শুরুর পরিচিতি: রাহিমের জীবন
পাহাড় আর সবুজের সমারোহে ঘেরা ছোট্ট এক গ্রাম। এই গ্রামে বাস করত রাহিম। পেশায় তিনি একজন কৃষক। তার জীবনের বড় সম্পদ ছিল তার নৈতিকতা এবং আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস। রাহিম ছিলেন গ্রামের সবচেয়ে সৎ মানুষ, যিনি সবসময় চেষ্টা করতেন ন্যায়বিচার করতে।
তবে তার সততাই অনেকের চোখে ছিল কৌতুকের বিষয়। গ্রামে সবাই বলত, “এই রাহিম! সততার কি এমন দাম, যে এখনো এত গরিব?”
রাহিম তাদের ব্যঙ্গ শুনে কখনো ক্ষুব্ধ হতেন না। বরং তিনি মৃদু হাসতেন এবং বলতেন, “গরিব যদি সততার সাথে জীবন কাটাই, তাতেই আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর আল্লাহ সন্তুষ্ট হলে, আমার জন্য দুনিয়া আর আখি রাত দুটোই যথেষ্ট।”
রাহিমের এই বিশ্বাস থেকেই শুরু হয় এক পরিবর্তনের গল্প।
---
অপরাধী যুবকের আগমন
এক সন্ধ্যায়, রাহিম তার খেতে কাজ করছিলেন। তখন এক অচেনা যুবক তার জমির পাশে এসে ক্লান্ত শরীরে বসে পড়ে। তার পরনে ছেঁড়া কাপড়, চোখে আতঙ্ক আর চেহারায় অপরাধবোধের ছাপ।
রাহিম তাকে দেখে বললেন, “তোমার কি কোনো সমস্যা হয়েছে ভাই? তোমার দেখেই মনে হচ্ছে তুমি বিপদে আছো। এসো, একটু বিশ্রাম নাও।”
যুবকটি দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে বলল, “আমি এখানে পালিয়ে এসেছি। আমার নাম সামির। আমি…আমি এক অপরাধ করেছি। আপনার সাহায্য চাইছি।”
রাহিম যুবকের মুখে ভয় আর দুঃখের ছাপ দেখে বুঝলেন, এখানে কিছু গভীর সমস্যা আছে। তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন, “তুমি কী ধরনের অপরাধ করেছ? বলো, যদি সম্ভব হয় আমি তোমাকে সাহায্য করব।”
সামির অশ্রুসিক্ত চোখে বলল, “আমি একজন চোর। আমি এক ব্যবসায়ীর দোকান থেকে মূল্যবান জিনিস চুরি করেছি। এখন সবাই আমাকে খুঁজছে। আমার ভুল হয়ে গেছে।”
রাহিম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, “যদি তুমি সত্যিই অনুতপ্ত হও, তবে জেনে রাখো, আল্লাহ সবচেয়ে ক্ষমাশীল। তার কাছে তওবা করো। এসো, আমার এখানে কিছুদিন থাকো। আল্লাহর পথে ফিরে আসার সুযোগ তোমাকে আমি দেব।”
---
ইসলামের শিক্ষা: পরিবর্তনের শুরু
সামির প্রথমে দ্বিধায় ছিলেন। কিন্তু রাহিমের আচরণ দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন। রাহিম তাকে কখনো দোষারোপ করলেন না, বরং শান্ত কণ্ঠে তাকে সান্ত্বনা দিলেন।
প্রতিদিন ভোরে, রাহিম আর সামির একসাথে নামাজ পড়তেন। নামাজ শেষে রাহিম সামির সঙ্গে আল-কুরআনের আয়াত গুলো পড়ে শোনাতেন। তিনি একটি আয়াত বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন:
“বলুন, হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছে! তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করেন। নিশ্চয়ই তিনিই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু” (সূরা আয- জুমার, ৩৯:৫৩)।
এই আয়াত সামিরের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রভাব ফেলল। তিনি অনুভব করলেন, তার পাপ গুলো সত্ত্বেও আল্লাহ তাকে ফিরিয়ে নেবেন যদি তিনি আন্তরিকভাবে তওবা করেন।
রাহিম তাকে নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনের ঘটনাগুলো শোনাতেন। একদিন তিনি বললেন, “একবার মক্কার এক মহিলাকে চুরির অভিযোগে আনা হয়েছিল। কিছু লোক তার জন্য সুপারিশ করতে চেয়েছিল। নবী (সাঃ) বলেছিলেন, ‘তোমরা কি আল্লাহর আইন থেকে কারো জন্য ছাড় চাইছ? আল্লাহর আইন সবার জন্য সমান।’ কিন্তু সেই মহিলার জন্য নবী করুণার দরজা বন্ধ করেননি। তিনি তাকে অনুতপ্ত হতে বলেছিলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।”
সামির ধীরে ধীরে বদলাতে লাগল। তিনি বুঝতে পারলেন, ইসলামের সৌন্দর্য তার আইন এবং ন্যায় বিচারে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি এর করুণা এবং ক্ষমার মধ্যে।
---
অপরাধের হিসাব: ব্যবসায়ীর আগমন
মাস কয়েক পর, গ্রামে একদিন হঠাৎ একজন ধনী ব্যবসায়ী এলেন। তিনি বললেন, “এই গ্রামে চুরি করা আমার মূল্যবান জিনিসগুলো আমি ফিরে পেয়েছি। কিন্তু আমি শুনেছি, অপরাধী এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে। তাকে আমাকে দিন। আমি শাস্তি চাই।”
গ্রামের লোকেরা তৎক্ষণাৎ রাহিমের বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করল। তারা বলল, “আপনার যে চোর, সে হয়তো রাহিমের আশ্রয়ে আছে। কারণ, রাহিম সব সময় এমন লোকেদের সাহায্য করে।”
ব্যবসায়ী রাহিমের কাছে এসে চিৎকার করে বললেন, “তুমি কি আমাকে সাহায্য করবে? নাকি অপরাধীর পক্ষ নেবে?”
রাহিম শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, “আপনার চুরি যাওয়া জিনিস কি আপনি ফেরত পেয়েছেন?”
ব্যবসায়ী বললেন, “হ্যাঁ, আমি কয়েকদিন আগে আমার সব সম্পদ ফেরত পেয়েছি।”
রাহিম মুচকি হেসে বললেন, “তাহলে আপনি কি জানেন, আল্লাহ আমাদের শিক্ষা দেন যে অপরাধীর অনুতাপ হলে তাকে ক্ষমা করতে হবে? আপনি যদি তাকে ক্ষমা করেন, তবে আল্লাহ আপনার পুণ্য বাড়িয়ে দেবেন।”
ব্যবসায়ী কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “আপনি যদি মনে করেন, সে সত্যিই পরিবর্তিত হয়েছে, তবে আমি তাকে ক্ষমা করলাম।”
---
শেষ অধ্যায়: ইসলামের বিজয়
সামির এই দৃশ্য দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তিনি ব্যবসায়ীর কাছে গিয়ে বললেন, “আপনার সম্পদ আমি চুরি করেছি। কিন্তু আমি তওবা করেছি এবং সেগুলো ফেরত দিয়েছি। রাহিম ভাইয়ের শিক্ষা এবং ইসলামের সৌন্দর্য আমাকে বদলে দিয়েছে। এখন আমি আমার জীবনের বাকিটা সময় আল্লাহর পথে চলতে চাই।”
গ্রামের লোকেরা এই ঘটনা দেখে হতবাক হলো। তারা বুঝতে পারল, ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য সহমর্মিতা, ন্যায়বিচার, এবং ক্ষমার মধ্যেই নিহিত।
রাহিমের কথাগুলো এখন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। যে লোকেরা আগে তাকে ব্যঙ্গ করত, তারাই এখন তার কাছে পরামর্শ নিতে আসতে লাগল। আর সামির পুরোপুরি পরিবর্তিত হয়ে গ্রামে একজন বিশ্বস্ত মানুষ হিসেবে জীবন শুরু করলেন।
---
গল্পের মূল শিক্ষা
ভুল করা মানুষের স্বভাব, কিন্তু অনুতাপের মাধ্যমে আল্লাহর ক্ষমা পাওয়া সম্ভব।
ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য এর ন্যায়বিচার, সহমর্মিতা, এবং ক্ষমায়।
ক্ষমা করার গুণ একজন মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে।
এই গল্প আমাদের শেখায় যে, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং ইসলামের সঠিক চর্চা একজন অপরাধীকে ও প্রকৃত মানুষের পথে নিয়ে আসতে পারে