বাংলাদেশে বস্ত্র শিল্পের ইতিহাসঃ
প্রায় ১৫৫০ সালের দিকে ভারত উপমহাদেশ বস্ত্র শিল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়। হার্ভাট বিশ্ববিদ্যালইয়ের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক জি উইলিয়াল তার বই, "India’s Deindustrialization in the 18th and 19th Centuries" এ উল্লেখ করেছেন, সে সময় সারা বিশ্বের প্রায় ২৫% বস্ত্র ভারত উপমহাদেশ একা প্রদান করত। মোঘল রাজাদের শাসনাধীন ভারত উপমহাদেশ সে সময় ছিল বস্ত্রের জন্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ টেক্সটাইল এবং তুলার কারখানা এ উপমহাদেশে ছিল। বাংলার মসলিন কাপড় সে সময়ে সারা বিশ্বের মন জয় করতে পেরেছিল। শুধু তাই নয়, বাংলার টেক্সটাইল শিল্প ডাচ ব্যবসায়িদের দ্বারা ইউরোপে প্রায় ৫০ ভাগ টেক্সটাইল পন্য এবং ৮০ ভাগ সিল্ক রপ্তানি করা শুরু করে। সে সময়ে এশিয়ার প্রায় সকল স্থানে টেক্সটাইল পন্য ছড়িয়ে যায় যেটা ঢাকা টেক্সটাইল নামে পরিচিতি লাভ করে। সত্যি বলতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ জানত না যে, টেক্সটাইল বা বস্ত্র শিল্প কি? কিন্তু আমাদের এ দেশে টেক্সটাইলের ইতিহাস অনেক পুরাণ। বিংশ শতাব্দীতে এই বাংলায় যার হাতে নতুন টেক্সটাইলের জন্ম হয়েছিল তিনি ছিলেন কুষ্টিয়ার সুর্যসন্তান মোহিনী মোহন চক্রবর্তি। তিনি কুমার খালীর থানার লাঙ্গী পাড়ার এক অভিজাত ব্রাক্ষ্মন পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। ভারত উপমহাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের ইতিহাসে যে কয়জন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম পাওয়া যায় তার মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি স্বদেশী আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাকে স্বয়ংসম্পুর্ন করতে ১৯০৮ সালে কুষ্টিয়া শহরে গড়াই নদীর পাশে মিলপাড়া একালায় প্রায় ১০০ একর জমির ওপর একটি টেক্সটাইল মিল চালু করেন। এটার নাম দেন মোহিনী মোহন মিলস এন্ড কোম্পানি লিমিটেড। তৎকালীন সময়ে কুষ্টিয়ায় উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। নদীপথ এবং ভারতের শিয়ালদহ হতে কুষ্টিয়ার মিলপাড়া পর্যন্ত রেলপথ ছিল। প্রথমবস্থায় ৮ টি তাঁত নিয়ে মিল চালু করেন। পরে তিনি সুদূর ব্রিটেন থেকে ২০০ টি পিতলের হ্যান্ডলুম তাঁত আমদানী করেন। এখানে প্রায় ৩০০০ মানুষ কাজ করত। কারখানাটিতে উন্নত মানের সুতা, মোটা শাড়ী ও ধুতি তৈরি হত। ধীরে ধীরে মিলটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হতে থাকে। মিলটি থেকে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, বার্মাতে প্রচুর পরিমানে সূতা রপ্তানি হত। এটি পরবর্তীতে সমগ্র এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাপড় মিল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা তাকে প্রাপ্য সম্মান দিতে পারিনি। পাকিস্তান সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা ১৯৬৫ সালে মোহিনী মোহনকে হত্যার হুমকি দেয়। বাধ্য হয়ে এই মহান উদ্যোক্তা রাতের আধারে এক কাপড়ে স্ত্রী-সন্তানসহ ভারতে পালিয়ে যান।
বাংলায় টেক্সটাইল শিক্ষার সুচনাঃ
আমরা কেবল জেনারেল বিষয়গুলো নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে, টেক্সটাইল অথবা বস্ত্র শিল্পের উপর যে পড়াশুনা আছে সেটা খুব কম মানুষই জানি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমাদের দেশে বস্ত্র প্রকৌশল এর ইতিহাস অনেক পুরানো। প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯১১ সালে। ব্রিটিশ আমলে এই দেশে প্রথম ইউভিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্কুলগুলি করা হয়েছিল বাংলার চলমান বস্ত্র শিল্পে কিছু সংখ্যক টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেয়ার উদ্দেশ্যে। সে সময়ে এ স্কুল গুলোতে মাত্র ছয় মাসের একটি আটিসান লেভেল কোর্স করানো হত। এই ৩৩ টি স্কুল বাংলাদেশের ঢাকাসহ ৩৩ টি স্থানে গড়ে উঠেছিল। ছাত্র ততটা না থাকলেও অল্প অল্প করে এগিয়ে যাচ্ছিল। এর ফলে অল্প করে হলেও টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এর দক্ষ শক্তি বেরিয়ে আসছিল। ১৯২১ সালে সেই একই আইনে ব্রিটিশ সরকার নতুন আরেকটি ইউভিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকার নারিন্দায়। ১৯৩০ সালে ৩৩ টি স্কুলের কিছু আপগ্রেড করে এক বছর কোর্সে উন্নীত করা হয়। ১৯৫০ সালে নারিন্দার সেই স্কুলকে পুর্ব পাকিস্থান টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট নাম দিয়ে ডিপ্লোমা কোর্সে উন্নীত করা হয়। ১৯৬০ সালে এই প্রতিষ্ঠানকে বর্তমান ক্যাম্পাস তেজগাঁও শিল্প এলাকায় স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৭৮ সালে এই প্রতিষ্ঠানকে ডিগ্রী বা স্নাতক পর্যায়ে উন্নীত করা হয়। তখন এর নাম দেয়া হয় কলেজ অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি। এটিই ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রথম টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩টির বেশি বেসরকারি ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে বস্ত্র প্রকৌশল নিয়ে লেখাপড়া করানো হয়।
চলবে…………