পোস্টস

সমালোচনা

ছেলের বিয়েতে মায়ের অনুপস্থিতি

১৭ নভেম্বর ২০২৪

সৌরভ কুমার দেব

 প্রাচীনকাল থেকে বাংলার সনাতন হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় একটি প্রথা বা বলা যায় অপসংস্কৃতি চলে আসছে যে,  নিজের ছেলের বিয়ে মাকে দেখতে নেই । ছেলে বিয়ের সময় মা কিংবা মাতৃস্থানীয়রা বাড়িতে থাকতেন কিংবা অবস্থান করতেন । কোনো প্রকারে তারা তাদের ছেলের বিয়েতে ছেলের শ্বশুর বাড়িতে যেতেন না। এই  অদ্ভুত প্রথার প্রকৃত কারণ কি আমরা সত্যিই জানি বা এ সম্পর্কে অবগত আছি? না এ সম্পর্কে কোনো কিছুই জানি না। না মন গড়া কোনো ভ্রান্তি ধারণা বা বিশ্বাস নিয়ে পরম্পরা চলছে। আসুন আমরা এ সম্পর্কে জানি। চলুন তাহলে! 

  সেকালের এই ভ্রান্তকর বিশ্বাসটি  সনাতন সমাজ ব্যবস্থায় এতোই দৃঢ় ছিল যে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক,  বিয়ের পর তারা পর হয়ে যায় । বলা যেতে পারে  ছেলে বিয়ের পর বউয়ের কথা মতো চলে আর মেয়ে বিয়ের পর স্বামী বা শ্বশুর বাড়ির স্বজনদের কথা মতো চলে। তবে সে সময়ে মেয়েরা যেমন আক্ষরিক অর্থে অন্যের হেফাজতে স্থানান্তরিত হতো ছেলেদের ক্ষেত্রে ঠিক ততটা হতো না। কারণ স্বরূপ বলা যায় তৎকালীন সনাতনী সমাজ ছিল  সম্পূর্ণ কৃষিভিত্তিক । চাষাবাদ করে সংসার চলত। বর্তমান সভ্যতার মতো এতো সুযোগ-সুবিধা  সম্পন্ন চাকরি-বাকরি এবং তৎপ্রসূত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল খুবই কম । নাই বললেই চলে।  ফলে সংসারের অর্থনীতির চাবি থাকতো দাদু ঠাকুমার হাতে এবং তাঁরা গত বা পরলোক পাড়ি দিলে  সংসার পরম্পরানুসারে চলে আসত বাবা-মার হাতে ।  কেবল তখন তারা একটু স্বাভাবিক ও স্বাধীনভাবে সংসার পরিচালনা করতে পারতেন। 
 

  তাই বিয়ের পর  ছেলেরা মনে মনে বউ এর অধীন হলেও ছেলের স্বাধীনচেতা হওয়া হতো না । বাবা মার সামনে বউ এর প্রতি একটি নিস্পৃহভাব দেখাতে হতো । এতে গেল আপাতদৃষ্টিতে ভাল ছেলের আচরণ ৷ 
 

 কিন্তু মা ও বাবা দুজনেই জানতেন ছেলে বিয়ের পর আর পুরোপুরি তাদের বাধ্যগত থাকবে না।তাই বিয়ের সময় আনুষ্ঠানিক কাজকর্ম করার জন্য বাবা কিছুটা কঠিন থাকলেও মা মনের ভাব গোপন করতে পারতেন না। এর ওপর পাড়ার কাকিমা জেঠিমা এসে মায়ের কান ভাঙ্গানি দিতেন আর বলতে থাকেন- অমুকের মা তমুকের মা এই ছেলে বিয়ে দিচ্ছিস। তোর এবার সুখ শেষ হলো। এখন ছেলের বউয়ের মেজাজে চলবি। ছেলে আজ থেকে পর হয়ে যাচ্ছে । 
এসব কথা শুনে তখন আবেগি মায়ের মন তখন নানা আকথ কুকথা বলতো। এখানে বলা আবশ্যক যে বাঙালি জাতি মানে আবেগ প্রবণ জাতি। বিশ্বের সকল মানুষের কাছে এ জাতি বড় আবেগি হিসেবে সমাদৃত।  হাস্যকর হলেও তা চিরন্তন সত্য।  
 

 মা বিয়ের দিন তাই থেকে থেকে একান্তে চলে গিয়ে অশ্রুমোচন করতেন আর সুখ পরিত্যাগের দুঃখ বলতে থাকেন ।  ছেলে বিয়ে করতে যাবার আগে তাকে দিয়ে বলিয়ে নিতেন যে,  সে  নিজের বউ নয় মায়ের জন্য দাসী আনতে যাচ্ছে । আমি নিজেও অনেক জায়গায় শুনেছি তা বলতে। ছেলে বিয়ে করতে বাড়ি থেকে বের হবার সময় বলে, মা আমি বউ আনতে যাচ্ছি না তোমার জন্য একটি দাসি আনতে যাচ্ছি।  
 

একবার ভাবুন তো কি নিম্নমানের এসব কথা।  কতটা নিচু মন হলে ছেলেকে দিয়ে এসব কথা বলানো হয়। পরক্ষণে কি এই বউ পত্নী বা অর্ধাঙ্গিনি।  কি করে তা হলো।  প্রশ্ন করলে এর কোনো  সঠিক উত্তর বা সুরাহা পাওয়া যাবে না। আরে মশাই বিয়ে করতে যাবার সময় মাকে বলে গেলাম মায়ের জন্য দাসি আনছি আর বিয়ের পর এই দাসি কিনা হয়ে গেল ধর্মপত্নী।  পন্ডিতেরা তো এক্ষেত্রে  আরো বিরাট বিরাট শব্দ যোজন করে থাকেন।থাকগে এসব কথা।  প্রসঙ্গক্রমে মূল বিষয় থেকে সরে এলাম।
 

  আমি মনে করি ছেলে কিংবা মেয়ে বিয়ের সময় মায়েরা একরকম ছেলে মানুষী কাজ করেন। আর সে সময় বেশিরভাগ মা-রাই একটা ছেলেমানুষী ভাব নিয়ে থাকেন । যার ফলস্বরূপ  মা ছেলের বিয়ের  দধিমঙ্গল, ছাঁদনা তলা , শুভদৃষ্টি , মালাবদল , সিঁদুরদান এই সব সংবেদনশীল দৃশ্য দেখে যাতে খারাপ না লাগে সেজন্য এই সব সংবেদনশীল দৃশ্যগুলো থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্য,  নিজেকে এসব কর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য ছেলের বিয়েতে যেতেন না, যেতে চাইতেনও না । তিনি ঘর সামলাতেন এবং ছেলে ও তার বৌ এলে তাদের বরণ করতেন । এটাই হলো প্রকৃত তত্ত্ব।