গণমাধ্যমে পরিবেশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের (৫৩তম ব্যাচ) নবীন শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রায় ১,৫০০ কপি কুরআন শরীফ বিতরণ করা হয়েছে।
বুধবার (৬ নভেম্বর) বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান অডিটরিয়ামের গ্যালারি কক্ষে 'জাবি কুরআন এন্ড কালচারাল স্টাডি ক্লাব' আয়োজিত এক নবীনবরণ ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা অনুষ্ঠানে নবীন শিক্ষার্থীদের হাতে কুরআন তুলে দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক প্রযোজনার অংশ হিসেবে ইসলামি সংগীত পরিবেশন করেন নাশীদ শিল্পী আবু উবায়দা এবং শিশু শিল্পী ঈশরাক সুহায়েল।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক Mohammad Kamrul Ahsan বলেন, 'কুরআন এন্ড কালচারাল স্টাডি ক্লাবের এ ধরনের আয়োজন আমাদের ইহজাগতিক ও পরজাগতিক কল্যাণ বয়ে আনবে। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এই জীবন বিধান সম্পর্কে জানতে ও আমাদের জীবনে চর্চা করতে কুরআন পাঠ অত্যাবশকীয়। কুরআন পাঠ করলেই বা এর ব্যাখ্যা করতে পারলে আমাদের লক্ষ অর্জন হবে না, লক্ষ অর্জন করতে আমাদের জীবনাচরণে কুরআনের শিক্ষা প্রতিফলিত হতে হবে।'
বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। এখানকার অধিকাংশ মানুষ প্র্যাকটিসিং মুসলিম। উপাচার্য কামরুল আহসান স্যারও এর বাইরে নন। কিন্তু তিনি সর্বজনের শিক্ষক বলেই কখনো হয়ত ভিন্নধর্মাবলম্বীদের কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে তাদের ধর্মীয় বাণীরও প্রশংসা করবেন। যেমনটা করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কিংবা জামায়াতের আমির ড. শফিকুর রহমান। এবার পূজোয় এক জামায়াত লিডারকে মণ্ডপে গিয়ে সসম্মানে দেবী দুর্গার মন্ত্র পাঠ করতেও দেখলাম।
এমন এক পার্সপেক্টিভে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কুরআন বিতরণে অসঙ্গতি খুঁজবেন কেন? কেউ কেউ দেখলাম উষ্মা প্রকাশ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলছেন। এই তারাই আবার দিওয়ালিতে নাচগানের প্রোগ্রামে ইনক্লুসিভ সোসাইটির প্রশংসায় মেতেছেন। কেনরে ভাই? সর্বমানুষের মনস্তাত্ত্বিক বোধ নিয়ে গবেষণা করলে সবার ধর্মীয় অন্তর্ভুক্তি নিয়েও আলাপ করতে হবে বৈকি। ধর্ম তো মানবাচরণের বাইরে না। এমনকি ওই অনুষ্ঠানে যদি ভিন্নমতের ছাত্ররাও কুরআন পেয়ে থাকেন সেটিও দোষের না। ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট থেকে সেটি বরং ইতিবাচক। সবার অধিকার আছে সবার ধর্মতত্ত্ব আগ্রহভরে পাঠ করবার।
কাউকে দেখলাম অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের ওজু নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কারো যদি পবিত্র কুরআন হাতে থাকা অবস্থায় ওজু ছুটে যায় তিনি কি হাত থেকে কুরআন শরীফ সরিয়ে ফেলবেন? এত ছুৎমার্গ নিয়ে সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক গড়া যায় আসলে?
যাহোক অন্য কোনো অনুষ্ঠানে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শিক্ষার্থীদেরকে যদি উপনিষদ কিংবা ক্রিশ্চিয়ান কম্যুনিটি বাইবেল উপহার দেয় তাতেও আমাদের সমান সায় থাকবে। সেখানেও নিশ্চয়ই ভিসি স্যার প্রধান অতিথি থাকবেন। ওখানে মুসলিম শিক্ষার্থীরাও সসম্মানে অংশগ্রহণ করবে।
হ্যাঁ কোনোদিন যদি ইউরোপ, জাপান বা সিঙ্গাপুরের মতো লিবারেল সমাজ কায়েম হয়, কল্যাণ রাষ্ট্রের দেখা আমরা পাই; তখন হয়ত বিদ্যায়তনগুলো থেকে ধর্মীয় চিহ্ন সরে এসে কেবলমাত্র ব্যক্তিগত জীবনাচরণে মান্যতা পাবে। আমাদের দেশের গবেষকেরা অক্সফোর্ড -হার্ভার্ডের মতো পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিএইচডি বা পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রিকে জ্ঞানের শীর্ষে আরোহনের মানদণ্ড বিবেচনা করেন, সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম নিয়ে সামান্যতম দেখনদারিও নেই। তবু তারা প্রজ্ঞার শীর্ষে আছে। আর আমরা জোরজবরদস্তিতে হলেও সবাইকে ধর্ম গুলিয়ে খাইয়ে দিতে চাই -অথচ আমাদের নৈতিক মান ও অবস্থান কোথায় আছে আমরা সবাই তা ভালো জানি।
মোদ্দাকথা ধর্মগ্রন্থ উপহার দেয়ায় কোনো অসঙ্গতি নেই। যতক্ষণ না আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত সমাজ কায়েম করছি, যতক্ষণ না মুসলিমরা আর সবার চেয়ে নিজেদেরকে বীরশ্রেষ্ঠ দাবি করে ভিন্নমতাবলম্বীর প্রতি hegemony প্রতিষ্ঠা করবার প্রয়াস পাচ্ছে।
লেখক: সাংবাদিক
৭ নভেম্বর ২০২৪