Posts

প্রবন্ধ

ত্যাগের শিখায় জ্বলেছিল ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান।

November 18, 2024

জাবের আহমদ

32
View

আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিমসহ জানা-অজানা হাজারেরও বেশি প্রাণের বিনিময়ে বিজয় এসেছে। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। তাদের এই ত্যাগ আমরা ভুলব না, ভোলা সম্ভব না। পিতার সামনে সন্তানের, স্ত্রীর সামনে স্বামীর এমনকি মায়ের সাথে ফোনে কথা বলা অবস্থায় ছেলে নিহতের মতো মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী এই আন্দোলন। শহীদি কাফেলার এই আখ্যান পরবর্তী প্রজন্মের জন্য জানা এবং সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। 
প্রথম দিকের কিছু লিখে লিখাকে দির্ঘ না করে সংক্ষেপে কিছু লিখার চেষ্টা করেছি।
আমার বসবাস যেহেতু বিভাগীয় কেন্দ্রিক না,তাই আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল মাত্র একদিন, তা শেষের দিকে লিখব তাছাড়া অনলাইন কেন্দ্রীক সবধরনের আপডেট দেখার চেষ্টা করেছি রাত জেগে।
সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিবাদ করেছি ফেসবুকে। তবে একাধিক সতর্কবার্তা আসছে আমার মত সাধারণ একজন মানুষের জন্যেও। যাইহোক ১৪ই জুলাই হঠাৎ টাইম লাইন জোরে ভাসছে তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার।
তখনো এই স্লোগান বলার কারণ এর সূত্রপাত জানা হয়নি আমার। তারপর দেখতে পারলাম ফ্যাসিস্ট হাসিনার একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এই স্লোগান দিচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। সাংবাদিকের প্রশ্নোত্তরে তিনি বলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে না তে তাহলে রাজাকারের নাতি পুতিরা চাকরি পাবে নাকি? এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এই স্লোগান শুরু হয়। অতঃপর সারা দেশে এটা নিয়ে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। আর এদিকে ওবায়দুল কাদের (কাউয়া কাদের) এক বক্তব্য বলেছে ছাত্রলীগ নাকি ছাত্রজনতার জন্য যথেষ্ট। অতঃপর ১৫ জুলাই ছাত্রদের কর্মসূচি পালন করা অবস্থায় ছাত্রলীগ যুবলীগ ছাত্রজনতার উপর হামলা করে এবং অনেক ছাত্র-ছাত্রী আহত হয়। সেদিন রাত্রেই ভার্সিটির ছাত্রলীগের ছাত্রছাত্রীদেরকে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা হল থেকে বের করে দেয়। পরদিন ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নিহত হয়। যার কারণে মুহূর্তের মধ্যে সারাদেশে আন্দোলনের মাত্রা প্রতিক্রিয়া সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে ফেলে।

পুলিশের গুলিতে নিহত সাঈদের শেষ পোস্ট ছিল,
'শামসুজ্জোহা' হয়ে মরে যাওয়াটা বেশি গর্বের
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে 
নিহত হয়েছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু 
সাঈদ। মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) বাংলাদেশ সময় বেলা ২ টার দিকে রংপুর বেগম রোকেয়া 
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্কমোড়ে গুলিতে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আন্দোলকারী
আবু সাঈদ। পরে সহপাঠীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত
ঘোষণা করে।
মৃত্যুর একদিন আগে ১৫ জুলাই আবু সাঈদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে চলমান আন্দোলনে 
শিক্ষকদের অংশ গ্রহণ না করা নিয়ে আক্ষেপ করে একটি পোস্ট দেন। তাঁর মৃত্যুর পর এখন সেটি 
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে (ভাইরাল) পড়ে।
১৯৬৯ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ স্বাধীনতার পূর্বে তৎকালীন পাকিস্তানের শাসক আইয়ুব বিরোধী 
আন্দোলনের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রক্ষা করতে
গিয়ে শহীদ হন সেই সময়কার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক 
(তৎকালীন রিডার) সৈয়দমোহাম্মদ শামসুজ্জোহা। এই শিক্ষকও তার মৃত্যুর আগের দিন ১৭ ফেব্রুয়ারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের এক সভায় বলেন- “আজ আমি আমার ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এরপর 
কোন গুলি হলে তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার আমার গায়ে লাগে।”
সেই শামসুজ্জোহার এই উক্তিটি ফেসবুকে পোস্ট করে নিজের মৃত্যুর আগের দিন আবু সাঈদ
লিখেছেন- "স্যার! এই মুহুর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার! আপনার 
সমসাময়িক সময়ে যারা ছিল সবাই তো মরে গেছে, কিন্তু আপনি মরেও 
অমর। আপনার সমাধি, আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা 
উদ্ভাসিত। এই প্রজন্মে যারা আছেন, আপনারাও প্রকৃতির নিয়মে
একসময় মারা যাবেন। কিন্তু যতদিন বেচেঁ আছেন মেরুদণ্ড নিয়ে
বাচুঁন। নায্য দাবিকে সমর্থন জানান, রাস্তায় নামুন, শিক্ষার্থীদের 
ঢাল হয়ে দাড়াঁন। প্রকৃত সম্মান এবং শ্রদ্ধা পাবেন। মৃত্যুর সাথে 
সাথেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন না। আজন্ম বেচেঁ 
থাকবেন শামসুজ্জোহা হয়ে।অন্তত একজন 'শামসুজ্জোহা' হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের।" 
পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের নিহত হওয়ার পুরো ঘটনার একটি ভিডিও বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে
প্রচারিত হয়।
সেই ভিডিওতে দেখা গেছে- আন্দোলকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংর্ঘষ শুরু হওয়ার সময় সবার সামনে 
ছিলেন আবু সাঈদ। আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়তে থাকলে আন্দোলনকারী 
অন্যরা পিছু হটে গেলেও হাতে একটি লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে স্লোগান দিতে থাকেন আবু সাঈদ। 
এই সময় ঠিক সামনে থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে পুলিশ। হাতে থাকা লাঠিদিয়ে পুলিশের সেই 
রাবার বুলেট ঠেকানোর চেষ্টা করতে দেখা যায় আবু সাঈদকে। কিন্তু ক্রমাগতভাবে পুলিশের ছুড়তে
থাকা রাবার বুলেট কয়েকটি শরীরে লাগে তার।
ভিডিওতে আরও দেখা যায়, গুলি শরীরে লাগলে এক পর্যায়ে পিছু হঠেন আবু সাঈদ। ফুটপাতে বসে
পড়েন। তখন পেছন থেক কয়েকজন আন্দোলনকারী দৌড়ে এসে তার হাত-পা ধরাধরি করে নিয়ে
যায়। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোকে নিহত আবু সাঈদের বন্ধু অঞ্জন রায় বলেন, "শরীরে একের পর রাবার 
বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আবু সাঈদ। তাঁর নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। এ 
সময় সংঘর্ষচলছিল। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেরি হয়।"
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হৃদয় রঞ্জন রায় বলেন, 
"মেডিকেলের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তির আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে তাঁর শরীরের একাধিক স্থানে 
রাবার বুলেটের ক্ষত রয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল। কিন্তু রাবার বুলেটের আঘাতে মারা গেছেন কি
না, তা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ছাড়া এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।"
নিহত আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান বলেন, “বাবা মকবুল হোসেন শারীরিক অসুস্থতায় শয্যাশায়ী। 
ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আবু সাঈদ ছিল সবচেয়ে মেধাবী। তাই পরিবারের সবার উপার্জন দিয়ে
তাকে এতদূর পর্যন্ত পড়ালেখা চালিয়ে নিয়ে এসেছি। একদিন সে অনেক বড় হবে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত 
হবে সে আশা ছিল।” তিনি আরও বলেন,“আদরের ছোট ছেলের মৃত্যুর খবরে প্রায় পাগল হয়ে
গেছেন মা মনোয়ারা বেগম। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন, কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।”
১৭ জুলাই পুলিশের গুলিতে অনেকে নিহত হন।

১৮জুলাই মুগ্ধকে হারিয়ে শোকসাগরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
মুগ্ধের মৃত্যু র মিনিট ১৫ আগে ধারণ করা একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে
ভাসছে। তাতে দেখা যায়, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন সড়কে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ছোটাছুটি করছেন। 
এর মধ্যেই হাতে পানি ভর্তি বাক্স ও বিস্কু
ট নিয়ে ছুটছেন মুগ্ধ। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ তার কাছ
থেকে পানি পান করছেন। ধোঁয়ার মধ্যে বেশ কয়েকবার চোখ মুছতেও দেখা গেছে মুগ্ধকে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে গত মার্চে ঢাকায় আসেন মীর মাহফুজুর 
রহমান মুগ্ধ। এরপর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) এমবিএতে ভর্তি হন। স্বপ্ন 
ছিল উচ্চশিক্ষা নিতে একদিন দেশের বাইরে যাবেন। সেই প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন 
আর পূরণ হলো না। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষে গত ১৮ জুলাই 
রাজধানীর উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনি। 
মুগ্ধ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি
খেলাধুলা, গান ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে ক্যাম্পাসের প্রিয়মুখ ছিলেন তিনি। 
তার মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-
শিক্ষার্থীরা। তার মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান তারা সবাই।ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মুগ্ধের সঙ্গে থাকা বন্ধুনাইমুর রহমান আশিক বলেন, 'উত্তরায় 
ছাত্রদের ওপর হামলা হচ্ছে শুনে তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বন্ধুরা মিলে সেখানে ছুটে যাই। ওই দিন
অনেককেই মুগ্ধ আর আমি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছি। সন্ধ্যা ৬টার দিকে ছাত্রদের মাঝে পানি ও বিস্কুট
বিতরণ করে রোড ডিভাইডারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ রাজউক কমার্শিয়ালের সামনে থেকে
গুলি শুরু হয়। তখন অন্যদের সঙ্গে আমরাও দৌড় দিই। হঠাৎ গুলি লেগে সড়কে পড়ে গেছে মুগ্ধ। 
ক্রিসেন্ট হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।' পরে উত্তরাতেই তার 
দাফনকার্য সম্পন্ন হয়। 
মুগ্ধের জন্ম উত্তরায়, ১৯৯৮ সালে। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে মীর মাহবুবুর 
রহমান স্নিগ্ধ ও মুগ্ধ ছিলেন যমজ। উত্তরার ইসলামিক এডুকেশন সোসাইটিতে প্রাথমিক এবং উত্তরা 
হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করে ২০১৯ সালে মুগ্ধ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি
হন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ফুটবল খেলোয়াড়, গায়ক, গিটারিস্ট ও দক্ষ সংগঠক হিসেবে বেশ সুনাম 
ছিল তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান শিক্ষা সমাপনী-২০২৩ এর আহ্বায়ক ছিলেন তিনি, 
ছিলেন স্কাউট গ্রুপের ইউনিট লিডার। শ্রেষ্ঠ সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশ স্কাউটস থেকে পেয়েছেন
'ন্যাশনাল সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড'। 
মুগ্ধের বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত বলেন, 'পরিবারে সবার আদরের ছিল মুগ্ধ। ঘুরে বেড়াতে
পছন্দ করত ও। এমবিএর পাশাপাশি দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য আইইএলটিএস করছিল। কিন্তু 
সব কিছু এভাবে শেষ হয়ে যাবে, কে জানত!' 
মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, 'আমাদের 
তিন ভাইয়ের মধ্যে মায়ের সবচেয়ে বেশি
খেয়াল রাখত মুগ্ধ। সবসময় মায়ের 
দেখাশোনা করত। ফ্রিল্যান্সিং করে নিজের 
খরচ চালাত। মা এখনও কাঁদছেন। বাবা 
চুপচাপ হয়ে গেছেন।'
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের 
সহকারী অধ্যাপক শেখ আবদুস সামাদ
বলেন, 'মুগ্ধ অসাধারণ একটি ছেলে ছিল। 
কারও সঙ্গে কখনও গোলমাল, বেয়াদবি
করতে দেখিনি বা শুনিনি। ক্লাসে ওকে বকা 
দিলে এমনভাবে হেসে দিত, পরে ওকে
আর কিছুই বলতে পারতাম না।'
বিশ্ববিদ্যালয়টির গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী
মুহিব্বুল্লাহ বলেন, 'যেকোনো আয়োজনে 
সামনের সারিতে থাকতেন মুগ্ধ ভাই। 
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের আগে আন্দোলনে 
আমরা সক্রিয় ছিলাম। ঢাকায় থেকে তিনি
আমাদের সাহস দিতেন।'
মুগ্ধ'র রক্তে রঙ্গিন রাজপথ, পাশেই পড়ে 
আছে পানির বোতল ও বিস্কিটের প্যাকেট!

পরবর্তীতে নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় বেশি খবর নিতে পারিনি। ঢাকায় এক ভাইকে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম। ঢাকা শহরের অবস্থা এমন হয়েছে যা বলে বোঝানো সম্ভব না। ঢাকা শহরে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এমন যুদ্ধ যা হয়তো ১৯৭১ সালেও ঘটেনি, ভাইয়ের বক্তব্যটা এমনই ছিল। ২৭ জুলাই থেকে গণহারে ছাত্রদের গ্রেফতার শুরু করে ফ্যাসিষ্ট সরকার শেখ হাসিনা। অতঃপর আগস্টের ৩ তারিখ কোটা আন্দোলন গণ আন্দোলনে রুপ নেয়। ৪ আগস্ট ছিল এক দফা এক দাবি শেখ হাসিনার পদত্যাগ। বিভাগীয় কেন্দ্রিক অবস্থানে না থাকার কারণে প্রাথমিকভাবে কোনো কর্মসূচিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারিনি। তবে ৪ তারিখের কর্মসূচি যেহেতু সারা দেশে ছিল “এক দফা এক দাবি, শেখ হাসিনার পদত্যাগ”—তাই আমি এতে অংশগ্রহণ করলাম।

শহরে গিয়ে দেখি, আওয়ামী লীগের বড় নেতারা চেয়ারে বসে আছেন এবং চারদিকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ছেলেরা বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রসহ ঘোরাফেরা করছে। প্রায় ১৫-২০টি মোটরসাইকেল নিয়ে তারা আসে, প্রতিটি মোটরসাইকেলের পেছনে একজন করে ছাত্রলীগ বা যুবলীগের সদস্য , আর তাদের হাতে বড় লম্বা রামদা। তারা মোটরসাইকেল নিয়ে চক্কর দেয় এবং অস্ত্র প্রদর্শন করে।

এর কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে তাদের উদ্দেশ্যে বলল, “চলো।” পুলিশ আগে আগে চলল, আর ছাত্রলীগ-যুবলীগ পেছনে পেছনে আসতে লাগল। অন্যদিকে সাধারণ জনগণ ও ছাত্র-জনতা ছিল। এরপর পুলিশ ছাত্রলীগকে সঙ্গে নিয়ে সাধারণ জনতা ও ছাত্র-জনতাকে ধাওয়া দেয়। এভাবে কয়েকবার ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে এবং একপর্যায়ে পুলিশ গুলি ছোড়ে।

আমি ছাত্র-জনতার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি কাজে শহরের ভিতরে গিয়েছিলাম। সেই সময় আমার ফোন দিয়ে তাদের কার্যকলাপের ভিডিও ধারণ করছিলাম। হঠাৎ মিছিল থেকে এক ছেলে এসে ধমকের সুরে বলল, “কি করছেন? দেখি আপনার ফোনে কি আছে।” এরপর সে আমাকে হুমকি-ধমকি দিতে শুরু করে। তারা বলল, “আপনার ভিডিওগুলো ডিলিট করেন।” পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে ভেবে আমি আর কথা না বাড়িয়ে নিজেই ভিডিওগুলো ডিলিট করে দেই।
৪ আগস্ট সারা দেশে উত্তাল আন্দোলনের ঢেউ। ‘এক দফা এক দাবি—শেখ হাসিনার পদত্যাগ’—এই স্লোগানে মুখরিত পুরো দেশ। সুনামগঞ্জও ছিল সেই আন্দোলনের অংশ। উত্তাল রাস্তায় সাধারণ মানুষের ঢল, গগনবিদারী স্লোগান, আর পুলিশের দমনপীড়নের ভয়াবহ চিত্র এক অসহনীয় পরিবেশ তৈরি করেছিল।

সেদিন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা সুনামগঞ্জের একটি ছেলে, বয়স হয়তো ১৮-১৯, প্রাণ বাঁচানোর জন্য লুকিয়ে ছিল একটি বাসার সামনে রাখা দুইটি সিএনজির মাঝামাঝি। তার শরীর কাঁপছিল, মুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ। বাইরে পুলিশের ভারি বুটের আওয়াজ, লাঠি আর গুলির শব্দ। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের একটি দল সেই জায়গায় পৌঁছে যায়। তারা তাকে সিএনজির মাঝে থেকে টেনে বের করে আনে।

ছেলেটি প্রাণপণে বাঁচার আকুতি জানায়। কিন্তু পুলিশের সেই দল কোনো করুণার তোয়াক্কা না করে তার পায়ের দিকে গুলি চালায়। একের পর এক গুলি। ছেলেটি চিৎকার করতে থাকে, “বাঁচান! আমাকে বাঁচান!” তার আর্তনাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সেই আর্তনাদ শুনেও কেউ এগিয়ে আসার সাহস পায়নি।

গুলি করার পর পুলিশ সদস্যরা সেখানে দাঁড়িয়ে কী করবে তা নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। একজন পুলিশ বলে উঠল, "মেডিকেলে নেওয়া দরকার।" কিন্তু বাকিরা নির্বিকার।মাটিতে পড়ে থাকা ছেলেটির রক্ত ধীরে ধীরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছিল।

সুনামগঞ্জের এই পরিস্থিতি ছিল সেদিনের বাংলাদেশের এক ক্ষুদ্র চিত্র। বিভাগীয় শহরগুলোতে ছিল আরও ভয়াবহ অবস্থা। ঢাকার রাজপথে বিক্ষোভকারীদের রক্তে সিক্ত হয়েছিল পিচঢালা রাস্তা। মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসী দেখেছে পুলিশের গুলি, লাঠিচার্জ আর ধাওয়া।
সেদিনের ঘটনায় সারা দেশে নিহতের সংখ্যা পেরিয়েছিল শতাধিক। কত মায়ের বুক খালি হয়েছিল, কত স্বপ্ন থেমে গিয়েছিল।
প্রথমে ৬ আগস্ট "লংমার্চ টু ঢাকা" কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট, যা ৩৬ জুলাই হিসেবে পরিচিত, সেই দিনটি ফ্যাসিস্ট সরকার শেখ হাসিনার ভারত পালিয়ে যাওয়ার  ফলে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে জাতি দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করে।

স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে তা রক্ষা করা আরও কঠিন। তাই মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আমাদের এই অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করার তাওফিক দেন। আমীন।

Comments

    Please login to post comment. Login