সারাবিশ্বে জাপানীরা অনেক বেশি সুশৃঙ্খল এবং বিনয়ী জাতি হিসেবে পরিচিত! তাদের অপরাধ প্রবণতার হারও কম।
একটি সুশৃঙ্খল এবং বিনয়ী জাতি গঠনের অন্যতম হাতিয়ার শিক্ষা! বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত এবং সুশৃঙ্খল জাতির শিক্ষাব্যবস্থা তাদের সুশৃঙ্খল জাতি হিসেবে গড়ে তুলেছে। একটি সুশৃঙ্খল জাতি হিসেবে জাপানীদের গড়ে তুলতেও, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। জাপানের স্কুলগুলোতে জীবনমুখী শিক্ষা দেয়া হয়। শেখানো হয় সামাজিকতা, ন্যায়-অন্যায়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি। তাদের স্কুল গুলোতে গণিত, ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি জোর দেয়া হয় নৈতিকতা শিক্ষার উপর।
জাপানী শিক্ষাব্যবস্থা পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত। এগুলো হলো কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক স্কুল, জুনিয়র হাই স্কুল, সিনিয়র হাই স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়। ৩ বছর বয়স থেকে জাপানি বাচ্চাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। মোটামুটি ১৮ বছর থেকে ২২ বছরের মধ্যে জাপানিরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে। জাপানিদের জুনিয়র হাইস্কুল পর্যন্ত পড়া বাধ্যতামূলক। ৬ বছর হলে শিশুরা প্রাথমিক স্কুলে যেতে পারে। জাপানে সরকারি এবং বেসরকারি দুই ধরনের প্রাথমিক স্কুল রয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সোমবার থেকে শুক্রবার সপ্তাহে ৫ দিন ক্লাস হয়। দিনে সর্বোচ্চ ৬ টি ক্লাস হয়। প্রতি ক্লাস ৫০ মিনিট করে মাঝে ১০-১৫ মিনিট বিরতি থাকে। স্কুল শুরু হওয়ার আগে স্কুলের সকল শিক্ষক এবং স্টাফরা স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে গুড় মর্নিং বলে অভ্যর্থনা জানান। ধনী গরিব সব শিক্ষার্থীরাই বিদ্যালয়ে আসে পায়ে হেঁটে! গ্রাম, শহর এমনকি টোকিওর মত ব্যস্ত শহরেও বাচ্চারা নিজে নিজে হেঁটে হেঁটে স্কুলে আসে। যা তাদের আত্মনির্ভরশীল এবং সমস্যা সমাধানের যোগ্য করে তুলতে সাহায্য করে।
শিক্ষার্থীরা স্কুলে ঢুকে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। ক্লাস শুরু হওয়ার আগে বাচ্চারা কেউ খেলাধুলা, কেউ বিভিন্ন প্রোগ্রামিং কার্যক্রম, কেউ হ্যান্ড ক্রাফটের কাজ করে। সবাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ক্লাসে আসে। প্রতিটি ক্লাসে ৩০-৩৫ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকে। প্রতিটি ক্লাসে একজন শিক্ষক থাকেন। সংগীত, শিল্পকলা এবং শারীরিক শিক্ষার জন্য থাকেন বিশেষজ্ঞ শিক্ষক।প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গুলোতে জাপানি ভাষা, গণিত, শরীরচর্চা, সংগীত ও শিল্প, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বিজ্ঞান, অংকন বিদ্যা, নৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি সাবজেক্ট পড়ানো হয়।
পাশাপাশি সকালের সমাবেশের সময় নিয়মিত শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন, শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের হাজিরা নেয়ার সময় শিক্ষককে সহযোগিতা করা, বাগানের পরিচর্যা করা, খাবার পরিবেশন করা এবং খাবারের পর পরিষ্কার করা ইত্যাদি শেখানো হয়। প্রতিটি স্কুলে একজন করে ডায়েটেশিয়ান থাকেন। ডায়েটেশিয়ান বাচ্চাদের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরি হিসেব করে ব্যালান্সড ডায়েট তৈরি করেন যা দেখে দক্ষ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাবুর্চিরা খাবার রান্না করেন। খাবারের সময় ছাত্র-ছাত্রীরা সংগীতের তালে তালে বিশেষ ধরনের পোশাক পরে সারিবদ্ধভাবে রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে শ্রেণিভিত্তিকভাবে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেয়।
তখন রান্নাঘরের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিগণ খাবার বুঝিয়ে দেন। খাবার নিয়ে ক্লাসে ফিরে ছাত্র-ছাত্রী নিজেরাই খাবার পরিবেশন করে। খাবার গ্রহণের সময় শিশুদের জানানো হয়, তারা কি খাচ্ছে এবং কেন খাচ্ছে ইত্যাদি। খাবার আগে ও পরে হাত ধোয়ার জন্য প্রতিটি ক্লাসরুমে বেসিন এবং পানির ট্যাপগুলো শিশুদের বয়স বিবেচনার উপর ভিত্তি করে বসানো হয়। ছবির সাহায্যে হাত ধোয়ার গুরুত্ব এবং পদ্ধতি বলে দেয়া থাকে। প্রতিদিন দুপুরের খাবারের পর ছাত্র-ছাত্রীরা নিয়ম মেনে দাঁত ব্রাশ করে। মাঝে মাঝে দাঁতের ডাক্তারগণ এসে শিশুদের চেকআপ করেন।
তাদের শেখানো হয় যিনি খাদ্য রান্না করেছেন তার প্রশংসা কিভাবে করতে হয়। শিশুরা খাবার শুরুর আগে প্রার্থনা শুরু করে এবং খাবার শেষেও। খাবার গ্রহণ শেষ হলে শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার করে আবার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে শ্রেণিকক্ষ পরিস্কারের কাজেে জন্য আলাদা কোনো পরিছন্নতা কর্মী নেই। ছাত্র-ছাত্রীদেরকেই তা করতে হয়। এক্ষেত্রে কে জজের মেয়ে আর কে প্রধানমন্ত্রীর সন্তান সেটা বিবেচনা করা হয় না। ধনী গরিব সব শিক্ষার্থীকেই একই কাজ করতে হয়।
সবগুলো স্কুলে পরিচ্ছন্ন শৌচাগারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। শৌচাগারগুলো ছেলে-মেয়েদের বয়স উপযোগী করে তৈরি। বাথরুমে যেতে যে সব জুতা পরিধান করতে হয় সেগুলো দরজার সামনে পরিপাটিভাবে সাজানো থাকে। হাতে কলমে বিভিন্ন কাজ শেখানোর জন্য ফিল্ড ট্রিপের ব্যবস্থা করা হয়। ফিল্ড ট্রিপে শেখানো হয়; কিভাবে ধান লাগানো হয়, কিভাবে পরিচর্যা করতে হয় ইত্যাদি। জাপানে প্রায়ই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। তাই ক্লাসগুলোতে গুরুত্ব দিয়ে দুর্যোগকালীন কি করণীয় এবং কি বর্জনীয় তা হাতে কলমে শেখানো হয়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করানো হয়। ফুটবল, দৌড়সহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায় বাচ্চারা নিয়মিত অংশগ্রহণ করে।পড়ালেখায় দূর্বল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আলাদা ক্লাসরুমের ব্যবস্থা রয়েছে। কোনো ছাত্র-ছাত্রী লেখাপড়ায় ভালো না করলে তাকে সেই বিশেষ রুমে নিয়ে আলাদাভাবে যত্ন নিয়ে পড়ানো হয়। প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স থাকেন যিনি নিয়মিত শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলো দেখেন।
প্রতিদিন ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের ক্লাব এক্টিভিটিস এ অংশগ্রহণ করে। সেখানে ছবি অংকন, জন্মদিন পালন ইত্যাদি কাজ গুলো করে থাকে।বাচ্চাদের ভ্রাতৃত্ববোধ শেখানোর জন্য একই মাসে জম্ম নেয়া সব বাচ্চার জন্মদিন মাসের নিদিষ্ট দিনে পালন করা হয়। স্কুলগুলোতে কোনো ধরনের হোম ওয়ার্ক দেয়া হয় না। বিদ্যালয়ে তারা আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যে সময় অতিবাহিত করে। স্কুল থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে তাদের প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়।
জাপানিজ শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো হচ্ছে আদর্শের সূতিকাগার। বিদ্যালয়ের প্রতিটি কর্মকাণ্ড সুনাগরিক তৈরির ভিত্তি। একেক জন শিক্ষক সেই ভিত্তির কারিগর। শিক্ষকদের জাপানিরা সমাজের আদর্শতম মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করে। আর প্রতিনিয়ত তাদের অনুসরণ করে অন্যরা।