সেই ঘটনার পরে দীর্ঘকাল আর বকুলপুর গ্রামে কোন জোনাকিপোকা দেখা যায়নি। নব্বই ঊর্ধ্ব আব্দুল মতিন রাতের অন্ধকারে হন্যে হয়ে খুঁজেছেন বনে-বাদাড়ে কিন্তু এমন কোন আলো চোখে পড়ে নাই যার কোমলতা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এখন তিনি প্রতিদিন মাগরিবের নামাজ পড়ে দোয়া করেন 'হে আল্লাহ একটা জোনাকি মিলায়ে দাও'! মৃত্যুর আগে তার একটাই ইচ্ছে, রাতের বেলায় মশারির ভেতরে শুয়ে যখন আধো ঘুমে ঢলে আসবে চোখ তখন দেখবেন জানালা দিয়ে ডাকপিয়নের লন্ঠনের আলোর মতো একটা মোলায়েম আলো পুকপাক করে জ্বলতে জ্বলতে উড়ে এসে বসবে তার মশারির কোনায়। তারপর সেখান থেকে উড়ে যাবে তাকের উপর সবচেয়ে সাবধানে রাখা পবিত্র কুরআন শরীফের রেহেলের উপর! তারপর আলমারির উপর, যেখানে সযত্নে রাখা সত্তুর বছর আগে তার নিজের বিয়েতে পাওয়া শশুর বাড়ির দান। তার বউ হালিমা জোনাকি বড় ভালোবাসতো। একদিন বলেছিলো, 'আমি মরে গেলে ওই ঝোপের ভেতর আমার কবর দিও। রাতের বেলায় সেখানে হাজার হাজার জোনাক জ্বলে। আমার ভয় লাগবে না'। এখন হয়তো হালিমা অনেক ভয় পায় অন্ধকারে! অথবা মৃত্যুর পরে এসবের কোন অর্থই নেই!
মাঝে মাঝে আব্দুল মতিন তার ছোট ছোট নাতিদের খুব ভাব নিয়ে বলতো, 'আরেহ তোরা তো কিছুই দেখিস নাই। আমরা যখন ছোট আছিলাম তখন আমের সময় ভাত খাইতাম না। বাড়ির চার দিকে বুড়া বুড়া সব আমের গাছ। আমাগো বাড়ির আম খাইছে গোটা গ্রামের মানুষ। কেউ কেউ তো আমার মায়ের থেকে আম নিয়া বেটির বাড়িতে সাজন দিতো। ওই পুকুর পাড়ে একটা কাঁঠাল গাছ আছিলো সেই গাছের কাঁঠাল এতো বড় যে গরুর গাড়িতে করে নিয়ে আসতে হইতো'। বলতে বলতে আব্দুল মতিনের শৈশব হুমড়ি খেয়ে পড়তো মস্তিষ্কের ভেতর। এমন সময় তার নাতিরা মনে করায়ে দিতো, 'দাদা জোনাকিপোকার গল্পটা বলবানা?' জোনাকির গল্প করতে গেলেই চোখ ছলছল করে উঠতো মতিনের, 'আমার একটা বোন আছিলো, ও আর আমি মিলে রাতের বেলায় জোনাকি ধরে মশারির ভেতর ছাড়তাম। আহা! সে কি আনন্দ! সেই ছোটকালে আমার বোনটা পানিতে ডুবে মরে গেলো! ওর নাম আছিলো আছমা'!
আহা জোনাকিপোকা! এক জোনাকিপোকার আলো দিয়ে হয়তো শৈশবের সব রাতের অন্ধকার হয়ে যাওয়া স্মৃতি গুলোকে আবার আলোকিত করা যাবে। আব্দুল মতিন হয়তো তাই খুঁজে চলেছেন একটা জোনাকিপোকা অথবা তার বোনের মুখ অথবা মায়ের মুখ অথবা হালিমার অথবা মৃত্যুর পরে তিনি অন্ধকার ভয়পান!
বকুলপুর গ্রামের চারপাশে এখন শুধু আলো আর আলো। সরকারের পক্ষ থেকে কবরস্থানেও আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে ঝোপঝাড় প্রায় নেই বললেই চলে। সব পরিস্কার। তাহলে আবদুল মতিনের ভয়টা কিসের? সামান্য একটা জোনাকিপোকার আলো দিয়ে কোন অন্ধকার দূর করতে চান তিনি? আমি তার গ্রামের একজন সাধারণ বাসিন্দা, আমি সেই উত্তর জানিনা। আপনার কি মানে পড়ে সেই ছোটকালে জোনাকিপোকা দিয়ে কি করছিলেন?
সেবার খুব বৃষ্টি হলো। মাটির রাস্তা কাদায় মাখামাখি হয়ে গেলো। গ্রামের মানুষের বাজারে ধান বেচতে কষ্ট হয়ে গেলো। তারপর সবাই মিলে এমপি সাহেবকে ধরে রাস্তা পাকা করে নিলো। তারপর বিদ্যুৎ এলো। তারপর হাসপাতাল হলো। একটা স্কুল হলো। দোকানপাট হলো। গ্রামের মাটির বাড়ি সব দোতলা তিনতলা দালান হয়ে গেলো। আর এসবের সাথে উন্নয়নের আলোয় আলোকিত হলো মানুষের জীবন। এতো এতো আলোর ভিড়ে লজ্জায় বকুলপুর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেলো একদল জোনাকিপোকা। হয়তো আর কোনদিন তারা ফিরবেনা। আব্দুল মতিনের শৈশবের সেই সব স্মৃতিও আলোকিত হবে না।