প্রায় অশীতিপর এক বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার ফিরে পেলেন। যথেষ্ট যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ গণমানুষের সমর্থন হারালেন কমলা হ্যারিস। ২০১৬ সালে প্রথমবার ডোনাল্ড ট্রাম্প পঁয়তাল্লিশতম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ছেচল্লিশে পিছু হটলেও সাতচল্লিশে এসে হোয়াইট হাউস আবার রিপাবলিকানদের করে দিলেন।
আমেরিকা ডলার, ডিজিটাল উপনিবেশবাদ, অস্ত্র, যুদ্ধ ও তেল নিয়ে বিশ্বজুড়ে তাদের ছড়ি ঘুরায়। উন্নয়নশীল দেশের জোট BRICS-এর অধীনে থাকা ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরান, মিশর, ইথিওপিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ডলার নির্ভরশীলতা কমানোর উপায় খুঁজলেও এখনো কোনো দিশা পায়নি।
অর্থ,বাণিজ্য ও প্রযুক্তি সেবার মূল ক্ষেত্র এখনো আমেরিকা। কাজেই সেখানকার শাসনভার কার হাতে থাকে এর প্রতি বিশ্ববাসীর নজর থাকে। রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায় ডেমোক্রেটরা ক্ষমতায় থাকলে বিশ্বে যতটা যুদ্ধ পরিস্থিতি বজায় থাকে রিপাবলিকানদের বেলায় তা কিছুটা সহনশীল পর্যায়ে থাকে। এই অর্থে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে বড় কয়েকটি ঘটনা ঘটতে পারে। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে মিত্রতার সুযোগে ইউক্রেন যুদ্ধের ইতিবাচক পরিণতি হতে পারে। অন্যদিকে সৌদি রাজপরিবারের সাথে ট্রাম্পের আলাদা সম্পর্ক থাকার দরুণ ইজরাইল-গাজাতেও যুদ্ধবিরতি হতে পারে। এই দুটি ঘটনা যদি সত্যিই ঘটে পৃথিবীর স্থিতিশীলতা ফিরবে অনেকখানি। ডোনাল্ড ট্রাম্পও বিশ্বশান্তির পক্ষে নতুন ইতিহাসের অংশ হতে পারবেন।
অপরদিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও স্থিতিশীলতা আসতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের যদি বিরাজনীতিকরণের কোনো পরিকল্পনা থাকে সেটি ভণ্ডুল হতে পারে। ডেমোক্রেটদের প্রধানতম প্রবণতা হলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে র্যাডিক্যালিজম ও পলিটিক্যাল ডিভাইডেশন জিইয়ে রেখে ফায়দা লুটা। পক্ষান্তরে ট্রাম্প প্রশাসন ব্যবসা বুদ্ধি গতিশীল করতে চায়। ট্রাম্পের আমলে বাংলাদেশে র্যাডিক্যাল শক্তির উত্থান রহিত হতে পারে। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিন্ঠার মাধ্যমে সমাজের লিবারেল অংশ শক্তিশালী হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্ক কেমন হবে? নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিপীড়ন নিয়ে ডোনাল্ট ট্রাম্প টুইট করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, 'I strongly condemn the barbaric violence against Hindus, Christians, and other minorities who are getting attacked and looted by mobs in Bangladesh, which remains in a total state of chaos.
It would have never happened on my watch. Kamala and Joe have ignored Hindus across the world and in America. They have been a disaster from Israel to Ukraine to our own Southern Border, but we will Make America Strong Again and bring back Peace through Strength!
We will also protect Hindu Americans against the anti-religion agenda of the radical left. We will fight for your freedom. Under my administration, we will also strengthen our great partnership with India and my good friend, Prime Minister Modi.'
তিনি তাঁর টুইটে স্পষ্টভাবে বাংলাদেশের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কথা বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে গুড ফ্রেন্ডের জায়গা নিশ্চিত করেন। জয়লাভের পর ট্রাম্পকেও ‘বন্ধু’ সম্বোধন করে অভিনন্দন জানিয়ে দিয়েছেন মোদি।
ট্রাম্পের টুইটের পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গেল ৫ আগস্টে পরাজিত পক্ষ ট্রাম্পের জয়ের ব্যাপারে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে থাকে। কারণ ওই পক্ষ মোদি প্রশাসনকে তাদের পরীক্ষিত বন্ধু মনে করে। আবার ট্রাম্পেরও ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে অবজার্ভ করবার রেকর্ড আছে।
যদিও মৌনতা অবলম্বনই উপযুক্ত পন্থা ছিল, তবু অযথা ওই টুইটের প্রতিবাদ জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। আচমকা প্রতিবাদ জানানো এবং অপ্রত্যাশিতভাবে ট্রাম্পের জয়লাভে নিশ্চিতই দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কপালে কিঞ্চিত ভাজ পড়েছে।
ট্রাম্প বলেছিলেন, 'আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’
প্রতিউত্তরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, 'বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক্স পোস্ট তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। লবিস্ট নিয়োগ দিয়ে হয়তো এ ধরনের পোস্ট করানো হয়েছে।'
এমনকি আমেরিকায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সিনিয়র সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী। তিনি তাঁর এক্স হ্যান্ডেলের রিপ্লাইতে নেত্র সুইডেনভিত্তিক নিউজের রেফারেন্স উল্লেখ করে বলেন, 'ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্য, তা সংখ্যালঘুরা বিশ্বের যেখানেই হোন কিংবা যে ধর্মেরই। তবে প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে সঠিক তথ্য যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি।'
তাহলে এটা স্পষ্ট হলো যে, বাংলাদেশ সরকার মনে করে এদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প যা বলেছেন, তা সঠিক তথ্যানুগ যাচাইকৃত ছিল না! এখন ট্রাম্প শিবির যদি এসব কথা মনে রেখে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিবেচনায় আনে সেটা বাংলাদেশের নতুন সরকারের জন্য ইতিবাচক কিছু নাও হতে পারে।
২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবার ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়লাভ করেন। ওই সালের ৯ নভেম্বর The HEC Paris Innovation & Entrepreneurship Institute-এ সামাজিক ব্যবসার উপর দুই দিনের সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসাবে শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়কে 'সূর্যগ্রহণ' বলে শিক্ষার্থীদের সামনে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন। সেসময় ওই প্রতিষ্ঠানের ওয়েব পেজে লেখা হয়েছিল, '2006 Nobel Peace Prize winner Muhammad Yunus reacted with emotion to the victory by Donald Trump in the US presidential elections by telling researchers and students at HEC Paris the win was “a solar eclipse…black days, which must not destroy us and suck our spirit!'
এমন এক বাস্তবতায় ট্রাম্প হয়ে উঠবেন ইউনূস সরকারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন এটা কি আমরা বলতে পারি? আওয়ামী লীগ শিবির অতি আনন্দে আগেই যেন সব অ্যানার্জি নিঃশেষ না করে ফেলে এটাও কি বলা যায়? অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এই উপলব্ধিতে এসেছি যে, হারিয়ে ফেলা গদি খুব সহজে কোনো কাঠখড় পোড়ানো ছাড়াই পুনরায় চট করে পশ্চাৎদেশে চলে আসে এমন নজির প্রায় নেইই। আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে দেখি পাওয়ার যার করায়ত্তে থাকে আমেরিকাও হয়ে উঠে তার জিগিরি দোস্ত।
ভোটগ্রহণের ঠিক আগে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রাশিয়া ও তার মিত্র ইরানের প্রতি নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ আনে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখনো ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের অধীনে।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (এফবিআই), জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালকের কার্যালয় (ওডিএনআই) এবং সাইবার ও অবকাঠামো নিরাপত্তা সংস্থা যৌথ বিবৃতিতে দাবি করে, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিতে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে রাশিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠী। ভোট কারচুপির মিথ্যা দাবি তুলে সেসব প্রচার করে বেড়াচ্ছে।
কার্যত এই অভিযোগটি ছিল কমলা হ্যারিসের পিছিয়ে পড়ার ক্ষতের ওপর সামান্য মলমের উপশম। এই অভিযোগ থেকেই ধারণা করা গিয়েছিল হিলারি ক্লিনটনের মতো এবারও নারী প্রার্থী কমলা হ্যারিস ধরাশায়ী হতে যচ্ছেন। মার্কিনিরীরা এখন এতটা মডারেট হয়ে উঠেনি যে, একজন নারীর কাছে বিশ্বের ভার দিয়ে পুরুষেরা স্বস্তিতে থাকবে।
ডোনাল্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ। চার বছর আগে নির্বাচনী ফলাফল না মেনে মিলিটারি ক্যু পর্যন্ত করতে চেয়েছিলেন। চারিত্রিকভাবেও ট্রাম্পের অবস্থান খুব দৃঢ় নয়। আগেরবারের শাসনকালও গ্রেট আমেরিকা গড়তে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারেননি। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রয়েছে।তারপরও জনগণ কেন ট্রাম্পকেই চাইলেন। অনেক ইস্যুর মধ্যে একটি বড় কারণ কমলা হ্যারিস একজন নারী। প্রেসিডেন্ট পদে সে যেই হোক না কেন একজন পুরুষের তুল্যমূল্যে নারীকে মাপতে রাজি নয় মার্কিনিরা। ফলাফল বিপুল ভোটে জিতে গেলেন ট্রাম্প। নির্বাচনে রাশিয়া বা তার মিত্রদের প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে কারো কিছুই এসে যায় না। বলা হয় মার্কিন রাজনীতি বদলালেও পররাষ্ট্রনীতি এক থাকে। এটা সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। জো বাইডেন যাদের সাথে দোস্তি পেতে চলেছেন তাদের সবার সাথেই ট্রাম্পের সুসম্পর্ক হবে এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। ভূরাজনীতি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে এটাই বাস্তবতা।
প্রায় ১০ দিন আগেই আমরা বলেছিলাম, কমলা হ্যারিসের জয়লাভ করা হবে না। আমরা ক্রিশ্চিয়ানিটি ও ইসলামিজমের সিমিলারিটি বুঝি। বাংলাদেশের মানুষ নারী নেতৃত্ব চায় না। মধ্যপ্রাচ্যে তো কল্পনা করাই অসম্ভব। আর আমেরিকা? তারা নারী রাষ্ট্রপ্রধান আরো চায় না। চোখের দেখায় বুঝা যায় খুব আধুনিক, মানবাধিকারের খুব বড় রক্ষক ওরা। সারা পৃথিবীতে নারী ও পুরুষের সমানাধিকারের ছবক দিয়ে বেড়ায়। আদতে মার্কিনিরা আমাদের চেয়েও অধিক গোঁড়া, bigot এবং চরম মিসোজিনিস্ট। ওখানে হিলারি ক্লিন্টনের হয়নি। কমলা হ্যারিসেরও হলো না। আমাদের জীবদ্দশায় দেখব না যে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আড়াই শ' বছরের ইতিহাস ব্রেক করে, আমেরিকা কোনো নারী শাসকের অধীনে গেছে।
নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে অন্তত দুইবার হামলার শিকার হয়েছেন ট্রাম্প। প্রথমবার রক্তাক্ত জখম রেখে কানের কাছ দিয়ে গুলি চলে যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প ফ্লোরিডার পাম বিচ কনভেনশন সেন্টারে ভক্ত ও সমর্থকদের উদ্দেশে বিজয়ী ভাষণে ওই ঘটনা স্মরণ করে বলেন, 'ঈশ্বর একটা কারণে আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। আর ওই কারণ হলো, আমাদের দেশকে রক্ষা ও যুক্তরাষ্ট্রের মহিমা পুনরুদ্ধার করা। এখন আমরা একত্রে ওই লক্ষ্য পূরণ করতে চলেছি।’
যাই হোক ফাইটার মিজ হ্যারিসের জন্য সহমর্মিতা, সমবেদনা ও সান্ত্বনা। মিস্টার ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য শুভ কামনা। আশা করছি ভূরাজনীতি স্থিতিশীল না করতে পারেন, অস্থিতিশীল করতে তাঁর নামটি যেন উচ্চারিত না হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে এখন নতুন পৃথিবীর নাটাই। তিনি চাইলে তাঁর রঙিন ঘুড়িতে সবার আকাশ সুন্দর ও সুশোভন রাখতে পারেন।
লেখক: সাংবাদিক
৬ নভেম্বর ২০২৪