পোস্টস

গল্প

বাড়ীর অদৃশ্য অতিথি

৭ নভেম্বর ২০২৪

ফারজানা আক্তার

 

"বাড়ির অদৃশ্য অতিথি"

এক ছোট্ট গ্রামের প্রান্তে, এক পুরনো বাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। বাড়িটি বহু বছর আগে একটি পরিবারের বাসস্থান ছিল, কিন্তু এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটার পর সবার জীবন বদলে যায়। সেই পরিবারটি এক রাতেই অদৃশ্য হয়ে যায়, এবং বাড়িটি একাকী পড়ে থাকে, শুধুমাত্র তার দেয়ালগুলিতে অদ্ভুত শীতলতা এবং ভয়ের ছায়া রেখে। গ্রামের মানুষদের মুখে সেই বাড়ির গল্পের কোনো শেষ ছিল না, তবে সবাই জানত—কেউ সেই বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলে, তারা আর বেরিয়ে আসবে না।

এমনই এক দিন, সঞ্জয় নামের এক যুবক শহর থেকে ফিরছিল। সে ছিল এক প্রতিভাবান ইঞ্জিনিয়ার, এবং তার মধ্যে একটি এক অদ্ভুত আগ্রহ ছিল পুরনো জায়গাগুলোর দিকে। সঞ্জয় শুনেছিল সেই বাড়ি নিয়ে অনেক গল্প, কিন্তু তাকে মনে হয়েছিল সেগুলো শুধুই গল্প। তাই, একদিন সে ঠিক করল—সে সেই বাড়ি দেখতে যাবে এবং খুঁজে বের করবে আসলে কী ঘটেছিল।

সঞ্জয় বাড়িটির সামনে পৌঁছাতেই এক ঠাণ্ডা বাতাস তার মুখে লাগল। বাতাস যেন কিছু বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু সঞ্জয় কোনও পাত্তা দিল না। বাড়ির দরজা খোলাই ছিল, যেন তাকে ভিতরে ডাকছে। সঞ্জয় চুপচাপ প্রবেশ করল, এবং তাকে মনে হল, বাড়ির ভেতরের বাতাসের মধ্যে কোনো অদৃশ্য উপস্থিতি ছিল।

বাড়ির দেয়ালগুলো ম্লান হয়ে গেছে, ফাটল ধরে গেছে। সঞ্জয় ঘরের প্রতিটি কোণায় তাকাতে থাকল। হঠাৎ একটি সিঁড়ির নিচে একটি পুরনো বই পড়ে ছিল। বইটি হাতে নিয়ে সে খুলল, কিন্তু কিছু অদ্ভুত লেখা ছিল। "যখন রাত আসে, সব কিছু শেষ হয়ে যায়।"

এটি পড়ার পর সঞ্জয়ের চোখের সামনে যেন কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল। গা শিউরে ওঠা অনুভূতি এসে গেল। সে সিঁড়ির উপর দিয়ে উঠে গেল, কিন্তু যখন দ্বিতীয় তলায় পৌঁছালো, তার চোখে পড়ল কিছু অদ্ভুত ছায়া।

ছায়াগুলি যেন সরাসরি তাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছিল। সঞ্জয় ভয় পেয়ে এগিয়ে গেল না, কিন্তু ঠিক তখনই সে শুনতে পেল এক অদ্ভুত গুঞ্জন—একটি পুরনো মহিলার কণ্ঠ, "এখানে এসো না।"

সঞ্জয়ের পা যেন আটকে গিয়েছিল। সে পিছনে ফিরে তাকালে, কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল একটি অশরীরী শেড, যেন এক অন্ধকার মুখ। সঞ্জয় আরও ভয় পেয়ে গেল, কিন্তু তার চিন্তা ছিল, এই রহস্য উদ্ঘাটন করতেই হবে।

তার পর, সেই অদৃশ্য সত্তা তার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল। সঞ্জয় বুঝতে পারল, এটি শুধু এক ভূত নয়, এটি সেই পরিবারটি—যারা এক অন্ধকার শক্তির দ্বারা আটকে পড়েছিল। হঠাৎ, তার সামনে পুরনো একটা দরজা খুলে গেল। সঞ্জয় জানত, ভিতরে কিছু আছে—কিন্তু কী তা সে জানত না।

সে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল। একটি বড় হলরুম, যেখানকার দেওয়ালগুলো অদ্ভুতভাবে ম্লান হয়ে গেছে। সঞ্জয় টর্চলাইটে আলো ফেলতেই, তার সামনে একটি বড় আয়না দেখতে পেল। আয়নার মধ্যে সঞ্জয় নিজেকে দেখল, কিন্তু সে দেখতে পেল না যে, তার পেছনে কী আছে।

ফিরে তাকালে, সে দেখল সেই অদৃশ্য সত্তাটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। সঞ্জয়ের মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভয় ঢুকে গেল। সে দ্রুত আয়না থেকে চোখ সরাল এবং একটি পুরনো চিঠি দেখল। চিঠির উপরে লেখা ছিল—"যে আসবে, সে কিন্তু চলে যাবে না।"

এখন সঞ্জয় বুঝতে পারল, সে এক ভয়ের জগতে প্রবেশ করেছে। সে ফিরে যেতে চাইল, কিন্তু তখনই ঘরটা একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। গাঢ়, শীতল একটা অনুভূতি এসে তাকে ঘিরে ধরল। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল, তার মধ্যে কিছু শোষিত হয়ে যাচ্ছে।

তারপর, সেই অদৃশ্য সত্তা তার কাছে চলে আসতে শুরু করল। সঞ্জয় যন্ত্রণায় চিৎকার করল, কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিল না। তারপর, এক অদ্ভুত ভয়াবহ আওয়াজ শুনতে পেল—"এখানে থাকো, এখানে থাকো, তুমি আমাদের অংশ।"

সে বুঝতে পারল, সে আর বাইরে বের হতে পারবে না। সঞ্জয়ের জীবন শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু তার আত্মা, সেই বাড়ির অদৃশ্য আতিথ্য হিসেবে, সেখানে আটকে রয়ে গেল।

পরবর্তী দিন, গ্রামের মানুষরা আবার শুনল—সঞ্জয়ের মতো আরও কেউ হারিয়ে গেছে। বাড়ি আবার ফাঁকা হয়ে গেছে, তবে কেউ জানে না—সেখানে যে অদৃশ্য সত্তাগুলি রয়েছে, তারা কখনোই সেখান থেকে চলে যায় না।

গ্রামের মানুষদের মুখে আজও সেই গল্প শোনা যায়, আর সেই বাড়িটি—যেখানে এক যুবক নিখোঁজ হয়েছিল, আজও সেই অদৃশ্য আতিথ্যে নতুন নতুন মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে।


-