আমি আগেই বলেছি, ফিলিস্তিন ভূমি আর ইহুদি জাতির ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে গেলে ধর্মগ্রন্থের রেফারেন্স চলে আসে। তার কারণও ব্যাখ্যা করেছি। আমার মতে খলিফা উমর রা কর্তৃক জেরুজালেম বিজয়ের সময় থেকে ফিলিস্তিনের আধুনিক ইতিহাস যাত্রা শুরু করে। কারণ এই সময় থেকে ফিলিস্তিনে ঘটে যাওয়া বেশিরভাগ রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর লিখিত ইতিহাস রয়েছে।
যাই হোক, সেই চিঠি এসে পৌঁছাল অর্ধজাহানের খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর হাতে। চিঠি হাতে পেয়ে তিনি একাই একটি উট এবং এক গোলামকে নিয়ে মদীনা ছেড়ে জেরুজালেমের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তিনি গোলামকে নির্দেশ দেন গন্তব্যে পৌছার আগ পর্যন্ত তারা পালা করে উটে চড়বেন। সেই গোলামের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেয় তিনি খলিফাতুল মুসলিমীনের নির্দেশ অমান্য করতে পারেনি। উমর (রা.) যখন উটে চড়তেন তখন গোলামের হাতে থাকত উটের রশি, আর ভৃত্যটি যখন উটে চড়তেন তখন ওমর (রা.) এর হাতে থাকত উটের রশি। এভাবেই ৬৩৭ সালের এপ্রিলের প্রথমদিকে উমর (রাঃ) জেরুজালেমের নিকটে পৌছান। অবস্থা এমন দাড়াল যে, যখন তারা জেরুজালেম শহরে প্রবেশের দাড়প্রান্তে তখন ২২ লক্ষ বর্গ মাইলের বিশাল সাম্রজ্যের আমিরুল মুমিনীন উটের রশি ধরে টানছেন, আর ভৃত্য বসে আছেন উটের উপর!
আবু উবাইদাহ, খালিদ ও ইয়াজিদ তাকে সেখানে অভ্যর্থনা জানান। আমর ইবন আল-আস (রাঃ) অবরোধকারী মুসলিমদের নেতৃত্বের জন্য থেকে যান। খলিফা উমর (রা) প্রথমে জাবিইয়াতে আসেন।
উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.) দেখেন মুসলিম সাম্রজ্যের আমিরুল মুমিনীন উমর (রা.)’র গায়ে অতি সাধারণ পোষাক! এটা দেখে বাইজেন্টাইনরাকি মনে করবে? উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.) বললেন- হে আমিরুল মুমিনীন! আমরা এমন এক জায়গায় আছি, যেখানের লোকেরা চাকচিক্য পছন্দ করে। মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য্য দেখে মানুষের মর্যাদার বিচার করে। তাই আপনি যদি একটু ভালো পোষাক পরতেন। তাহলে তা কতোই না উত্তম হতো। হযরত ওমর (রা.) রেগে তাঁর বুকে আঘাত করে বললেন- “আমি তোমার পক্ষ থেকে এই কথাগুলো আশা করিনি, আমরা হচ্ছি সেই জাতি যাদের মহান আল্লাহ ইসলাম দ্বারা সম্মানিত করেছেন। আমরা যদি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন উপায়ে সম্মান খুঁজি তাহলে মহান আল্লাহ আমাদের অসম্মানিত করবেন”।
এরপর উমর (রাঃ) কে পুরো শহর ঘুরিয়ে দেখানো হয়। ওমর (রা.) বায়তুল মাকদিসে যখন প্রবেশ করেন, তখন ময়লার স্তূপ মিহরাবে দাউদ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তিনি নিজ হাতে তা পরিষ্কার করতে শুরু করেন। তাঁর দেখাদেখি উপস্থিত মুসলমানরা সবাই সেই কাজে অংশ নেন। যোহরের নামাজের সময় হলে সফ্রোনিয়াস উমর (রাঃ) কে চার্চ অব হলি সেপালচারে নামাজ পড়ার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু উমর (রাঃ) তাতে রাজি হননি। তিনি বলেন, যদি তিনি সেখানে নামাজ আদায় করেন তাহলে পরবর্তীতে মুসলিমরা এই অজুহাত দেখিয়ে গীর্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করবে, যা খ্রিস্টান সমাজকে তাদের একটি পবিত্র স্থান থেকে বঞ্চিত করবে। খলিফার কথায় সফ্রোনিয়াসের ভ্রান্তি কাটতে চায়না। উমর (রা.)-এর এই কাজে সফ্রোনিয়াস উপলব্ধি করেন ইসলাম অন্যসব ধর্মের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল। উমর (রাঃ) গীর্জার বাইরে নামাজ আদায় করেন যেখানে পরবর্তীতে একটি মসজিদ নির্মিত হয় যা “মসজিদে উমর” নামে পরিচিত। মসজিদে উমরের বর্তমান রূপটি ১১৯৩ সালে আইয়ুবীয় শাসনের সময় ওই ঘটনার স্মৃতিস্বরূপ সুলতান আল-আফদাল ইবনে সালাহ উদ্দীন কর্তৃক নির্মিত হয়। অবশ্য বেথেলহামের একটি গির্জার ভেতরে তিনি নামাজ আদায় করেছিলেন। তখন একই শঙ্কার কারণে তিনি সেই গির্জার জন্য আলাদা অঙ্গীকারপত্র লেখান এবং সেখানে দল বেঁধে মুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন।
খলিফা সফ্রোনিয়াসকে জিজ্ঞেস করেন “এই শহরের আসল বাসিন্দারা কোথায়”?
সফ্রোনিয়াস অবাক কন্ঠে জানতে চান- আসল বাসিন্দা মানে?
উমর (রাঃ) বলেন- কেন, ইহুদীরা? তারাইতো এই শহরের নির্মাতা। নবী দাউদ আর নবী সুলাইমানকে আপনি ভুলে যেতে চান?
জবাবে তিনি বলেন- ইহুদীরা থাকে শহরের বাইরে। সফ্রোনিয়াসের বিস্ময় কাটেনা। তিনি ভাবেন আমি তার জায়গায় থাকলে প্রতিটি বিধর্মির শিরশ্ছেদ করতাম। অথচ এরা আমাদের কিছুই বললনা, ক্রুশ ছিনিয়ে নিয়ে গীর্জা ভাঙলনা, এমনকি জানতে জানতে চাইছে ইহুদীরা কোথায়। খলিফার এই মহানুভবতা দেখে সফ্রোনিয়াস বিস্মিত হন।
উমর (রাঃ) তাদের ডেকে পাঠাতে নির্দেশ দেন। উমর (রা) সফ্রোনিয়াসকে বলেন- “নগরির একাংশ আমি তাদের দিতে চাই, এখন থেকে এই নগরী একেশ্বরবাদী সকলের প্রার্থনালয় হবে। মুসলমান, ইহুদী, খ্রিস্টান সবাই এখানে মিলেমিশে থাকবে”। সফ্রোনিয়াস ভয় পেয়ে যান। যাদের সবাইকে নগর ছাড়া করেছে খ্রিষ্টানরা এবার তাদের ডেকে আনার মানে কি?
খলিফা উমর খালিদ বিন ওয়ালিদকে ডেকে বলেন-“নগরীর বাইরের দিকে কিছু ইহুদী পরিবার আছে”, আপনি তাদের নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে আসুন”। খলিফা ৭০টি ইহুদী পরিবারকে দূর্গ নগরীর ভেতরে বসতি গোড়ে দেন যেখানে পরবর্তী ৫০০ বছর তারা নির্বিঘ্নে বসবাস করেছে। পরবর্তী সময়ে যদ্দিন পর্যন্ত জেরুজালেম মুসলমানদের অধিকারে ছিল, তদ্দিন খলিফা ওমরের চুক্তিনামা অনুসারে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্টান সবার স্বাধীনভাবে বসবাস এবং নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল।
তিনি সফ্রোনিয়াসের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন যা উমরের চুক্তি বলে পরিচিত। এর ফলে শহর মুসলিমদের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং অমুসলিমদের নাগরিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। মুসলিমদের পক্ষে খলিফা উমর এতে স্বাক্ষর করেন এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ, আমর ইবনুল আস, আবদুর রহমান বিন আউফ ও মুয়াবিয়া মুসলিম পক্ষে চুক্তির স্বাক্ষী হন।
চুক্তিনামায় লিখিত ছিল---“পরম দয়ালু এবং করুণাময় আল্লাহ’র নামে। এতদ্বারা ঘোষণা করা হচ্ছে যে, আল্লাহর বান্দা, ঈমানদারদের সেনাপতি উমর, পবিত্র জেরুজালেম নগরীর জনগণের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করছে। নিশ্চয়তা দিচ্ছে তাদের জান, মাল, গীর্জা, ক্রুশ, শহরের সুস্থ-অসুস্থ এবং তাদের সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদির। মুসলিমরা তাদের গীর্জা দখল করবেনা এবং ধ্বংসও করবেনা। তাদের জীবন, কিংবা যে ভুমিতে তারা বসবাস করছে, কিংবা তাদের ক্রুশ, কিংবা তাদের সম্পদ – কোনোকিছুই ধ্বংস করা হবে না। তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হবে না”। জেরুজালেমের অধিবাসীদের অন্যান্য শহরের মানুষের মতই কর প্রদান করতে হবে এবং অবশ্যই বাইজেন্টাইন ও লুটেরাদের বিতাড়িত করতে হবে। জেরুজালেমের যেসব অধিবাসী বাইজেন্টাইনদের সাথে চলে যেতে ইচ্ছুক, গীর্জা ও ক্রুশ ছেড়ে নিজেদের সম্পত্তি নিয়ে চলে যেতে ইচ্ছুক, তাদের আশ্রয়স্থলে পৌঁছানো পর্যন্ত তারা নিরাপত্তা পাবে। গ্রামের অধিবাসীরা চাইলে শহরে থেকে যেতে পারে, কিন্তু তাদের অবশ্যই শহরের অন্যান্য নাগরিকদের মত কর প্রদান করতে হবে। যে যার ইচ্ছেমতো বাইজেন্টাইনদের সাথে যেতে পারে কিংবা নিজ নিজ পরিবার-পরিজনের কাছেও ফিরে যেতে পারে। ফসল কাটার আগে তাদের থেকে কিছুই নেয়া হবেনা। যদি তারা চুক্তি অনুযায়ী কর প্রদান করে, তাহলে এই চুক্তির অধীনস্ত শর্তসমূহ আল্লাহর নিকট অঙ্গীকারবদ্ধ, তাঁর নবীর উপর অর্পিত দায়িত্বের ন্যায় সকল খলিফা এবং ঈমানদারদের পবিত্র কর্তব্য। – The Great Arab Conquests থেকে উদ্ধৃত।