Posts

ফিকশন

নীলা

November 17, 2024

জেরিন সুলতানা

50
View

নীলা
আমি আর প্রতাপ কাঁধ থেকে মোটা ব্যাগটা নামিয়ে রাখলাম স্যাঁতসেঁতে মেঝেটাতে। ঘরটা ছোট,বহু পুরোনো, কোন আমলের তা বলা মুশকিল,তবে দু-তিনশো বছর যে পুরোনো তা বোঝা খুব একটা কঠিন নয়। দেয়ালে শুধু পোড়া ইটের গাধুনি, কোনো রকম প্লাস্টার নেই। দেয়ালের এখানে সেখানে ছোট ছোট ছায়া অনুরাগী লতা প্যাঁচিয়ে আছে। দিবালোক থেকে নিজেদের আড়াল করতেই হয়তো এই শত বছর পুরোনো ঘরে তাদের অনুপ্রবেশ। বারান্দার পিলারগুলোতে সূক্ষ্মহাতে লতাপাতার নকশা করা, ঘরের কোণে আদিম এক আলো আঁধারের উন্মত্ততা। পুরো ঘরটাকে  প্রাচীন এক অশ্বত্থ বৃক্ষ নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছে, দেখে মনে হয় গাছটাও এই ঘরের ই অংশ। বাড়ির পাশে আর কোনো গাছ নেই, সামনে একটু হাটলেই একটা পুকুর, পুকুরের পানি কালো কাচের মতো স্বচ্ছ, পানিতে নামার জন্য বাধাই করা সিঁড়িঘাট আছে, ব্যবহার না হওয়াতে এখন তাতেও শ্যাওলার মোটা আবরণ পড়েছে।
দুপুরের রোদ গড়িয়ে বিকেলের সোনালী আভা ছড়িয়ে পড়েছে পুকুরের কালো পানিতে ভেসে থাকা আধফোটা লাল শাপলার উপর। নভেম্বর চলে,,, আমার আর প্রতাপের এখন নাগরিক জীবনের সমস্ত ব্যস্ততা ফেলে রেখে অজপাড়াগাঁয়ের এই পোড়াবাড়িতে এসে কালো পানির পুকুরের সামনে ঠায় হয়ে বসে থাকার কথা ছিল না।  প্রতাপের কথা জানিনা, সে আধ পাগল মানুষ, হুটহাট কি সব করে তার আগা মাথার ঠিক নেই। কিন্তু আমি এখানে কেন?? ইয়া আল্লাহ। দুইদিন পর আমার প্রোজেক্ট সাবমিশন, তার সবকিছু ফেলে রেখে আমি আমার পাগল বন্ধুর মনরক্ষার্থে তার এক কথা, দুই কথাতে ভুলে মোটা একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে শহর থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরে একটা পোড়াবাড়ির পুকুরের সামনে বসে পা দুলাচ্ছি। 
প্রতাপ বলছে- আজই হবে বুঝেছিস?
আমি বললাম- হুম
- আজ কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী না?
-হুম
- হুম মানে কি?  মন খুলে কথা বলা যায় না?
-হুম
- তোর কি একটা লাগবে?
- নাহ
- নিতে পারিস, আমি তিন তিন বার স্বপ্নে দেখেছি,তাও ঠিক তিন দিন পর পর। বিফল হওয়ার কথা না। 
- লগ্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত কি এখানে এভাবেই বসে থাকতে হবে?
- তুই চাইলে যেতে পারিস, কিন্তু আমাকে থাকতেই হবে।নয়তো সব পন্ড।
- তাহলে আমিও থাকি, দেখি এই পুকুর থেকে কি এমন অলৌকিক রত্ন উঠে আসে যার আলোয় তোর সারাজীবন ধন্য হতে চলেছে।
- আহ্, তুই ব্যপারটাকে এভাবে নিচ্ছিস কেন? তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তুই সবকিছুর উপর মহা বিরক্ত। ব্যাপারটাকে একটু অন্যভাবে ভাব। আমি তিন তিন বার একটা স্বপ্ন দেখলাম আবার সেই স্বপ্নের মতো এমন একটা জায়গা এক্সিস্টও করে পৃথিবীতে, ব্যপারটা একটু অদ্ভুত না,,,,
- নাহ,,,অদ্ভুত না। তোর মাথায় পুরোনো সব পরিত্যক্ত বাড়ি আর উদ্ভট উদ্ভট জিনিস নিয়ে ঝোঁক কাজ করে,  তাই স্বপ্নে তুই ঘুরেফিরে এসবই দেখিস, ব্যাপার টা এমনও না তুই স্বপ্নে বাড়িটা কোথায় আছে তা জানতে পেরেছিস! তাহলেও এখানে একটু অলৌকিকতা থাকত, তুই স্বপ্ন দেখার পর মানুষজনদের জিজ্ঞেস করেছিস যে এমন বাড়ি আছে কিনা,,,,and you know what,,,, বাংলাদেশে পুরোনো পরিত্যক্ত এমন হাজারো বাড়ি আছে যার এমন পুকুরঘাট আছে আর পাশে অশ্বথ গাছ আছে,,,it’s very common and they just drop you an one.......!!!!!!!!!!
- তাও এস্ট্রোলজি বলে একটা কথা আছে, অনেক গ্রহের মারপ্যাঁচে আমাদের ভাগ্য আটকানো,,,,অনেক কিছু বুঝলি! কিছু না থাকলে একই স্বপ্ন তিনবার দেখতাম না।
- হ্যা,,এখন চলুন আপনার রত্ন সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করি। 

দিনের শেষ আলোটুকুও পুকুরের কালো পানিতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঝিঁঝিঁপোকারা গাইছে, একটা দুইটা জোনাক পোকার মিটমিট আলো চোখে পড়ছে,,জ্বলছে,নিভছে। আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ, তাই আলোটা একটু গাঢ়,হলুদাভ। তারাও আছে কিছু। হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দে চমকে উঠলাম। আমি আর প্রতাপ দুজনেই পিছু ফিরলাম। একটা বয়স্ক লোক হাতে হ্যারিক্যান নিয়ে এদিকে আসছে। গ্রামের কোনো বৃদ্ধ হয়তো।
- আসসালামু আলাইকুম 
- ওয়াআলাইকুমুস সালাম 
- আফনেগরে দেখলাম এই জায়গায় আন্ধাইরে বয়ে আছেন,তাই ভাবলাম আলোটুক নিয়া যাই, শহর থিইকা আসছেন, কোনো বিশেষ দরকার এইহানে?
- জ্বি, দরকার একটু আছে বৈ কি চাচা, আলো নিয়ে আসার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, কিন্তু আলো তো এখানে জ্বালিয়ে রাখা যাবে না, আপনি হারিকেন বন্ধ করে চলে যান। প্রতাপ কন্ঠ ভারী করে বলল।
লোকটা সাথে সাথে হারিকেন বন্ধ করে আমাদের পাশে বসে পড়ল।
- ঠিকই বলেছেন,, হারিকেনের আলোয় সমস্যাই,এত সুন্দর চাঁন্দের আলো থাকতে হারিক্যান কেন জ্বালায় রাখুন লাগব, আমি এইহানে থাকলে আফনেগো কোনো সমস্যা নাই তো?
- না, সমস্যা কেন থাকবে? তবে বেশি কথা বলবেন না,  বেশি কথা বললে আমার ধ্যানে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। আমি আরেকটু পরই ধ্যানে বসব,,,ধ্যান শেষ করে মাঝরাতে আমাকে এই পুকুরে নামতে হবে, দিবাকর রত্নের খোঁজ করতে হবে। 
- উহ,,আইচ্ছা আইচ্ছা, এমন তাজ্জব জিনিসও আমগো গ্রামে আছে হে তো জানতাম না। যাইহোক,এই দিবাকর রত্ন দিয়া আফনে কি করবেন? এবং প্রতাপের কাছ থেকে বৃদ্ধ কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, কোনোদিন চাঁন্দের আলো খেয়ে দেখছেন?
- আমি বললাম না, খেতে কেমন?
- লোকটা বললো, একটু মিডা লাগে,,তবে বেশিরভাগ সময়ই পানসে।
- আমি বললাম, ওহ আচ্ছা। 
প্রতাপ বিরক্তি নিয়ে বলল,, আপনারা দয়া করে একটু চুপ থাকুন। একটু পর আমাকে ধ্যানে বসতে হবে, একটা শব্দ হলেও পুরো ধ্যানই নষ্ট। 
লোকটা আর কোনো কথা বললো না,,যতক্ষণ সময় ছিল এক দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিল। লোকটা কোনো অপার্থিব কোনো সৌন্দর্যের খোঁজ পেয়েছেন, সেই সৌন্দর্য যা পৃথিবীতে এসেছে বহু বহু দূরের কোনো পথ পাড়ি দিয়ে। রাত একটু বাড়লে লোকটা নিঃশব্দে উঠে চলে যায়, যাওয়ার সময় হারিকেন টাও সাথে নিয়ে নেয়। তবে এবার আর তা জ্বালেনি। অন্ধকারেই ছায়াপ্রেতের মতো মিলিয়ে গেল লোকটা। আমি প্রতাপের পাশে বসে আছি। সে গাঁয়ের জামা খুলে ধ্যান করছে। কিছুক্ষণ পরই হয়তো পানিতে নামবে দিবাকর রত্ন খুজতে। ঝিঁঝিদের ডাক ছাড়া আমার কানে আর কোনো শব্দ আসছে না। হঠাৎ চারদিকের পিনপতন নীরবতাকে ছিন্ন করে ক্ষীণ একটা নুপুরের শব্দ কানে আসতে লাগলো, আমার আত্নারাম খাঁচা ছাড়ার আগেই মনে মনে আয়াতুল কুরছি পাঠ করতে করতে পেছনের দিকে তাকালাম। 
- নীলা!!!
চিকন রুপোলী পাড়ের নীল শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নীলা দাঁড়িয়ে আছে। তার পিঠ ছড়ানো খোলা চুলে মুখের পুরোটা ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না। হাতে ছোট একটা প্রদীপ, প্রদীপের আলো তার কালো চোখের মোটা কাজলের রেখায় প্রতিফলিত হচ্ছে, কপালে গাঢ় নীল রঙের একটা ছোট টিপ, কানের একপাশে নাম না জানা একটা নীল ফুলের গুচ্ছ। 
ধীর পায়ে সে এগিয়ে আসছে এদিকে,,,,,গুণে গুণে ছয়টা সিঁড়ি নিচে বেয়ে আমার পাশে এসে বসেই আমার দিকে তাকালো,,,তাঁর চাহনি দেখে মনে হলো সে এখনি ঘুমিয়ে পড়বে, ঐ তন্দ্রাসিক্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বললো, কাল ফেরার পথে বড় বাড়ির বাজারের রাস্তা দিয়ে ফেরো না। 
আমি আবার ডাকলাম "নীলা"...........
তারপর ধপাস একটা শব্দ,, প্রতাপ পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর উঠছে, আবার ডুব দিচ্ছে, আবার উঠছে,,আবার ডুব দিচ্ছে। 
রাত প্রায় শেষের দিকে,,ফজরের আজান হচ্ছে, চারদিকে আলো ফুটতে শুরু করেছে,,,প্রতাপ উঠে এলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলতে লাগলো,," Bullshit,,bullshit" 
নভেম্বরের সারারাত পুকুরের ঠান্ডা পানিতে ডুবিয়ে ও দিবাকর রত্ন পাক বা না পাক,,এ বছর সর্দি কাশি ভালো করেই পাবে।
প্রতাপ গায়ে জামাকাপড় ঠিকঠাক ভাবে জড়িয়ে নেয়ার পর আমি ধীর কন্ঠে বললাম,,,
" প্রতাপ নীলা এসেছিল" 
প্রতাপ ভুরু কুচকে জিজ্ঞেস করল,,"নীলাটা কে?'"
আমি যেন হঠাৎ একটা ঘোর থেকে উঠে এলাম,,,প্রতাপের কুচকানো ভ্রূ জুগোলের দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম সত্যিই তো,, " নীলা কে??"
প্রতাপের থেকে চোখ নামিয়ে ধীর কন্ঠে বললাম "কেউ না",," চল আজ বড় বাড়ি যে রাস্তাটা দিয়ে এসেছিলাম, ঐ রাস্তা দিয়ে আর না ফিরি" 
প্রতাপ জিজ্ঞেস করল - কেন?
আমি বললাম, এমনি।
-তোর অন্য কোনো রাস্তা জানা আছে?
- আমি বললাম, আছে।
ঠিকাছে,,, চললল...
পরেরদিন সকালে খবরের কাগজ উল্টিয়ে দেখি, উমুক রাস্তা ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনায় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু। 
আচ্ছা,, এই রাস্তায় ই নীলা আসতে মানা করেছিল না?
 

Comments

    Please login to post comment. Login