ফাল্গুনের ভোরের মিষ্টি নরম রোদের পরশ একবারে মিলিয়ে যায়নি। স্নিগ্ধ বাতাসের কোমল ছোঁয়ায় মনপ্রান উচাটন। সেই ঘোরলাগা সকালে গাজিপুরের নিসর্গ বাংলোর সবুজ লনের ঘাসগুলো সবাইকে স্বাগত জানাতে তখনও ভেজা রয়েছে। এতগুলো মানুষকে একসাথে এই প্রথম হয়তোবা কাছে পেয়েছে। তাইতো বুক উজার করে দিয়েছে অকৃত্রিম ভালবাসায় তার নান্দনিক সৌন্দর্যের মায়ায়! পাশ্ববর্তী সবুজ বনানীতে আস্তানা গাড়া পাখির ঝাঁকের স্বরব দৃষ্টিও আজ এদিকে। তাইতো কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে দিয়ে শিস দিচ্ছে আর গান গাচ্ছে। কখনও একটি কিংবা দুইটি, কখনোবা সমস্বরে কিচিরমিচির করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। পাখিরা ও হয়তো চেয়েছে এই ঐতিহাসিক মহেন্দ্রক্ষনের অংশ হতে!
বাংলোর প্রশস্ত চত্তর তখন অগনিত আত্মীয় স্বজনের মিলনমেলায় পরিপূর্ণ। সবাই আপনজন, আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। কতদিন পর, কত সহস্র ক্ষন পর আজ সবাই এক হয়েছে আত্মার টানে, হৃদয়ের তৃষ্ণা মিটাতে, একসঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে। ততক্ষণে সবাই সামনের লনে, বাংলোর অভ্যন্তরে কিংবা পিছনের খোলা ময়দানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প আড্ডায় মশগুল। যেদিকে চোখ যায় শুধুই আপনজন!! এ এক অসাধারণ মুহুর্ত, ঘোরলাগা ক্ষন। পৃথিবীর শতকোটি চেনা অচেনা মানুষের মধ্যে এই মানুষগুলো একান্তই আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ। যারা একে অপরের দুঃখে বেদনায় নীল হয় কিংবা সুখে খুশীতে উদ্বেলিত হয়। এইতো এখানে আছে জন্মদাত্রী মা, মাতৃসম খালা, খালু, মামা, ভাই বোন, ফুটফুটে শিশুরা! সত্যিই এ এক মধুর লগন!
সবার উপস্থিতি আজ ভুলিয়ে দিয়েছে সব বাধা আর শরীরের যত যাতনা। তাইতো ক্রিকেটের ব্যাট হাতে নিতেই এক একজন ফিরে গেছে সেই সোনালী দিনগুলোতে। সেই ফর্ম আর উচ্ছ্বাস কোথা থেকে যেন আজ আবার উদয় হল। সবার ক্রিকেট উন্মাদনার আবেগ ছুঁয়ে গেছে দর্শক সারিতে থাকা আমাদের মা খালাদেরও। তারা হয়তো স্মৃতির ভেলায় ভেসে ফিরে গিছেন আমাদের সেই ছোট্টবেলায়। যখন ক্রিকেট খেলে এসে ঘরের আঙিনায় বসে চলত খেলার সালতামামি আর তাদের মমতার হাতে সযন্তে বানানো কোনো খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি। আহা কি মধুর সেই দিনগুলো!আবার এতদিন পর তাদের মুখ জুড়ে নেমে আসা একবিন্দু হাসিই নিশ্চিত করেছে এই মিলনমেলার স্বার্থকতা!
সেখানে ছিল অসুস্থ মেজ খালাম্মার অকল্পনীয় আত্মবিশ্বাসী উপস্থিতি; বড় আপার অদম্য সাহসিকতা-শুধুমাত্র এক হাতে (অন্য হাতে ব্যথা থাকায়) "পিলো পাসিং" এ অংশগ্রহণ; পরিবারের নতুন সদস্যর হাত ধরে সিনিয়রদের হেটে হেটে কথা বলা-মনে হয় কতদিনের চেনা! ভাবীদের চিরায়ত লাজুকতা ঝেড়ে ফেলে র্যাফেল ড্রর টিকেট বিক্রি করার উৎসাহ আর আন্তরিকতা; খালুজানের পেনাল্টি কিকের দুর্দান্ত শট; মেজ দুলাভাইয়ের ক্রিকেট ব্যাটে চার মারার চেষ্টা; এ রকম অসংখ্য খন্ডচিত্র মনে করিয়ে দেয় সবার শিকড়ে ফেরার তাড়না, মানসিক শক্তি, অন্তরের গভীরতা আর মজবুত বন্ধন।
বিদায় বেলায় গাড়িতে বসে ভাবছিলাম এতবড় মহতি আয়োজন সাফল্যমন্ডিত করতে সবার প্রচেষ্টা আমাদেরকে এক হয়ে থাকার প্রেরণা যোগাবে যুগ যুগান্তর। একরাশ ভাললাগায় মনপ্রান তখনও আচ্ছন্ন। চোখ বুজে সারাদিনের মিষ্টি মধুর স্মৃতিগুলো রোমান্থন করতে ছিলাম যাতে করে অন্তরের মধ্যখানে চিরতরে গেঁথে যায়। আর হৃদয়ের গহীনে জমা হতে থাকা আউলা অনুভূতিগুলোকে কিছুটা কাব্যিক রূপ দেবার চেষ্টা করতে থাকি।
আবার আসিব ফিরে
আবার মিলিব প্রানে
মধুভরা এক মধুক্ষনে
জারুল হিজল বনে
বসন্তের উতলা বাতাসে
কিংবা বর্ষার বারিধারায়
হেমন্তের স্নিগ্ধ শিশিরে
পাতা ঝরা শীতের
কোনো এক মিষ্টি বিকেলে
সহসা এক ঘুমভাঙ্গা
প্রথম আলোর প্রাতে
আত্মার অনিশ্বেষ আহবানে
আবার মিলিব প্রানে...