পোস্টস

নন ফিকশন

শিক্ষার প্রদীপ যেভাবে নিভিয়ে দিচ্ছে জুলাই আগস্টের এনার্কিস্টরা

১৭ নভেম্বর ২০২৪

Afsana Kishwar

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম চিওড়াতে আমার পৈতৃক ভিটা।ঢাকায় জন্ম ও বেড়ে উঠা আমার মায়ের মৃত্যুর পর,মা'কে দাদার বাড়ীতে কবর দেয়ায় একটু যাওয়া আসে বাড়ে।মানুষের তারুণ্যে যা হয় নিজের ঘেরাটোপে মানুষ ঘুরতে থাকে,খুব বেশি আত্মীয় স্বজনের সাথে একেবারে প্রাণের সখ্য যাকে বলে তা গড়ে উঠে না।

 

কুমিল্লার মানুষদের নিয়ে নানা রকমের মজার আলাপ আছে-বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম কুশীলব মোশতাকের কারণে এ জেলার মানুষদের প্রতি আমার একধরনের সন্দেহ কাজ করে।পরবর্তীতে যখন শ্চীন দেব বর্মণের গানের সাথে পরিচিত হয়েছি,জেনেছি গান্ধীজীর অভয় আশ্রমের কথা,আত্মীয়দের মুখে কুমিল্লা জিলা স্কুল,নওয়াব ফয়জুন্নেসা স্কুলের কথা জেনেছি আমার সেই আড়ষ্ট ভাব অনেক কমে এসেছে।আমার সাধারণ জ্ঞান সেই বিচারে ফিরে গিয়েছে যে ভালো মন্দ গড়পড়তা মানব মানবী পৃথিবীর সব প্রান্তেই বিরাজমান।

 

আমাদের এলাকায় বছরের পর বছর জামায়াতের আবু তাহের ছিল এমপি।তার আগে জাতীয় পার্টির ছিল রমরমা।ঐখানে একটা চালু বাক্য আছে আমাদের মাটিতে কোপ দিলে শুধু ফেনসিডিলের বোতল পাওয়া যায়।যাই হোক এত কথা বলা প্রকৃতার্থে নিজের মনের ভার লঘু করার জন্য।সারা বাংলাদেশেই এসব ঘটেছে,ঘটছে।আমাদের কাছে খুন,ধর্ষণ,নিপীড়ন,লুটতরাজ,অগ্নিসংযোগের শত শত ঘটনা জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে এসেছে,এখনো আসছে।দেখতে দেখতে,শুনতে শুনতে এক একজন গ্রানাইট পাথরের মতো ভাবলেশহীন হয়ে গিয়েছি।

 

নভেম্বরের ১৫ তারিখে ২০২৪ সালে মুফাসসসিল ইসলাম কুমিল্লার শিক্ষক আকুবপুর ইউনিয়নের শিখা রাণী রায়ের সাথে একটা লাইভ করেন,তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষক আকুবপুর ইয়াকুব আলী ভূঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের।

 

সেই ঘটনা যদি আমরা সারসংক্ষেপ করি তা হলে যা দাঁড়ায়-

 

শিখা রাণী ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সকাল ৮.২২ এ স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন (এই বিল্লাল বর্তমানের অবৈধ ইউনুস সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব এর পিতা) এর মোবাইলে কল পেয়ে স্কুলে যান,বিল্লাল বলেন স্কুল ২০ লক্ষ টাকার একটি ফান্ড পেয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। অভুক্ত শিখা রাণী স্কুলে পৌঁছালে প্রায় ১০ টা নাগাদ তাকে প্রথমে স্টুডেন্ট ও এলাকাবাসীর সমন্বয়ে গড়ে তোলা মবের মাধ্যমে পদত্যাগ করতে বাধ্য করতে চেষ্টা করেন বিল্লাল।

 

এ কাজে ব্যর্থ হলে বিল্লাল ও স্কুল কমিটির মেম্বাররা শিখাকে একটি বদ্ধ রুমে তাদের পালিত ক্যাডার আবুল বাশার,সালাহউদ্দিন মেম্বার,সাত্তার(সাদেকের ভাই-তারা ভাইরা একজন যুবলীগের ক্যাডার,১জন জামায়াতের ক্যাডার এবং সাত্তার বিএনপির ক্যাডার),সহকারী শিক্ষক কামরুজ্জামান,আবুল কালাম আজাদ(বাশার,সাত্তার এদের সরাসরি শিক্ষক),মনির,সেলিম,জাভেদ,মহিউদ্দিন এদের হাতে তুলে দেন।পূর্বেই মবের হাতে নিগৃহীত শিখার তখন শরীরের অবস্থা খারাপ-অনবরত হাত মোচড়ানোতে চামড়া ফেটে হাত ফুলে গেছে,মাথায় বারবার আঘাতে তিনি বিভ্রান্ত,চড়-থাপ্পড়ের সাথে মানসিক নিগ্রহে তিনি বিপর্যস্ত।

সেই বদ্ধরুমে তাকে চেয়ার থেকে ফ্লোরে ফেলে দেয়া হয়-তার ঊরুতে পায়ে এই ৮-৯জন ক্যাডার অনবর‍ত আঘাত করতে থাকে,সেই সাথে চলে রেজিগনেশন পেপারে সাইন করানোর জন্য জোরজবরদস্তি করা।এ সময় তিনি জ্ঞান হারালে তাকে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানো হয়।

 

শিখাকে সে হিন্দু তাই সে শেখ হাসিনার দালাল,কোন ড্যাডাইয়া স্কুলে থাকতে পারবে না,হিন্দু রাখা যাবে না স্কুলে এ মর্মে গালি গালাজ চলতে থাকে।

 

এর মধ্যে শিখা বহুবার কাকুতি মিনতি করেন জল পান করার জন্য ও ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য (ভিডিও দেখতে হবে ২৪ মিনিট থেকে ৩৮ মিনিট শুনলেই হবে)।

 

তাকে জল পান করতে না দিয়ে বরং তার তলপেট লাথি দিয়ে ফাটিয়ে দিতে বলে আবুল বাশার,সেলিম,মনির।তারা শিখা রাণীকে স্কুলের আরেক শিক্ষক কৃষ্ণ পদ সাহার সাথে কলেমা পড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন।

পয়েন্ট টু বি নোটেড,আবুল বাশার নির্যাতনের এ পর্যায়ে হাতে একটি পাইপ তুলে নেন এবং শিখা রাণীর গোপনাঙ্গে এটি প্রবেশ করানোর কথা বলেন বেশ কয়েকবার।

 

ক্যাডাররা শিখা রাণীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করে ভিডিও করে তা ফেসবুকে দেয়ার হুমকিও দেন তিনি পদত্যাগ না করলে।

 

এই চলমান নির্যাতনের এক পর্যায়ে শিখা রাণীকে এ বদ্ধ রুম থেকে বের করে আনা হয়।তাকে তার নাইট গার্ড নাসির ও আরেকজন নারী শিক্ষক ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়।

 

এরপর উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের পিতা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন ও তার ক্যাডার বাহিনীর নেতৃত্বে শিখা রাণীকে রাস্তায় হাঁটানো শুরু হয়,সাথে ভিডিও করা চলে উৎসুক জনতাকে দিয়ে।

 

শিখা রাণীর মোবাইল কিন্তু সেই সকাল থেকে আবুল বাশারদের হাতে।

 

তাকে অটোতে তুলে পেছন থেকে হাত ঢুকিয়ে ব্লাউজের ভেতর,ব্লাউজ ছিঁড়ে দেয় বিল্লাল ও তার ক্যাডার বাহিনী।

 

শিখা রাণী ২৫/৮/২০১২ সালে এ স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।এর আগে তিনি দেবীদ্বারে একটি স্কুলে ১৯৯৮ থেকে কর্মরত ছিলেন।শিখা রাণীর পিতা ধীরেনও ছিলেন দেবিদ্বার রেয়াজ উদ্দিন পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক।

 

পুরো আলোচনা ও পত্রিকার নিউজ ঘেঁটে আমরা শিখা রাণী রায় হিন্দু এ ছাড়া আর কোন দোষ পাওয়া যায়নি।পরবর্তীতে বিল্লাল নিজের চামড়া বাঁচানোর জন্য শিখা রাণীর বিরুদ্ধে একটি মানববন্ধন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।শিখা রাণী ৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে এমন অভিযোগও দৃশ্যমান করতে চেষ্টা করেন কুমিল্লার কিছু ভুঁইফোড় পত্রিকায়।

 

শিখা রাণীকে সরিয়ে জামায়াত শিবিরের কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ করার জন্যই এত চেষ্টা তা সহজেই অনুমেয়।অথচ উপদেষ্টা আসিগের পিতা প্রধান শিক্ষক বিল্লাল নারী নির্যাতন মামলায় অভিযুক্ত হলে এই শিখা রাণী প্রত্যয়নপত্র দিয়ে বিল্লালকে মুক্ত করে স্কুলে পুনর্বাসিত করার কাজটি করেন মানবিক দিক বিবেচনায়। উপদেষ্টা আসিফও শিখা রাণীর ছাত্র।

 

শিখা রাণী হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন।পুলিশে অভিযোগ দায়ের করলেও কোন তদন্ত এখনো হয়নি।

 

আমরা ভিয়েতনাম,চীন এসব দেশের তথাকথিত বিপ্লব দেখেছি।আমরা জানি গ্রামসির সেই মতামত যে শাসক গোষ্ঠী শিক্ষকদের মাধ্যমে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ছাত্রদের কাছে পৌঁছায়-সেই তত্ত্বকে ভর করেই জামায়াত শিবির বিএনপি হিজবুত ডানেচলা বামেরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এগারোশ শিক্ষককে চাকুরীচ্যুত করেছে এবং যারা মুসলামন নয় এমন শিক্ষকদের অকথ্য অসম্মান,শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছে,কয়েকজনকে মেরেও ফেলেছে।

 

অনেকদিন,বা অনেক বছর কুমিল্লার মেয়ে হিসেবে আমার আর খাদি,রসমালাই,শচীন কত্তার গান মনে পড়বে না।আমার মনে আসবে শিখা রাণীর আর্তি।আমার মনে আসবে চব্বিশের মীরজাফর আসিফ নরজুলের কথা।আমার মনে ভাসবে আসিফদের মতো মনুষ্যসদৃশ প্রাণীরা নিজের মাতৃতুল্য শিক্ষিকাকে ধর্ষণের হুমকি দিতে পারে,গায়ে হাত তুলতে পারে শুধু ধর্ম পরিচয়ের কারণে।

 

 

বিভিন্ন লিংক নীচে

 

১.মুফাসসিলের সাথে করা লাইভ ২৪ মিনিট থেকে ৩৮ মিনিট দেখা জরুরী https://youtube.com/live/zdCvZdHKYyk?si=yTRJcfZAbxU5RRc4

 

২.সংবাদপত্রে ৪৯ জন সংখ্যালঘু শিক্ষককে পদত্যাগে করানোর কথা স্বীকার করা হয়েছে 

https://www.prothomalo.com/bangladesh/g0dzl6qg65

 

৩.শিখা রাণীকে রাস্তায় ঘুরানোর ভিডিও লিংক

https://youtu.be/JDaG4ZzEGc4?si=7IxJXbZNKbdKW25t