Posts

প্রবন্ধ

ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ইতিহাস(পর্ব-৫)

November 9, 2024

Yousuf Haque Chowdhury

উমর (রাঃ)-এর চুক্তিনামা লেখা হয়েছিলো কুরআনের নির্দেশনা এবং মুহাম্মদ (সাঃ)-এর হাদিস অনুযায়ী। এই চুক্তিনামা জেরুজালেমের খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে ধর্মীয় স্বাধীনতা এনে দেয়। সেই সময় পর্যন্ত এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে প্রগতিশীল চুক্তিগুলোর একটি। ইতিহাসে ধর্মীয় স্বাধীনতার সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি নজির ছিলো এই চুক্তি। সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষা করে এমন একটি প্রগতিশীল ও ন্যায়সঙ্গত চুক্তিটি ছিলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। 

এই চুক্তিনামা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সময় থেকে মুসলিম আর খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের একটি মানদণ্ডে পরিণত হয়েছিল। যেখানে সকল পরিস্থিতিতে যুদ্ধের পর অধিকৃত মানুষের অধিকার সমুন্নত রাখা হয় এবং কখনোই বাধ্যতামুলক ধর্মান্তরীকরণকে অনুমোদন দেয়া হয়নি।

৬৩৭ সালের এপ্রিলে মাসের শেষ দিকে জেরুজালেম শহর কাগজ কলমে খলিফার কাছে আত্মসমর্পণ করা হয়। ৫০০ বছরের নিপীড়নমূলক রোমান শাসনের পর ইহুদিরা পুনরায় জেরুজালেমে বসবাস ও উপাসনা করার জন্য অনুমতি পায়। উমর (রাঃ) ইহুদিদেরকে টেম্পল মাউন্ট এবং ওয়েস্টার্ন ওয়াল (ইহুদিদের পবিত্রতম দু’টি স্থান) এ উপাসনা করার অনুমতি দেন। এর আগে বাইজেন্টাইনরা ইহুদিদের এসব কর্মকাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। উমর (রাঃ) অবিলম্বে শহরটিকে মুসলিমদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনে পরিণত করায় মনোনিবেশ করেন। তিনি টেম্পল মাউন্ট এলাকাটি পরিষ্কার করেন। খ্রিস্টানরা ইহুদীদের ইবাদত করার যায়গাটিকে ঘোড়ার আস্তাবল হিসেবে ব্যবহার করত। উমর (রাঃ)-এর মুসলিম বাহিনী এবং সাথে থাকা কিছু ইহুদি ব্যক্তিগত উদ্যোগে এলাকাটি পরিষ্কার করেন। জেরুজালেমে দশদিন অবস্থান করার পর খলিফা উমর মদীনা ফিরে আসেন।

উমর (রাঃ) এর খিলাফতের বাদবাকী সময়ে এবং এরপর উমাইয়াদের সময় জেরুজালেম ধর্মীয় তীর্থযাত্রা এবং বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠে। মাসজিদুল আকসাকে পরিপূর্ণ করে তুলতে ৬৯১ সনে যোগ করা হয় “ডোম অফ রক” (কুব্বাত আস সাখরা)। শীঘ্রই গোটা শহর জুড়ে আরো অনেক মসজিদ ও সরকারী কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। খলিফা উমার (রাঃ) অধীনে মুসলিমদের জেরুজালেম বিজয় স্পষ্টতই শহরটির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে আছে। পরবর্তী ৪৬২ বছর পর্যন্ত উমর (রাঃ) এর চুক্তিনামা অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রেখে মুসলিমরা শহরটির শাসনকার্য পরিচালনা করে। এমনকি অনেক মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন উমর (রাঃ) এর চুক্তিনামাই বর্তমান ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে সহায়ক হতে পারে।

ক্রুসেডঃ টার্গেট জেরুজালেম

বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কেবলা ছিল। অনেক নবীর সমাধি এখানে অবস্থিত। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এখান থেকেই মিরাজে গমন করেন। এ জন্য বায়তুল মুকাদ্দাস ও এই  ভূমি মুসলমানদের কাছে খ্রিষ্টানদের চেয়েও পবিত্র ও বরকতময় বলে বিবেচিত হয়। তাই হযরত উমর (রা)- এর খেলাফতকাল থেকেই মুসলমানরা এখানকার পবিত্র জায়গাগুলো সব সময় হেফাজত করেছে। ইউরোপের খ্রিষ্টান পর্যটকরা যখন তাদের পবিত্র স্থানগুলো দর্শনের উদ্দেশ্যে এখনে আসত, তখন মুসলিম প্রশাসন তাদের সব ধরনের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করত।তাদের গীর্জা ও পবিত্র জায়গাগুলো সব ধরনের বিধি-নিষেধের বাইরে থাকত। প্রশাসন তাদেরকে উঁচু মর্যাদা দিয়ে রেখেছিল। 

দশম শতাব্দির আগ পর্যন্ত ইউরোপ ছিল একান্তই সামন্ত শাসিত। রাজ্যগুলোর প্রধানরা গির্জা থেকে বিচিত্র সব খেতাব পেতেন। যেমন কিং, কাউন্ট, ডিউক, প্রিন্স ইত্যাদি। মহামান্য পোপ এসব খেতাবের বিনিময়ে বড় অংকের রাজস্ব বা খাজনা নিতেন। এই রাজারা ছিলেন বহুধা বিভক্ত। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের লড়াই যেমনি ছিল যুগ যুগান্তের তেমনি রোমের সাথে কনস্টান্টিনোপলের লড়াই ছিল দুই-আড়াইশ বছরের। ইউরোপের খ্রিষ্টজগৎ তখন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে ছিল। একভাগের সম্পর্ক ছিল পশ্চিম ইউরোপের গীর্জার সাথে। তাদের কেন্দ্র ছিল রোম। দ্বিতীয় ভাগের সম্পর্ক ছিল কুসতুনতুনিয়া বা কনস্টান্টিনোপলের (বর্তমানের ইস্তাম্বুল) সাথে। দুই গীর্জার অনুসারীদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ ছিল। সম্রাট কনস্টান্টান্টাইনের পর থেকেই “Iconic” এর মাধ্যমে একেশ্বরবাদী খ্রিষ্টধর্ম পরোক্ষ মূর্তিপূজাকে বেছে নেয়, অর্থাৎ ক্রুশ ও যীশু-মেরির মূর্তিপূজা। রোমের খ্রিষ্টজগৎ বিবি মরিয়মকে উপস্থাপন করে লাস্যময়ী ও কামনাময়ী রূপে। যীশুর কল্পিত ক্রুশবিদ্ধ হবার যন্ত্রনাকে ইউরোপের চিত্র শিল্পীরা প্রায়-দিগম্বর এবং বিদ্ধস্ত এক পুরুষের অবয়বে ফুটিয়ে তোলে যা নবী ঈসা(আঃ) বাস্তবিকভাবে কখনোই ছিলেন না। 

পোপ দ্বিতীয় আরবান ছিলেন পশ্চিম ইউরোপের গীর্জার প্রধান। তিনি ছিলেন যুদ্ধবাজ ধর্মীয় নেতা। যখন কনস্টান্টিনোপল Eastern Orthodox Christianity এর রাজধানী হয় তখন থেকে ইউরোপের শাষকদের কাছে তার মর্যাদা ও গুরুত্ব কমে গিয়েছিল। তাছাড়া অনেকদিন ধরেই তিনি পূর্ব ইউরোপ বা বাইজেন্টাইন গীর্জার কর্তৃত্বও চাচ্ছিলেন যাতে করে তিনি পুরো বিশ্বের খৃস্টান জাতির আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব পেয়ে যান। রোমের ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে তিনি একটি সাংঘাতিক কৌশলের আশ্রয় নেন। সেটা হল তিনি জেরুজালেমে খৃস্টানদের প্রাধান্য ফিরিয়ে আনা ও মুসলমানদের পরাজিত করার প্রচারণা চালাতে থাকেন। 

ইসলামী খেলাফতের পতন ও বিশৃঙ্খলার সময় পোপের প্ররোচনায় ইউরোপের মতলববাজ পর্যটকরা এই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। পোপের নির্দেশনা মতে ইউরোপের এসব জ্ঞানপাপী পর্যটকরা জেরুজালেমের তীর্থ যাত্রায় স্থানীয় মুসলমানদের সাথে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া লাগানোর চেষ্টায় লিপ্ত হয়। তাদের এমন উদ্দেশ্যমূলক আচরণের কারণে মুসলমান ও খৃস্টানদের মধ্যে ছোটখাটো দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তারপর দেশে ফিরে তারা জেরুজালেমের মুসলমানদের নিয়ে বানোয়াট  দুর্ব্যবহারের কাহিনী প্রচার করে ইউরোপবাসীকে উস্কে দিতে থাকে। ইউরোপের খৃস্টানরা আগে থেকেই মুসলিম বিরোধী থাকায় তাদের মধ্যে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা আরো বেড়ে যায়। 

তিনি গীর্জার প্রভাব শক্তিশালী করতে ইউরোপের সর্বত্র “ঈশ্বরের পবিত্র গীর্জা অর্থাৎ সেপালছার উদ্ধারের আহ্বান" ছড়িয়ে দিলেন---আর কতকাল আমাদের পবিত্র গীর্জা, যীশুর মৃত্যুস্থল মুসলমানদের অধীনে থাকবে”? এসময় গোটা ইউরোপে পরিকল্পিতভাবে একটি গুজব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, হযরত ঈসা (আ) আবার নেমে এসে খৃস্টানদের সব দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। কিন্তু তার অবতরণ হবে তখন, যখন পবিত্র জেরুজালেম শহর মুসলমানদের হাত থেকে স্বাধীন করা হবে। এই গুজব খৃস্টানদের ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে। 

একই সাথে খৃস্টান ধর্মগুরুরা ব্যাপকভাবে প্রচার করতে থাকেন যে, যেকোন পাপাচারে লিপ্ত ব্যাক্তি যদি বায়তুল মুকাদ্দাস ভ্রমণ করে আসে, তাহলে পরকালে সে জান্নাতের উপযুক্ত হয়ে যাবে। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে বড় বড় দুস্কৃতিকারীও পর্যটক হিসেবে বায়তুল মুকাদ্দাস আসতে শুরু করে। এরা শহরে প্রবেশের সময় নিজেদের প্রধান্য ও উপস্থিতি প্রকাশ করার জন্য নাচ-গান ও শোরগোল করত, প্রকাশ্যে মদ্যপাণ করতো। ফলে স্থানীয় মুসলিম প্রশাসন পর্যটকদের এসব আপত্তিকর ও অশোভনীয় আচরণ, অনাচার ও শান্তি শৃঙ্খলা নষ্টকারী কার্যকলাপ বন্ধের জন্য তাদের উপর কিছু নৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করে। কিন্তু এসব পর্যটক দেশে ফিরে মুসলমানদের কঠোর ব্যবহারের মনগড়া কাহিনী শোনাতে থাকে, যাতে তাদের ধর্মীয় উত্তেজনাকে আরও চাঙ্গা করা যায়। 

Comments

    Please login to post comment. Login