Posts

গল্প

অভিশপ্ত রাতের খুন

November 7, 2024

Nasiruddin khan

Original Author Nasiruddin khan

46
View

কলকাতা শহরের এক মেঘলা সন্ধ্যা। ১৯৯০-এর দশকের শেষ। চোরাগলি, অন্ধকার, ধূমকেতুর ধোঁয়া, আর পুরোনো কলকাতার ঐতিহাসিক বাড়িগুলি। এই সন্ধ্যায় চারজন বন্ধু, রাজ, অমিত, গৌরব এবং সুজিত, চুপিসারে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। তাদের উদ্দেশ্য খুবই ভয়ংকর – তারা আজ রাতেই শহরের এক পরিচিত ব্যবসায়ীকে খুন করতে চলেছে। কারণটা ছিলো টাকার, আর টাকার লোভ তাদেরকে এতোটাই অন্ধ করেছিল যে এই খুনটাকেই তারা সঠিক বলে মনে করছিল।

এই ব্যবসায়ীর নাম ছিলো জনার্দন শেঠ। জনার্দন ছিলেন এক বিস্তৃত ব্যবসার মালিক। বহু টাকার মালিক। কিন্তু তার চরিত্র আর ব্যক্তিত্ব ছিলো বেশ রহস্যময়। তার কিছু ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী বলে কথিত ছিলো যে, জনার্দন কিছু অভিশপ্ত উপায় ব্যবহার করেই তার ভাগ্য গড়ে তুলেছিলো। শহরের লোকমুখে শোনা যেত, তার সাথে কিছু অশুভ শক্তির যোগসাজশ আছে। কিন্তু রাজ ও তার সঙ্গীরা এ ধরনের গল্প বিশ্বাস করত না। তারা শুধুই টাকা দেখতে পেয়েছিল।

ওরা জনার্দন শেঠের বাসায় পৌঁছে গেল। রাত্রির প্রায় ১টা বাজে। চারদিক নিস্তব্ধ। তারা নিশ্চিত করল যে, কেউ তাদের দেখতে পায়নি। তারা জনার্দনের ঘরে প্রবেশ করল। ঘরটি ছিল অন্ধকারে মোড়ানো, শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়েছিলো। জনার্দনকে ঘুমের মধ্যে পেয়ে তারা তাকে আঘাত করে খুন করল। জনার্দনের মুখে ছিলো অদ্ভুত এক হাসি, যেটি দেখে তাদের শরীরে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল।

খুনের কাজ শেষ করার পর তারা ভাবল, তাদের কাজ শেষ; তারা ফিরে যাবে। কিন্তু ওরা তখনও জানত না যে, এই কাজের জন্যই ওদের জীবনে শুরু হবে এক ভয়ংকর অধ্যায়। জনার্দনের মুখের সেই অদ্ভুত হাসি তাদের মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল।

রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে তারা প্রত্যেকে নিজেদের বাড়ির দিকে পা বাড়াল। প্রথমে গৌরব চলে গেল। পথে অদ্ভুতভাবে মনে হল যেন কেউ তাকে অনুসরণ করছে। সে পেছনে ফিরে তাকাল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। এক সময় সে নিজের বাড়িতে পৌঁছে ঘুমাতে গেল। কিন্তু ঠিক তখনই, একটি বিভীষিকাময় স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। জনার্দনের মুখে সেই অদ্ভুত হাসি, তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। গৌরব জেগে উঠল চিৎকার দিয়ে, শরীরের ঘাম দিয়ে তার শয্যা ভিজে গেছে। এরপর থেকে আর তাকে কোনোদিন কেউ দেখতে পেল না। গৌরব যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

পরের দিন সুজিত, রাজ, আর অমিত যখন গৌরবকে খুঁজছিল, তারা কোনো খবর পেল না। এক ধরনের আতঙ্ক তাদের মধ্যে তৈরি হল। কিন্তু তারা ঠিক করল, তারা পুলিশের কাছে যাবে না, কারণ খুনটা তারা নিজেরাই করেছিল।

কিছু দিন পর, সুজিত ঠিক একইভাবে অদ্ভুত কিছু ঘটনার সম্মুখীন হতে শুরু করল। পথে চলার সময় তাকে দেখানো অদ্ভুত ছায়া দেখা দেয়, মাথার মধ্যে কেমন ভৌতিক শব্দ শুনতে পায়, আর রাতে ঘুমের মধ্যে জনার্দনের সেই হাসি, সেই চোখ, তাকে ঘিরে ধরে। এক রাতের ঘুমের পরে সকালে সে আর ঘুম থেকে উঠতে পারল না। তার মৃতদেহ তার বিছানায় পড়ে ছিল, চোখ দুটি খোলা, মুখে ছিলো চরম ভয় আর আতঙ্কের ছাপ।

বাকি রইল শুধু রাজ আর অমিত। তারা বুঝতে পারল, তারা কিছু একটার বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যে শক্তি তাদের জীবনকেই ছিনিয়ে নিচ্ছে। একদিন তারা এই রহস্যটা খুঁজে বের করার জন্য জনার্দনের পুরোনো এক বন্ধু, বিজয় সিংয়ের কাছে গেল। বিজয় সিং তাকে বলল, "জনার্দনের ব্যবসা চলত কোনো এক অন্ধকার শক্তির ওপর নির্ভর করে। তার অঙ্গীকার ছিল যে, তার জীবন কেউ যদি কেড়ে নিতে চায়, সেই ব্যক্তি নিজেই একে একে মৃত্যু মুখে পতিত হবে। এ ছিল এক অভিশপ্ত সংরক্ষণের শপথ।"

রাজ ও অমিত বুঝতে পারল, জনার্দনের অভিশাপ তাদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। সেই রাতেই অমিতের মৃত্যু হলো। কেউ জানল না কিভাবে, তবে বাড়িতে তার মৃতদেহ পাওয়া গেল, মুখে জনার্দনের সেই হাসির ছাপ।

শুধু বাকি রইল রাজ। এক ভীত-সন্ত্রস্ত জীবন কাটাতে লাগল সে। সে জানত, তার সময়ও দ্রুত আসছে। এক রাতে, সে ঠিক করল, জনার্দনের কবরের সামনে গিয়ে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু কবরের সামনে পৌঁছে তার মাথায় একটাই প্রশ্ন, কেন সে এই ভুল করল?

সেই রাতে জনার্দনের কবরের সামনে তার দেহ পড়ে পাওয়া গেল। মুখে সেই একই আতঙ্ক, চোখ দুটি খোলা। শেষমেশ, এই চোরাগলি ও পুরোনো কলকাতার সেই কবরটি জনার্দনের কাহিনী বলতেই থাকল।
 

Comments

    Please login to post comment. Login