পোস্টস

চিন্তা

সংবিধান সংস্কার কিংবা সংশোধন কেনো বিপজ্জনক, কোনদিকে উত্তরণের পথ?

১৩ নভেম্বর ২০২৪

শাহাদাত সুফল - Shahadat Supol

সংবিধান সংস্কার কিংবা সংশোধন কেনো বিপজ্জনক, কোনদিকে উত্তরণের পথ?

---শাহাদাত সুফল

 

ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের তীব্র কষাঘাতে দুমড়ে-মুচড়ে ক্ষমতার মসনদ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলো পূর্ববর্তী ফ্যাসিস্ট রেজিম; এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে রাষ্ট্রের নানাবিধ সংস্কার প্রপঞ্চের। রাষ্ট্রের তিনটি অর্গ্যান- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, ও বিচার বিভাগ সহ শিক্ষা, স্বাস্থ, অর্থনীতি, রাজনীতির আমূল পরিবর্তনের কথাও চিন্তকগণ জারি রাখছেন। তবে এসকল সংস্কারের মূলে যে আইনের অংশীদারিত্ব রয়েছে, তার কথাও ভুলছেন না আইনজ্ঞবৃন্দ। সেজন্যেই সমাজ, দেশ কিংবা রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে সংস্কার করতে হলে প্রথম যে কাজটি করতে হবে, তা হলো- আইনের সংস্কার। আর সংবিধানকে বলা হয় "সুপ্রিম ল অব দ্য ল্যান্ড"। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান; যার আরেক নাম শাসনতন্ত্র। আর শাসনতন্ত্রের রিফর্মেশনের মাধ্যমেই সুগম হবে তাবৎ সংস্কারের পথ।

রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে, কারা শাসক হবেন, কারা শাসিত হবেন, নাগরিকের সাথে রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্ক কেমন হবে, রাষ্ট্রের কি দায়িত্ব হবে নাগরিকের প্রতি, নাগরিক কি অধিকার ভোগ করবে ও কি-কি কর্তব্য পালন করবে রাষ্ট্রের প্রতি- এসবই উল্লেখ থাকে সংবিধানে। 

বিগত সরকারের আমলে রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে পলিটিসাইজ্ড করা হয়েছে, তাতে উপরোক্ত প্রপঞ্চের যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি বলে এসব প্রশ্ন সবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, এজন্যেই প্রশ্ন উঠেছে সংবিধান সংশোধন কিংবা সংস্কারের; এবং তার মাধ্যমেই রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন সম্ভব বলে মনে করেন অনেকে। তাই আমরা আজ দেখবো- সংবিধান সংশোধন কিংবা সংস্কার কেনো বিপজ্জনক। কোন পথে এগোলে আলোর পথ দেখবে আমজনতা। 
এগজিস্টিং সংবিধান, যাকে ৭২'র সংবিধানও বলা হয়ে থাকে। সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ এর ৭ ধারানুযায়ী এই সংবিধানে সন্নিবেশ করা হয় ৭ক ও ৭খ ধারাকে। 

 

৭ক অনুচ্ছেদের ভাষ্য হলো- 

"কোন ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোন অসাংবিধানিক পন্থায় -

এই সংবিধান বা ইহার কোন অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে; কিংবা এই সংবিধান বা ইহার কোন বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে- তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে। এবং কোন ব্যক্তি উপরোক্ত কোন কার্য করিতে সহযোগিতা বা উস্কানি প্রদান করিলে; কিংবা কার্য অনুমোদন, মার্জনা, সমর্থন বা অনুসমর্থন করিলে- তাহার এইরূপ কার্যও একই অপরাধ হইবে। এবং এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হইবে"।

 

৭খ অনুচ্ছেদের ভাষ্য হলো- 

"সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদসমুহের বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোন পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে"।

 

ফলত, কেউ যদি এই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭খ তে উল্লেখিত "বেসিক স্ট্রাকচার" অন্তর্ভুক্ত অংশ সমূহ সংস্কার, পরিবর্তন, পরিবর্ধন করেন কিংবা করতে উৎসাহ প্রদান করেন, কিংবা সহায়তা প্রদান করেন, তবে তাকে কিংব তাদের প্রচলিত আইনানুসারে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হবে; মানে সে যেনো ওয়াকিবহাল থাকেন যে, তার কপালে মৃত্যুদন্ড ছাড়া অন্যকিছু অবশিষ্ট নাই। 

একবার চিন্তা করেন- কী ভয়াবহ! এই প্রবিধানানুযায়ী চলমান পরিস্থিতিতে যারাই সংবিধান সংস্কারের কথা বলছেন- তারা প্রত্যেকে মৃত্যুদন্ডের আসামী।  

মনে করুন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন নির্বাচন হলো; তারপর নির্বাচিত সরকার হিসেবে যারা ক্ষমতায় আসীন হবেন, তারা বর্তমান প্রবিধানকে পূণরুদ্ধার করে উল্লেখিত কাজে সম্পৃক্তদের মৃত্যুদণ্ডের আসামী করলো, এবং তাদের শাস্তি কার্যকর হলো। পরিস্থিতিটা একবার ভাবুন- কী ভয়ানক ব্যাপার! আমাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটি খুব অস্বাভাবিক ভাবাও চিন্তার অপরিপক্কতা বলে বোধ করি। 

তাই এই প্রবিধানের কথা নিবিষ্ট মনে ভাবলে বোঝা যাবে যে, সংস্কার কতোটা বিপজ্জনক কিংবা সম্ভব কিনা পাঁচবার চিন্তার ব্যাপার। 

 

এবার আসি সংশোধন প্রশ্নে- বাংলাদেশের সংবিধানের অ্যামেন্ডমেন্ট হয়েছে ১৭ বার। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংবিধান সংশোধনের হিশেবের তুলনায় আমাদের সংবিধান তুলনামূলক কম সংশোধন হলেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- রাষ্ট্রের ও জনগণের কল্যাণে কয়বার হয়েছে সংশোধন। উত্তর হলো- দুয়েকটি বাদে প্রায় সবগুলোই রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে। যখন যে দল ক্ষমতাসীন হয়, তারা তাদের স্বার্থান্বেষী মনোভাব থেকে বের হতে পারেন না; ফলত একদল অন্যদলের শাসনামলের সংশোধনকে অবৈধ কিংবা বাতিল ঘোষণা করেন। এ থেকে অনুমেয় যে, তৎকালীন বিচারবিভাগের স্বাধীনতা আদতে কতখানি ছিলো, আর রাজনৈতিকভাবে মোটিভেটেড হয়ে কতখানি তারা পরিচালিত হয়েছিলো। এবং এই বিপ্লবী সরকারও যদি সেই সংশোধনের পথেই পা বাড়ায়, তবে পরবর্তীতে যারা আসবে, তারাও যে এই সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করবে না, তার কি প্রোটেকশন কিংবা গ্যারান্টি বিদ্যমান! সংস্কার ও সংশোধনীর বাইরে কেউ-কেউ সংবিধান পূণঃপ্রণয়ণের কথাও বলছেন, আমি মনে করি তা হবে আত্মঘাতি এবং ইতিহাস পাশ কাটানো সিদ্ধান্ত। কেননা দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ৭১ এ যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছিলাম, তার ফল কিন্তু এই সংবিধান। সুতরাং, এই সত্যকে পাশ কাটিয়ে যদি এগজিস্টিং সংবিধানকে বাতিল ঘোষণা করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, তাহলে পরবর্তীতে এই প্রশ্ন উঠা অসমীচীন হবে না যে, তারা কি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করলো কিনা!

একই সংবিধানের ৭০(খ) অনুচ্ছেদের ভাষ্য হলো- 

"কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি- সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না"।

এই প্রবিধাণ প্রত্যক্ষ্যভাবেই আইনবিভাগের স্বাধীন কার্যক্রমের বিপরীতে অবস্থান করছে, এবং এজন্যেই একে "কালোআইন" নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। কল্পনা করা যায়! আপনি আপনার আত্মসমালোচনা করতে পারবেন না, করলে আপনার পদ ও অবস্থানের অবনতি ঘটবে। আপনার দল যদি রাষ্ট্রের কিংবা নাগরিকের স্বার্থের বিপরীতে যায়- এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, আপনি তার কোনো ক্রিটিক করতে পারবেন না। এরচেয়ে স্বৈরাচারী আর কি-ই বা হতে পারে! আইন নিজেই যেখানে স্বৈরাচারে পরিণত হয়, সরকার তো সে অবস্থানে যাওয়া মামুলি ঘটনা। 

 

এবার একটু সাংবিধানিক আইন বিজ্ঞানের আয়নায় দৃষ্টি ফেরাই - 

অস্ট্রিয়ান সংবিধান প্রণেতা ও আইনী এবং রাজনৈতিক দার্শনিক হ্যান্স কেলসেনের পিউর থিউরি অব ল কিংবা আইনের বিশুদ্ধ তত্ত্ব অনুযায়ী  গ্রান্ডনর্ম কেলসেন এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন মৌলিক নিয়ম, আদেশ বা নিয়ম বোঝাতে যা একটি আইনি ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত ভিত্তি তৈরি করে । তত্ত্বটি সমস্ত আইনের জন্য একটি মূল বিন্দু খুঁজে বের করার প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যার ভিত্তিতে মৌলিক আইন এবং সংবিধান তাদের বৈধতা অর্জন করতে পারে।

যাইহোক, এসব তত্ত্ব ও তথ্য বিবেচনা করেই "সংশোধন, সংস্কার, ও পূণঃপ্রণয়ন" এই তিনটি শব্দকে বিনীতভাবে খারিজ করার পক্ষে মত দেয়াটাই সমীচীন বলে মনে করি।

সুতরাং, যে সংবিধানে এমন জনবিরোধী প্রবিধাণ সহ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের অভিমুখী সংস্কার, সংশোধন বা অনুরূপ কার্যক্রম রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল ও প্রচলিত আইনানুসারে সর্বোচ্চ শাস্তি "মৃত্যুদণ্ডের" এন্তেজাম বিদ্দমান, তার ৭১ ও ২৪'র অভিপ্রায় বিবেচনায় নিয়ে অতীত ও বর্তমানের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাজুস্য রেখে বর্তমান সংবিধানের প্রস্তাবনাসহ অন্যান্য ভালো প্রবিধাণগুলোর সমন্বয়ে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত "সাম্য, সামাজিক মর্যাদা, ও মানবিক ন্যায়বিচারকে" মানদণ্ড ধরে "পুনর্লিখনের" দিকে এগোনো যায় কিনা, সেদিকে নজর রাখা সময়ের তাৎপর্যপূর্ণ দাবি; এবং তার মাধ্যমেই নির্মাণ হতে পারে আমজনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা ও পরম অভিপ্রায় ও অভিব্যক্তির নতুন বাংলাদেশ। 

 

 

লেখকঃ শাহাদাত সুফল 

কবি ও সংবিধান গবেষক

shahadatsupol102@gmail.com