হাত থেকে কখন গুড়ের দলাটা মাটিতে পড়ে গেছিল, মনে করতে পারে না, ময়ফল। সে গুড়ের দলাটাকে ঘিরে পিঁপড়ার উৎসবের দিকে তাকিয়ে থেকে ধ্যানী হয়। দলগতভাবে পিঁপড়া আসছে, আবার দলগতভাবে পিঁপড়া ফিরে যাচ্ছে। যাবার আগে তারা যার যার মতো করে গুড়ের দলাটায় ওঠানামা করছে, ঘুরছে ফিরছে। মুখে করে গুড় নিয়ে যাচ্ছে কি-না, ময়ফল তা বুঝতে পারে না। যেমন বুঝতে পারে না, যেসব পিঁপড়া ফিরে যাচ্ছে তারা আবার ফিরে আসছে কি-না। ফিরে না আসলেও তারা গিয়ে অন্য পিঁপড়াদের এখানের উৎসবের কথা জানাচ্ছে হয়তো। তাই পিঁপড়াদের আগমনের স্রোত কমছে না। একটা পিঁপড়ার চাহিদা কতটুকু হতে পারে, তার নিজের অথবা তার পরিবারের! ময়ফল ভাবে। পিঁপড়াদের পরিবার থাকে কি-না তাও ময়ফল মনে করতে পারে না। তবে সমাজ একটা যে আছে, তা পিঁপড়ারাদের শৃঙ্খলিত কাজ-কর্ম দেখে তার বিশ্বাস হয়। তারপর হঠাৎ করে গুড়ের দলাটাকে তার পৃথিবী বলে মনে হতে থাকে আর পিঁপড়াগুলোকে মনে হতে থাকে মানুষ। মানুষের স্রোতও পৃথিবীতে আসছে। যার যার মতো করে একেক দিক থেকে পৃথিবীটাকে দেখছে, খাচ্ছে, কর্ম অনুযায়ী ফল নিয়ে স্রোতের মতো ফিরে যাচ্ছে। একই পিঁপড়া বারবার ফিরে আসছে কি-না তা যেমন বুঝতে পারে না, তেমনি একই মানুষ বারবার ফিরে আসছে কি-না, ময়ফল বুঝতে পারে না। তবে কয়েক শ বা কয়েক হাজার পিঁপড়ার মধ্য থেকে সে কোনো স্ত্রী বা পুরুষ পিঁপড়া আলাদা করতে পারে না। আলাদা করতে পারে না তাদের ধর্মও। মানুষের ধর্ম থাকে। যদি আবার জন্ম পায় তবে সে পিঁপড়া হবে। ময়ফল যখন পিঁপড়া হতে চায়, তখন মেঘের পেটের ভেতর থেকে সূর্যটা বের হয়ে আসে। হঠাৎ আলোর ঝাঁপটায় সে দেখে দিনের অর্ধেকটা তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। ময়ফল উঠে দাঁড়ায়। হাঁটে।
ময়ফলকে কেউ বলে ফকির, কেউ বলে পাগল, কেউ কেউ আবার কিছুই বলে না, তারা ময়ফলকে ময়ফল নামেই ডাকে। তবে পরনির্ভরশীলতায় পেট চললেও ময়ফলকে কেউ ভিক্ষুক বলে না। ময়ফলকে দেখে বয়স আন্দাজ করা না গেলেও সবাই ধরে নেয় পঞ্চাশের এপাড়-ওপাড়। দিনে সে গাগনির বাজার, শিবচরের বাজার ও আমতলীর বাজারের বিভিন্ন দোকানির দান-দক্ষিণায় ক্ষুধা মেটায়। প্রতিটি বাজারেই ময়ফলের গুণমুগ্ধ কিছু ভক্ত আছে। তারা ময়ফলকে ডেকে নিয়ে দোকানে বসায়। যার যার সাধ্য মতো খাতির যত্ন করে, এটা সেটা খেতে দেয়, দোয়া চায়, গল্প শোনে। ময়ফল গল্প বলে, বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে পাওয়া গল্প, ঘরে ঘরে দেখা গল্প, মানুষের মুখে মুখে শোনা গল্প। মানুষের গল্প। তার নিজের গল্প শুনতে চাইলে সে শুধু একটা কথাই বলে- ‘আমি নিজেরে খুঁজতাছি গো ভাই। নিজেরে খুইজ্জা যেইদিন পাইয়াম, হেইদিন তোমরারে আমার গল্প হুনাই যাইয়াম’। অথবা কোনো কোনোদিন নিজের গল্পের আব্দারে সে কিছুই বলে না, গান ধরে-
আমার ভিতর বসত আমার
চোখ দেখে না তারে,
ছয় রিপুতে খাইলো মিলে
মায়ার এই সংসারে।
রঙ মহলা এক আয়না ঘর
বানাবো তাই নিজের ভিতর
কোথায় পাবো সেই কারিগর
খুঁজি দ্বারে দ্বারে।
আমি তো নই আমার মতো
যখন তখন অবিরত
বদলাই বারেবারে।
একের ভিতর অনেক আমি
ক্ষণে চলি ক্ষণে থামি
প্রয়োজন অনুসারে।
দিনের বেলাতে সবাই ময়ফলকে দেখতে পেলেও দিন শেষে ময়ফল কোথায় থাকে কেউ দেখে না, জানে না অথবা খবর রাখে না। দিনের বেলায় ময়ফল যখন কোনো চায়ের দোকানে, ভাতের হোটেলে অথবা গাছের ছায়ায় আয়েশ করে বসে, তখন তাকে ঘিরে রাখে। কিন্তু রাতে তাদের কেউই ময়ফলের খোঁজ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। ময়ফল কোনো সমাজের মধ্যে নেই, জাতের মধ্যে নেই, ধর্মের মধ্যে নেই। ময়ফল একটা পিঁপড়ার মতো, একটা পাখির মতো, একটা গাছের মতো। আবার কখনও কখনও মনে হয়, ময়ফল তার ঝোলার চালগুলোর মতো, পয়সাগুলোর মতো, টাকাগুলোর মতো। চিকন চাল, মোটা চাল, লম্বা চাল, খাটো চাল, আউশ-আমন-ইরি চাল, সব মিলে মিশে একাকার। হারাম হালালের পয়সা, মিষ্টির দোকানের পয়সা, মুদি দোকানের পয়সা, সব একাকার। টাকাগুলোও তেমন। ময়ফলকে সবাই ডাকে, খাতির যত্ন করে। ময়ফলের গল্পে তারা সুখ পায়, গানে তারা আনন্দ পায়, সঙ্গবাসে রস পায়। কিন্তু ময়ফলকে কেউ পায় না। ময়ফল সবার হয়ে থাকে, সবার মধ্যে থাকে।
ময়ফল যখন হেঁটে হেঁটে আমতলীর বাজারে পৌঁছায় তখন আমতলীর হাট জমে ওঠেছে। বাজারের এক পাশে হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ায় সে। লাঠির ছায়া ছোট হয়ে পায়ের কাছে পড়ে থাকে। আর ময়ফলের মাথার ছায়া অশ্বত্থ গাছের ছায়ার নিচে চাপা পড়ে থাকে। ময়ফল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জমে উঠা হাট দেখে, মানুষ দেখে, কেনা-বেঁচা দেখে। খালেক ক্যানভাসার পলিথিন বিছিয়ে সাড়ি সাড়ি করে বৈয়াম সাজিয়ে বসেছে। বড় বাকশের মতো তার টেপ রেকর্ডার বাজছে। মানুষ বিভিন্ন গাছ-গাছড়ার ঔষধিগুণ শুনে তার শরবত কিনে। ওই কোনায় বসেছে দবির মিয়া। কথার ঘোরে তলিয়ে যাওয়া মানুষ তার খাউজানি চুলকানির মলম কিনে। বানর খেলা দেখায় পরিমল। বানরটা লাঠির মাথায় উঠে বসে। পরিমলের কথা মত বানর প্রথমে সবাইকে সালাম দেয়, নমস্কার করে। তারপর বানর নতুন জামাই কেমন করে শ্বশুর বাড়ি যায় দেখায়, নতুন বউ কেমন করে কাঁদে দেখাতে শুরু করে। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাটুরে মানুষ সেসব দেখে, হাসে, পয়সা ছুড়ে দেয়।
ময়ফলের চোখ হাটের আরও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়, দৃষ্টিসীমার যেখানে যেখানে যা হয় সব দেখে। দুনিয়াটাকেও তার তখন একটা হাট মনে হতে থাকে। মানুষ আসে, প্রয়োজন মাফিক কেনা-বেচা করে, চলে যায়। বারমাসি কাঁথায় জড়ানো ময়ফলের শরীর ঘামে, মুখ তেলতেলে হয়। ময়ফলকে অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাতেন ছুটে আসে। নিজের দোকানে নিয়ে বসায়, রুটি কলা খেতে দেয়। চা দেয়। ময়ফলকে ঘিরে ঝটলা জমে। গল্প জমে। জমা মানুষের চা খাওয়া জমে। নতুন পাত্তির লিকারের চা, দুধ দেয়া ঘন চা, কম পাত্তির চিনি দেয়া চা। বাতেনের বিক্রি জমে। ময়ফল গল্প বলতে শুরু করে, এক দরবেশের গল্প।
‘কোন এক দেশে, নামকরা এক দরবেশ ছিল। তার কাছে সারাদিনই ভক্তবৃন্দের আনাগোনা লেগে থাকতো। কিন্তু দরবেশের পত্নী তাকে দরবেশ হিসেবে বিশ্বাস করতো না। বাইশ বছরের সংসার জীবনে দরবেশ পত্নী, তার মাঝে আলাদা কিছু দেখেনি। অন্য আট দশজন সাধারণ মানুষের মতোই দরবেশ কাজ করে, খায়, ঘুমায়, পত্নীর সাথে লীলাখেলা করে। তাই কোনোভাবেই পত্নীর, দরবেশকে দরবেশ বলে বিশ্বাস হয় না। একদিন পত্নী, দরবেশের কাছে তার মনের এই গোপন অবিশ্বাসের কথা জানাতে গেলে, দরবেশ উল্টো পত্নীর পরিচয় জানতে চায়। পত্নী রেগেমেগে বলে- ‘বাইশ বছর আমার লগে সংসার কইরা তিন পোলা-মাইয়ার বাপ হইলা আর এখন আমারে জিগাও আমি কেডা! তুমি আসলেই একটা ভণ্ড’। দরবেশ, পত্নীর কথায় হাসতে হাসতে বলে- ‘বাইশ বছর সংসার করছি ঠিকই, কিন্তুক আমি তোমার মুখ দেখবার পারি নাই। তাই তোমারে চিনতাম কেমনে!’
ময়ফলের গল্পের এই পর্যায়ে লোকজন হেসে ওঠে। দরবেশের পত্নী বধে, যার যার পত্নী বধ করার আনন্দ পায় তারা। হাস্যোরসে গল্প আরও জমে ওঠে। উৎসাহ ব্যাঞ্জক ধ্বনি তোলে সকলে। ময়ফল সবাইকে থামিয়ে দিয়ে আবার গল্প বলা শুরু করে-
‘দরবেশের কথায়, পত্নী আরও ক্ষুণ্ণ হয়। দরবেশের এই কথার মানে জানতে চায়। দরবেশ তখন পত্নীকে কানায় কানায় পূর্ণ করে এক গ্লাস দুধ আনতে বলেন। পত্নী, দরবেশের কথা মতো গ্লাস ভর্তি দুধ নিয়ে আসে। দরবেশ, পত্নীকে নিয়ে বাজারে যায়। বাজারে তখন রাতভর এক সার্কাস পার্টি খেলা দেখায়। সার্কাসের সব খেলা অনায়াসেই দেখা যায় এমন এক উঁচু আসনে দরবেশ, পত্নীকে বসিয়ে দেয়। আর পত্নীর হাতের তালুতে বসিয়ে দেয়, কানায় কানায় ভর্তি দুধের গ্লাস। পত্নীকে খেলা দেখতে বসিয়ে আসার সময়, দরবেশ তাকে দুটি শর্ত জুড়ে দেয়। প্রথম শর্ত, সারারাত সার্কাসে কি কি খেলা দেখলো সকালে গিয়ে দরবেশকে সব বর্ণনা করতে হবে। আর দ্বিতীয় শর্ত, হাতে ধরে রাখা দুধের গ্লাস থেকে যদি এক ফোটা দুধ পড়ে যায়, তাহলে পত্নী তালাক হয়ে যাবে। দ্বিতীয় শর্ত দরবেশ পত্নীকে বিশেষ ভাবনায় ফেলে দেয়। এই বয়সে স্বামীর কাছ থেকে তালাক পেলে সে লজ্জায় সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। স্বামী-সংসার ছাড়া তার আর কেউ নেই। বাপ-মা মরার পর থেকে ভাইদের সাথেও সম্পর্ক চুকে গেছে। অনেক আগে থেকেই তাদের কারও সাথে কোনো সংযোগ নেই। এই বয়সে তালাক হলে, গলায় ধরি দেয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকবে না।‘
ময়ফলের গল্পের রোমাঞ্চ সকলের মধ্যে চাপা উত্তেজনা তৈরি করে। সবাই নিস্তব্ধ জমাট হয়ে থাকে। ময়ফল একটু বিরতি নিয়ে সামনের মুখগুলোর দিকে তাকায়। অযত্নে বেড়ে উঠা গোঁফের নিচ দিয়ে, হাতে ধরে থাকা চায়ের কাপে চুমুক দেয়। আবার গল্প শুরু হয়-
‘সার্কাসের খেলা শুরু হয়। দরবেশ পত্নীর আসন থেকে মাঠের খেলা পরিষ্কার দেখা যায়। সে খেলা দেখতে থাকে। খেলা দেখে তার হাসি পায়। হাসিতে শরীর কেঁপে ওঠে। শারীরের কাঁপন তার হাতে নামে। সে কাঁপন হাত বেয়ে হাতের গ্লাসে যায়। গ্লাস কেঁপে উঠলে, কানায় কানায় ভর্তি গ্লাসের দুধে ঢেউ ওঠে, দুধ পড়ে যাবার উপক্রম হয়। তখন দরবেশ পত্নীর, দ্বিতীয় শর্তের কথা মনে পড়ে। বাইশ বছরের বিবাহিত জীবন তার, এক ফোঁটা দুধের মধ্যে ঝুলে থাকে। দরবেশ পত্নী সার্কাসের খেলা দেখা বাদ দিয়ে, হাতের গ্লাস আর দুধের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঠের বিভিন্ন জায়গায় সার্কাসের বিভিন্ন খেলা হয়। রাতভর সেসব খেলা চলতে থাকে। দরবেশ পত্নীর খেলা দেখতে ইচ্ছা হয়, ঘুমাতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু স্বামীর তালাক দেয়ার শর্ত থেকে বাঁচার জন্য সে কিছুই দেখতে পারে না, কিছুই করতে পারে না।
রাত শেষে খেলা শেষ হয়, দরবেশ পত্নী বাসায় ফিরে আসে। দরবেশের কাছে দুধভর্তি গ্লাস জমা দেয়। এবার দরবেশ, পত্নীর কাছে সারারাত দেখা সার্কাসের খেলার কথা জানতে চায়। পত্নী তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে- ‘তুমি আমার লগে মশকরা করো! তোমার তালাকের শর্ত থেকে বাঁচতে গিয়া আমি তো সারারাত গ্লাসের দুধের দিকেই তাকাই আছিলাম, সার্কাসের খেলা দেখবো কখন?’। পত্নীর কথা শুনে দরবেশের ঠোঁটের কোনায় আবারও হাসি ফুটে ওঠে। সে হাসিতে বিজয়ীর গর্ব আর বিজেতার প্রতি উপহাস, হাস্নাহেনার গন্ধের মতো লেগে থাকে। সে হাসি ধরে রেখেই পত্নীকে এবার তার কথার মানে বোঝায়- ‘তুমি যেই কারণে সারারাত মাঠে বইসা থাইকাও সার্কাসের কোনো খেলা দেখ নাই, আমিও একই কারণে বাইশ বছর তোমার লগে সংসার কইরাও তোমার মুখ দেখি নাই। আমিও আমার পরমের কাছ থাইকা, তালাকের শর্ত মাথায় নিয়া বইসা আছি। এই দুনিয়ায় থাইকাও দুনিয়া সার্কাসের কোনো খেলাই আমি দেখতাম পারি না। কোনো খেলাতেই আমি থাকতাম পারি না। আমার শরীর থাকলেও আমার মনের কোনো সংযোগ নাই। মানুষ যেমন সার্কাসের মাঠে তোমারে দেইখা ভাবছে তুমি সারারাইত সার্কাসের খেলা দেখছো, আমারও হইছে তেমনই অবস্থা। সবকিছুতে থাইকাও কোনোকিছুতেই আমি নাই। আমি থাকি না, থাকতাম পারি না।‘
ময়ফলের গল্প বলা শেষ হয়, জমায়েত লোকজনের মধ্যে হঠাৎ যেন কেমন একটা মনোবৈকল্য তৈরি হয়। নিঃসাড় উদাসীনতা তাদের ঘিরে ধরে। অজ্ঞাত কোনো এক ভাবাবেগে তাদের বুকের অন্তঃপ্রদেশ পূর্ণ হয়ে আসে। বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা ঘনায়। কেউ কেউ উঠে বাড়ির পথ ধরে। উঠে পড়ে ময়ফলও। হাঁটতে হাঁটতে সে আবার গান ধরে-
যেই জ্ঞানে মন চিনবি তোরে
সেই জ্ঞানের তুই কর সন্ধান,
তোতা পাখির মতন করে
বাইবেল কোরআন গীতা পড়ে
বৃথায় মন তুই হলি পেরেশান।
মাটি দিয়া বাকশো গড়ে
তার ভিতর কে বসত করে
ভেবে দেখ মন নিজ অন্তরে
তোর না কার অবস্থান।
যেই জ্ঞানে মন চিনবি তোরে
সেই জ্ঞানের তুই কর সন্ধান।
যেই জ্ঞানে হয় দিব্য দৃষ্টি
বিনা মেঘে ঝরবে বৃষ্টি
তোর ভিতরেই স্রষ্টা-সৃষ্টি
খুঁজলে পাবি পরিত্রাণ।
যেই জ্ঞানে মন চিনবি তোরে
সেই জ্ঞানের তুই কর সন্ধান।
পরদিন সকালে লোকজন যখন দুধ বেঁচতে অথবা মাছ কিনতে অথবা চাল-ডাল কেনাবেচা করতে আমতলীর বাজারে যায়, তখন তারা ময়ফলকে দেখতে পায়, মৃত। ময়ফলের নিস্পন্দ দেহ বাজারের কাছাকাছি হাঁটা পথের ধারে, আধমরা দূর্বাঘাসের সংগ্রামী জবনের পাটাতনে পড়ে আছে। সংবাদটা দ্রুত বাজারে যায়। মানুষের মুখে মুখে ফিরে, বাতাসে ভেসে বেড়ায়, ছড়িয়ে যায়। ময়ফলের গুণমুগ্ধ ভক্তরা কেঁদে ওঠে, আপনজন হারানোর শূন্যতা অনুভব করে। অন্য সকলে পরিচিতজনের মৃত্যুর মতো আফসোস করে। সকালের আড়ঙে আসা লোকজন, মৃত ময়ফলকে জীবিত ময়ফলের মতোই ঘিরে থাকে, জটলা করে থাকে। নিবিষ্ট মনে ময়ফলের নিথর দেহের উপর তাদের দৃষ্টি নিবন্ধিত করে রাখে। লাশটাকে একটা পরিত্যাক্ত চৌকির উপর রাখা হয়। ময়ফলের মৃত্যু সংবাদ মুখে মুখে ছড়াতে থাকলে, লোকজনও বাড়তে থাকে। শোক সামলে গুণমুগ্ধ ভক্তরা যখন ধাতস্থ হয়ে দাফনের আয়োজন শুরু করতে চায়, তখন একটা প্রশ্ন বিরাট হয়ে দেখা দেয়। একটা সংকট উপস্থিত সবার দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়, একটা পরিচয় খুব জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। ময়ফলের ধর্ম পরিচয়। একজন আরেকজনের কাছে ময়ফলের ধর্ম পরিচয় জানতে চায়, কেউ বলতে পারে না। ময়ফলকে কে কবে থেকে দেখে আসছে, তাও বলতে পারে না। ময়ফলের নিবাস বলতে পারে না, বাবা মা কে তাও বলতে পারে না। এমন এক সংকট যখন আমতলীর বাজারে চলতে থাকে, তখন হিদিল নামের একজন বর্শার ফলার মতো তীক্ষ্ণ এবং আশ্চর্য এক সংবাদ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। ময়ফলকে মৃত অবস্থায় শিবচরের বাজারেও পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে গাগনির বাজারেও। সে নিজে দু জায়গাতেই ময়ফলের লাশ দেখে এসেছে। দু জায়গাতেই, ময়ফলের দাফন নিয়ে, ধর্ম পরিচয় নিয়ে, একই সংকট লেগে আছে। কোনো বাজারের কেউ ময়ফলের ধর্ম বলতে পারে না, পরিচয় বলতে পারে না। কোন মতে ময়ফলের দাফন করবে, সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
সিদ্ধান্তহীন তিন বাজারের নেতৃত্ব স্থানীয় লোকজন, এলাকার চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়। চেয়ারম্যান ময়ফলকে খুব ভালো করেই চিনেন। এক ময়ফল কি করে একই সময়ে তিন জায়গায় মারা গেল এবং এক জনের কেমনে তিনটা লাশ হলো, বুঝতে পারেন না। এসব নিয়ে একটা শোরগোল শুরু হয়। চেয়ারম্যান, থানার দারোগা সাবকে খবর পাঠায়। দারোগা সাব, এমন আশ্চর্য সংবাদ পেয়ে দ্রুত ছুটে আসেন। তিনি নিজে সরেজমিনে তিন জায়গায় গিয়ে ময়ফলের লাশ দেখেন। অদ্ভুত এই ঘটনার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ, থানার সারোগা সাব, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাব ও উপস্থিত জনতার কেউ দাঁড় করাতে পারে না। অবোধ্য, অব্যাখ্যায় এই ঘটনার কারণ খোঁজার চেষ্টা বাদ দেয় এবং আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়- যেই বাজারে যেই ধর্ম-মতের লোকজন বেশি, সেই বাজারে ময়ফলকে সেই ধর্মমতেই দাফন করা হবে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আমতলীর বাজারে ইসলাম ধর্মমতে, শিবচরের বাজারে হিন্দু ধর্মমতে এবং গাগনির বাজারে খৃষ্টান ধর্মমতে, ময়ফলের দাফন সম্পন্ন হয়। দাফন সম্পন্ন হতে হতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। লোকজন ময়ফলের বিগত জীবন নিয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকে, বাড়ি ফিরতে থাকে। এক ময়ফল কিভাবে একদিনে তিন জায়গায় মারা যেতে পারে, তা নিয়ে কথা বলে। তিন ধর্ম অনুসারে তিন জায়গায় দাফন করার সিদ্ধান্তটা কেমন হয়েছে, তা নিয়ে কথা বলে। হিদিল নামের লোকটাও হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পথ ধরে, একা। তবে তার মনে কি চলতে থাকে বলা যায় না। হিদিল যখন সে সন্ধ্যার আঁধারে শুধু নিজেকে সাথে নিয়ে হেঁটে যায়, তখন বিপরীত দিক থেকে একজন তার সামনে এসে দাঁড়ায়। হিদিল ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। একই সাথে অনেকগুলো যতিচিহ্ন, তার চেহারায় ফুটে ওঠে। কোনোমতে তোতলাতে তোতলাতে হিদিল জিজ্ঞেস করে- ‘তুমি? আমরা যে তোমারে দাফন কইরা আসলাম!’ দাঁড়ি-গোঁফে ঢেকে যাওয়া ঠোঁটে অদ্ভুত এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে সেই একজন জবাব দেয়- ‘তোমরা একজন মুসলমান, একজন হিন্দু আর একজন খৃষ্টানকে দাফন করছো, আমি তো ময়ফল। মানুষ। আমি তো মরি না, মরতে পারি না।‘ ময়ফলের জবাব শুনে হিদিলের মুখ দিয়ে কোনো কথা সরে না। কথার অপেক্ষা না করে তাকে পাশ কাটিয়ে, গাঢ় হয়ে আসা আঁধারের পথে কুটি মনসুরের লেখা ও সুরের এক গান ধরে এগিয়ে যেতে থাকে ময়ফল। নিশ্চল হিদিল বিহ্বল হয়ে সে গান শুনতে থাকে-
কে বলে মানুষ মরে
আমি বুঝলাম না ব্যাপার......
ওরে মানুষ মরলে পরে
বিচার হবে কার......
অবশ্য এরপর ময়ফলকে কেউ আর কোথাও দেখেনি।
-------------------------------------------------------------------------
নোটঃ এই গল্পে ময়ফলের মুখে বর্ণিত দরবেশের ঘটনাটি একটি প্রচলিত লোকগাথা।