক সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্ত পাওয়ার পরও সেই সংবিধান টিকছে না। পক্ষান্তরে পরিবর্তিত রাজনৈতিক বন্দোবস্ত দিয়াই সংবিধানের ভিত নাড়িয়ে ফেলবেন?
আপনাদের সংবিধান কতদিন টিকতে পারে বলে মনে করছেন মিস্টার মাহফুজ আলম? গণমতকে দাম দেন।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকাশিত সামাজিক সম্মতির ভিত্তিতে, সকলের জন্য উপলব্ধ জনপরিসরকে আমলে নেন। সংবিধান সংস্কারের আসল পথ এটাই। ওই যে শুরুতেই বললাম, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে কিছুই নাই। মানুষ বা বিশ্ব প্রকৃতি -এই আছি এই নাই।
লেখক: সাংবাদিক
৪ নভেম্বর ২০২৪